চিরন্তন হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরালের পাশে লেখক
ছবি: লেখক

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন একটা বিশাল প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের ছিল অনেক শাখা-প্রশাখা। আর প্রতিটা শাখা-প্রশাখায় ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য বিচরণ। যেখানেই হাত দিয়েছেন, ফলিয়েছেন সোনা। তাঁর সৃষ্টি সময়কে অতিক্রম করে তাঁকে অমর করে রাখবে বলেই দৃঢ়বিশ্বাস। তাঁকে নিয়ে অনেক গবেষণা হওয়া দরকার। তাঁর প্রতিটা কাজের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের জীবনকে তাঁর সৃষ্টিতে মূর্ত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।

গ্রামীণ হুমায়ূন

বাংলাদেশের সাহিত্যে গ্রামীণ পটভূমি যতটা উঠে এসেছে, ততটা উঠে আসেনি রুপালি পর্দায়। শহুরে জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা এবং মূল্যবোধ এখনো অপাঙ্‌ক্তেয় একটা বিষয়। শহুরে জীবনে চলে এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা। কে কত দ্রুত তার গ্রামীণ পরিচয় ধুয়ে–মুছে শহুরে হয়ে উঠতে পারবে, সেই চেষ্টা খুবই দৃষ্টিকটু হলেও সত্য। গ্রামীণ সমাজের আঞ্চলিক ভাষা এখনো শহুরে মানুষদের অন্যতম বিনোদনের বিষয়। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সাহিত্যের পাশাপাশি নাটক–সিনেমায়ও গ্রামীণ পটভূমিকে চিত্রায়ণ করেছিলেন পরম মমতায়। আর তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে গ্রামীণ জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় উঠে এসেছিল। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ নাটক—সবখানেই তিনি তুলে ধরেছিলেন গ্রামীণ জনজীবনকে। পাশাপাশি লোকজ সংস্কৃতি ও গানগুলোকে তুলে এনেছিলেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সামনে।

শহুরে হুমায়ূন

আমার বহুবার পঠিত বই ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’। বইটা এক অর্থে তাঁর জীবনীগ্রন্থ। এই বই থেকেই জানা যায়, তাঁর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য এবং প্রবাসের অনেক অজানা কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে তাঁর জীবন ছিল মোটামুটি শহুরে। তাই তিনি গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে শহুরে জীবনের তুলনাটা করতে পেরেছেন। শহুরে জীবনের ঠুনকো মূল্যবোধ, মুখোশের আড়ালে ঢাকা মেকি সভ্যতা সবই এসেছে তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রে। তিনিই প্রথম শহরের উঁচুতলার মানুষের সঙ্গে শহরের নিচুতলার মানুষের সংযোগ ঘটিয়েছিলেন। শহরের পাঁচতারা হোটেলের পেছনেই যে বস্তি আছে, সেটা তিনি বলেছেন বারবার। তাই শহরকে বুঝতে হলে শুধু পরিপাটি সুন্দর শহরকে দেখলে হবে না। প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতো দেখতে হবে শহরের গরিব মানুষদেরও। যারা শহরকে সচল করে রাখে।

প্রাত্যহিক হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি আসলে শিল্পের বিচারে উত্তীর্ণ হতে পারবে না—এমন একটা ভুল ধারণা অনেকেই করতেন। কিন্তু শিল্পের তো আসলে কোনো মানদণ্ড নেই। আর দেশে দেশে এই শিল্পবোধও ভিন্ন হয়। এক দেশের বুলি হয়ে যায় আরেক দেশের গালি। একসময় ঢাকার প্রকাশকেরা কলকাতার লেখকদের বই ছেপে নিজের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেন। হুমায়ূন আহমেদ সেই ধ্যানধারণার খোলনলচে বদলে দেন। আমাদের প্রাত্যহিক চলাফেরা, ওঠাবসা, কথাবার্তা, চালচলনও যে সাহিত্যের বিষয়বস্তু হতে পারে, সেটা তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর লেখার সঙ্গে বাংলাদেশের যেকোনো পাঠক খুব সহজেই নিজেকে যুক্ত করতে পারেন। এ কারণে তাঁর লেখাগুলো বহুল প্রচার পায়।

সিলেবাসের বাইরের হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখেছেন বলেই বিশ্বাস। তাই তাঁর লেখায় চলমান সফলতার মাপকাঠিতে সফল মানুষ যেমন উঠে এসেছেন, তেমনি উঠে এসেছেন বিফল মানুষও। তিনি প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমাদের জীবন ও সমাজকে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাই ঘটনার বিবরণ পড়তে গিয়ে মনে হয়, এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। তিনি একাধারে ধীরস্থির মিসির আলীকে যেমন ধারণ করতেন, তেমনি অস্থিরমতি হিমুও ছিল তাঁর প্রিয়পাত্র। তিনি হিমুর মাধ্যমে সিলেবাসের বাইরে গিয়ে জীবনকে দেখার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। হিমুর গল্পগুলো পড়তে গেলে মনে হয়, জীবন তো এমনও হতে পারে বা পারত। জীবনের বস্তুগত বিষয়গুলো এড়িয়ে মানবিক বিষয়গুলোকে আপন করে নেওয়ার মধ্যেই তো জীবনের সার্থকতা। তাই যুগ যুগ ধরে হিমু আমাদের মনে জায়গা করে নেবে বলেই বিশ্বাস করি।

প্রেমের নতুন সংজ্ঞা

হুমায়ূন আহমেদ প্রেমকে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন লেখায়। অনেক ক্ষুদ্র কারণে আমাদের মনে প্রেম বা ভালোবাসা জাগ্রত হতে পারে। আবার সেই প্রেম সব সময় যে মানব–মানবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা নয়। সেটা হতে পারে প্রকৃতির প্রতি, আশপাশের দৈনন্দিন বস্তুর প্রতি, এমনকি ড্রেনের পানিতে যে দুর্গন্ধ আছে, সেটাও আমাদের প্রেমের বিষয়বস্তু হতে পারে। পেট্রলের পোড়া গন্ধও অনেক সময় ভালো লাগে। এমন সব অতিক্ষুদ্র অথচ অপরিহার্য বিষয়কে তিনি তুলে এনেছেন লেখায়। একজন মেয়ের শুধু থুথু ফেলার ধরন দেখেও তার প্রেমে পড়া যেতে পারে। একজন ছেলের গায়ের অপরিষ্কার কটকটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি দেখেও তার প্রেমে পড়া যায়। তিনি আমাদের চলতি প্রেমের সংজ্ঞাটাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আমরা এখন নিজের অজান্তেই এসব বিষয়ের প্রেমে পড়ে যাই।

প্রকৃতিপ্রেমী হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদের প্রকৃতিপ্রেম নিয়ে আলাদা করে বলা দরকার। প্রকৃতির মধ্যে নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য নির্মাণ করেছিলেন ‘নুহাশপল্লী’। বৃষ্টির শব্দ শুনবেন বলে বানিয়েছিলেন ‘বৃষ্টিবিলাস’ ঘর। পুকুরের পানিতে নামবেন বলে তৈরি করেছিলেন ‘দিঘি লীলাবতী’। আর গাছের প্রতি মমতা থেকে লাগিয়েছিলেন হরেক রকমের গাছ। নুহাশপল্লীতে একটা বাগানজুড়ে শুধু আছে ঔষধি গাছপালা, যার নাম ‘রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান’। গতবার দেশে গিয়ে সেই বাগানের রক্ষণাবেক্ষকের সঙ্গে গল্প হয়েছে। তিনি বলেন, মানুষ যখন যায়, তখন অনেক কিছুই সঙ্গে নিয়ে যায়। স্যার মারা যাওয়ার পর অনেক গাছকে তাঁরা হাজার চেষ্টা করেও আর বাঁচাতে পারেননি। বাগানে আগে অনেক গাছ ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। এসব গাছের মধ্যে আছে একটা বাঁশের মাচা। তার ওপর কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে শরীর-মন দুটোই নিমেষে শীতল হয়ে যাবে।

রসিক হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদের রসিকতা করার প্রবণতা ছিল স্বভাবজাত। লেখায়, নাটকে, চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে বাস্তব জীবনের সবখানেই এই ছাপ স্পষ্ট। জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি হাস্যরস করেননি। জীবনের চরম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও তিনি রসিকতা করতেন। রসিকতা করতে পারা একটা বিরল গুণ, সবাই এটা পারে না। আবার অনেকেই পারলেও সেটা ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু তিনি সেটা পেরেছিলেন। একসময় ‘উন্মাদ’ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন ‘এলেবেলে’ নামে। এরপর ‘বলপয়েন্ট’ ও ‘কাঠপেন্সিল’ বইতেও সেই স্বাক্ষর রেখেছেন বেশ কিছু লেখায়। বাস্তব জীবনে রসিকতা করার চেয়ে সেটাকে লিখে প্রকাশ করা অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের লেখাগুলো পড়লে যে–কেউই ধরতে পারেন, তিনি রসিকতা করছেন। তবে এসব রসিকতার মধ্যেও অনেক বার্তা দিতেন। আমাদের দুর্বলতা হলো, আমরা শুধু হাস্যরসটাই ধরতে পারতাম, মূল বার্তা বুঝতে পারিনি।

প্রতিবাদী হুমায়ূন

বাংলাদেশের শহুরে মানুষদের মধ্যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ঘটনা বিরল। অল্প কিছু মানুষ প্রতিবাদ করেন। তাঁরা তখন অন্যদের বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। ব্যাপারটা এমন, প্রতিবাদ করলেই যেন আপনি আর ভদ্রসমাজের অন্তর্ভুক্ত থাকলেন না। ঠিক একই অবস্থা লেখক সমাজেও। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ একেবারে প্রতিকূল সময়ে টিয়াপাখির মুখ দিয়ে ‘তুই রাজাকার’ বলিয়ে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের কালো দিকটার দিকে আলোকপাত করেছিলেন। ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’র দাদার মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি খুব বড় একটা অন্যায় করেছিলাম। সেই অন্যায়ের জন্য মহান আল্লাহ পাকের কাছে, দেশের মানুষের কাছে, আপনাদের সকলের কাছে ক্ষমা চাই। হাতজোড় করে ক্ষমা চাই।’ এ ছাড়া তিনি দরকার হলে সম্মুখ সমরে রাস্তায়ও নেমে আসতেন প্রতিবাদ জানাতে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণ নিয়ে অনশন–ধর্মঘট করে সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন নন্দিত এই লেখক।

মুক্তিযুদ্ধ এবং হুমায়ূন আহমেদ

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় এবং গর্বের অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। পাকিস্তানিদের অত্যাচার পৃথিবীব্যাপী সংগঠিত সব যুদ্ধের বীভৎসতা, নৃশংসতা ও ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন ৩০ লাখ মানুষ, সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন হাজারো মা-বোন। হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিলেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন সব কাজ করেছেন, যেগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে থাকবে। ‘আগুনের পরশমণি’ চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক অমর সৃষ্টি। তরুণ প্রজন্ম নিজের জীবন বাজি রেখে যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। তাঁদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল অন্ধকার রাতের শেষে স্বাধীনতার সূর্যোদয়। এই চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে মূল চরিত্র বদির হাত বাড়িয়ে সূর্যের আলো ছুঁয়ে দেখার দৃশ্যটা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে। আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর উপন্যাস ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ বইটা বাংলাভাষী যেকোনো পাঠককে আবহমানকাল ধরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ধারণা দিয়ে যাবে।

জীবনের পরতে পরতে হুমায়ূন

আমাদের শহর কিংবা গ্রামের, গরিব কিংবা ধনীর, প্রভু কিংবা চাকরের প্রাত্যহিক জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। এখনো আমরা তাঁর সাহিত্য পড়ি এবং নিজেদের সমৃদ্ধ করি। তাঁর তৈরি নাটক ও চলচ্চিত্র দেখি সপরিবার। জীবনের কঠিন সময়ে তাঁর রসিকতায় আশ্রয় নিই। আর শহুরে জীবনে দমবন্ধ হয়ে এলে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য চলে যাই নুহাশপল্লীতে। তাঁর গল্প–উপন্যাস পড়া যায় সহজেই, কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই। তাঁর নাটক ও চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়ন এবং ভাষাচয়ন ভেঙে দেয় শহর ও গ্রাম এবং ধনী ও গরিবের ব্যবধান। দেশে ও প্রবাসে এখনো হুমায়ূন আহমেদ এক কিংবদন্তির নাম।
প্রবাসের এই যান্ত্রিক জীবনে যেখানে সবাই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে। সেখানেও আমরা সময় পেলেই তাঁর গল্প–উপন্যাস পড়ি। আরেকটু বেশি অবসর পেলে সপরিবার বসে পড়ি তাঁর তৈরি নাটক ও সিনেমা দেখতে। আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান জাতি যে আমাদের একজন হুমায়ূন আহমেদ আছেন। বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, হুমায়ূন আহমেদকে আমরা তত দিন হৃদয়ে ধারণ করব।