অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রে মানবিকতার স্পন্দন

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে ১৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুতে শহরটি যেন একসঙ্গে জেগে উঠেছেছবি: লেখকের পাঠানো

বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হংকং। ব্যাংকিং, ট্রেডিং আর অর্থ, শহরটির নাম শুনলেই অনেকের মনে যেন এই চিত্রই ভেসে ওঠে। এখানে মানুষকে প্রায়ই রোবটের মতো মনে হয়, নিজের কাজটাই আসল, চারপাশে কী ঘটছে, তাতে যেন কোনো আগ্রহ নেই। রাস্তায় দ্রুত হাঁটা, গণপরিবহনে হেডফোনে ডুবে থাকা, লিফটে উঠেই দরজা বন্ধ করতে ব্যস্ত হওয়া কিংবা বাসে পাশের সিটে ব্যাগ রেখে অন্যকে বসতে না দেওয়া, এসবই যেন হংকংবাসীর দৈনন্দিন অভ্যাস। নতুন আগন্তুকদের প্রশ্ন জাগে: এরা এমন কেন?

কিন্তু এই শহরেই আবার দেখা যায় ভিন্ন এক চিত্র। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে যদি কারও ব্যাগের চেইন খোলা থাকে, অপরিচিত কেউ সতর্ক করে দেয়। কাঁচাবাজারে বিপাকে পড়লে কেউ এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। দরজায় পৌঁছালে কেউ ধরে রাখে, যাতে সহজে প্রবেশ করা যায়। এমনকি অচেনা বৃদ্ধও শিশুকে শীতের কাপড় ভালোভাবে পরতে মনে করিয়ে দেয়। এই বৈপরীত্যই হংকংকে আলাদা করে তোলে।

সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে ১৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুতে শহরটি যেন একসঙ্গে জেগে উঠেছে। কে কোথা থেকে এসেছে, কত বছর ধরে এখানে আছে, তা কোনো ব্যাপার নয়। সবাই ছুটে গেছে দুর্যোগের এলাকায় সাহায্য নিয়ে। সরকারি তহবিলে জমা হয়েছে দেড় বিলিয়নের বেশি হংকং ডলার। ট্যাক্সি চালকেরা বিনা ভাড়ায় মানুষকে পৌঁছে দিয়েছেন। সাত দিন পরেও মানুষ ফুল আর মোমবাতি নিয়ে শোক প্রকাশ করেছে। গির্জায় নিহত ফিলিপিনো হেল্পারদের জন্য প্রার্থনা হয়েছে, মসজিদে ইন্দোনেশিয়ানদের জন্য দোয়া পড়া হয়েছে।

এমন মানবিকতার উদাহরণ হংকংয়ে নতুন নয়। ঝড়ঝাপটা শহরটি কম দেখেনি, কিন্তু প্রতিবারই মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়েছে। এখানে সবাই নিজের মতো থাকতে পারে, ধর্ম, বিশ্বাস বা ভাষা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। দক্ষতা থাকলে সবাইকে সমানভাবে স্বাগত জানানো হয়। অন্য অনেক দেশে বাইরে থেকে আসা মানুষকে অবজ্ঞা করা হলেও হংকংয়ে তা নেই। তাই যেকোনো বিপদে সবাই একসঙ্গে ব্যথিত হয়।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকারি তহবিলে জমা হয়েছে দেড় বিলিয়নের বেশি হংকং ডলার
ছবি: লেখকের পাঠানো

এবারের এই অগ্নিকাণ্ডের কারণও স্পষ্ট। যুগের পর যুগ ধরে bamboo scaffolding দিয়েই হংকংয়ের আকাশচুম্বী ভবনগুলো তৈরি হয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত কার্যকরী ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি। কাজেই অগ্নিকাণ্ডের জন্য এই পদ্ধতিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু ৪০ বছরের পুরোনো এই আবাসিক ভবনটির ক্ষেত্রে এর চারপাশে যে জাল ও স্টাইরোফোম ব্যবহৃত হয়েছিল, সেটা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে। নিয়মিত পরিদর্শন করা হলেও কোনো কারণে তা আগে ধরা পড়েনি। তদুপরি ভবনের অগ্নি-সতর্কতা সংকেত যন্ত্র কাজ না করায় মানুষ সময়মতো বুঝতেই পারেনি। এমন ব্যর্থতা হংকংয়ের মতো শহরে অগ্রহণযোগ্য। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং নিরপেক্ষ তদন্ত করা সরকারের দায়িত্ব।

তবে এই দুর্ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কিছু মহল চীনকে আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। এটি নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা নয়, বরং একধরনের রাজনৈতিক সুযোগসন্ধান। হংকংয়ের সমস্যার দায়ভার হংকংকেই নিতে হবে এবং সমাধানও এখানেই খুঁজে বের করতে হবে।

পরিশেষে প্রতিটি দুর্ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিবার, আপনজন, মানবিকতা, একে অপরের প্রয়োজনে হাত বাড়িয়ে দেওয়া, মানবজীবনে এর চেয়ে বড় কিছু নেই। এই ভালোবাসা ও মানবিকতাকেই পুঁজি করে হংকং আবারও শোক কাটিয়ে উঠবে।

*লেখক: মুনিরা রহমান, হংকং