আনুভূমিক রং ও রেখা

চৈত্রের শেষ দিনে বাতাসে উত্তাপ, আর্দ্রতা। তবু মনে পড়ে কত কথা।

একদিন ১৯৬১ সালে সৃষ্টিশীল যূথবদ্ধতায় আত্মপরিচিতি ও দায়বদ্ধতার মানসিকতা সৃষ্টির প্রয়াসে প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট থেকে ১৯৬৭ তে আইয়ুবের সামরিক শাসনের চরম প্রতিকূলতার সময়টায় রমনা বটমূলে হয় প্রথম বাংলা নবর্ষের আবাহন।

রমনার অশ্বত্থতলায় লালপেড়ে গরদে আর খাদির পাঞ্জাবিতে সূর্যোদয়ে সুরের ও কথার আলাপনে। আমাদের সংকল্প ছিল, ছিল না দৃশ্যমান যুদ্ধের পোশাক। সন্‌জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, কলিম শরাফী, জাহেদুর রহিম, জামিল চৌধুরী, অজিত কুমার তাই ব্যবহার করেছেন। সংস্কৃতির সূক্ষ্ম ও নরম যন্ত্রে অস্ত্রোপচার করে সফলভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই তখন থেকে এখনো আমাদের যেকোনো আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এটাই ধারা।

আমার ৬১–এর কথা মনে নেই। ৬৭–এর কথা মনে আছে। জামালপুরে, সারা শহর ঘুরে মেয়েদের লালপাড় পাওয়া যায়নি, যা ছিল মা–খালা–মাসির, তাই পরে তারা খোঁপায় গুঁজেছিলেন জবা। বাবার হাত ধরে মঞ্চে উঠে কোরাস গেয়েছিলাম, কাজী নজরুল ইসলামের ‘দারিদ্র্য’ আবৃত্তি করেছিলাম ছোট্ট শহর জলিষ্ণু জামালপুরে।

আইয়ুবের বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে তত দিনে আমি টাঙ্গাইল কুমুদিনী কলেজে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রীবাসের নিয়ম ভেঙে টাঙ্গাইলের শহীদ মিনারে বক্তৃতা দিয়ে মিছিলে একাকার হয়ে যাই। আমি ও রহিমা সিদ্দিকী ক্লাসের খাতা দিয়ে চোঙা বানিয়ে মিছিলের ধ্বনিকে প্রতিধ্বনি করে কলেজে ফিরে আসি। কালোপাড় শাড়িতে ম্লান মুখে অবাঙালি কলেজপ্রধান দ্বারা তিরস্কৃত ও হোস্টেলচ্যুত হয়ে নারায়ণগঞ্জে আমাদের বাসায় ফিরে আসি। পরীক্ষার জন্য কেবল ফিরে আসার অনুমতি থাকল। এখন তাহলে পড়াশোনাটা চলবে কী করে!

তোলারাম মহিলা কলেজে আব্বার বন্ধু করুণাময় বিশ্বাস ও তাঁর স্নেহভাজন রাশিদুল হক শিক্ষকতা করতেন। তাঁদের অনুরোধ করে আব্বারই বন্ধু হায়দার চাচার কন্যা মুকুলের সঙ্গে কলেজের ক্লাসে বসার সুযোগ হলো। কিন্তু এ সেই আন্দোলনের ৬৯। সব ছাত্রছাত্রী তখন রাস্তায়, মিছিলে মিছিলে একাকার, আমি কি আর ঘরে থাকি। বালুর মাঠের পাশের কায়দে আজম রোড কেঁপে কেঁপে উঠল আমাদের উচ্চারণে। বাধ্য হয়ে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল।

মুক্তিযুদ্ধের পর সাদা–কালো হয়ে গেল ফেব্রুয়ারির কালার কোড। পয়লা বৈশাখে নববর্ষের জন্য হলো লাল–সাদা সুস্থির। শুরু হলো দিকে দিকে প্রথম বৈশাখ, দিনে লালপাড় গরদ থেকে টাঙ্গাইল সাদা শাড়ি লালপাড় ও চুলে বেল কুঁড়ি নিয়ে মঞ্চে গান, আবৃত্তি। জনতার সারিতেও লাল ছড়াতে লাগল। আমাদের তরুণ ভাবনাগুলো গড়ার পথে রমনা বটমূলে সন্‌জীদা খাতুন, ফাহমিদা আপার সুরে, গোলাম মোস্তফার আবৃত্তিতে, নওয়াজেশ আলীর স্ন্যাপশটে—সংবাদপত্রের সংবাদে সব এক ধারায় মিলে যেতে লাগল।

মনে পড়ে ৭২–৭৩–এর কথা। জামি দেশে এসেছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কাছ থেকে আমাদের গল্প শুনে শুনে সেলিনা, তৌহিদা, কবিতা…আমাদের সবার জন্য উপহার কিনেছে। আমি শাড়ির প্যাকেট খুলে এলিফ্যান্ট রোডের কণিকায় আনন্দে খলখলিয়ে বলে উঠেছিলাম এ টাঙ্গাইলই পয়লা বৈশাখে পরব। ছায়ানটের আয়োজনে রমনায়, ঈশিতার হাতে বেলুন ধরিয়ে চুলে ফুল পরে যখন ঘুরছিলাম, দেখি বিটিভির ক্যামেরাম্যানসহ তরুণ প্রযোজক বন্ধু বেলাল, মানে আল মনসুর নিউজ আইটেম তৈরি করছে। তার পক্ষপাতিত্বে আমরা তিনজন হয়ে গেলাম বন্দী। রাতে নববর্ষ উদ্‌যাপনের সংবাদে দেখা গেল আমার টাঙ্গাইল শাড়িকুটিরের জামির দেওয়া শাড়ির পাশে ঠেলাগাড়ির পান্তা–ইলিশ। তখন নববর্ষ উদ্‌যাপনে ছায়ানটের আয়োজনে যোগ দিতে রমনা পার্কের বাইরেই গাড়ি পার্ক করা যেত। তখন ড্রাইভার ছাড়া একলা গাড়ি রাখা যেত। তখন ওই ছোট সাইড গেট দিয়ে অন্যের জামাকাপড়ে ঘষাঘষি না করেই ভেতরে প্রবেশ করা যেত। ঝিলের পাড়ের ক্যাফেতে বসে গান শুনে শুনে চা খাওয়া যেত। তখন মঞ্চে লালপাড় গরদ পরা হতো।

৭৮–৭৯ তে আমরা সাপ্তাহিক বিচিত্রা থেকে সেদিনকে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য করলাম নানা ধারণাযোগ। শাহাদত ভাই শুরু করলেন ডাকে বই উপহার পাঠানো। আমার লেখালেখিতে লাল-সাদা শাড়ি টিপ আর ভর্তা, ডাল–ভাত, মুড়িমুড়কি হয়ে উঠল সেখানে চরম প্রতিপাদ্য।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

আসলে বৈশাখ থেকে, চৈত্রসংক্রান্তি ও ফাল্গুনের হলুদ জেগে উঠেছিল। কিন্তু আজ মনে হয় অর্জনের আনন্দে আমরা, কিছু মৌলিক চাষ এড়িয়ে গিয়েছিলাম সব স্তরে। তাই ২০২৫–এ বাংলা ১৪৩২–এর প্রাক্বালে দেখি তা বিস্তৃত হয়েছে সারা দেশের পাড়ায় পাড়ায়, পার্কে পার্কে। জনসংস্কৃতি মানুষকে মুক্ত করে, বন্দী করে না। চাপিয়ে দেওয়া কিছুই নাগরিকেরা নেয় না। এবার আরও ব্যাপকভাবে হচ্ছে নানা আলপনায় ইঙ্গিতময়তায়। রঙের প্রবহমানতায়, রেখায় রেখায়, সুরে সুরে বারতায়। কারণ, রেখা দাঁড়িয়ে গেলেও তা আবার বদল হয় রাষ্ট্র ও রাজনীতির ক্ষমতালিপ্সায়। বদল হয় নানাভাবে অর্থায়নের আকাঙ্ক্ষায়। বদলায় বাণিজ্যের কারণেও। তখন এই বাণিজ্যিকীকরণ কৃষ্টির ওপর থাবা দেয়। যে দেশে শৈশব থেকে বিদ্যাশিক্ষার নামে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাধারীর ইচ্ছা–অনিচ্ছায় ইতিহাসকে ফিকশন বানাতে পারে, তাদের সংকট অনেক। আমরা সেই সংকটাপন্ন জাতি।

আমরা মনে রাখতে পারি না। রূপেরও অক্ষর আছে, শব্দ আছে, ঘ্রাণ আছে। আমরা তার ওপর হাঁটি। তার নির্মাণ সময় ও ইতিহাস সব মিলিয়েই। এভাবেই বস্তু বা অবস্তুর দ্যোতনা। আর সময়ে যদি সেই সূত্র টেকে তবে তাই হয়ে দাঁড়ায় ছাপ বা ব্র্যান্ডিং। দেশ দাঁড়ায় দৃঢ়।

আমাদের দেশের বাঙালি বিশ্বের অন্যান্য বাঙলির চেয়ে ভিন্ন। আমাদের দেশে কিছু তারিখ, কিছু নাম, কিছু রং ছাপ হয়ে গেছে। এই যে এখন বৈশাখে লাল–সাদা, বিজয় ও স্বাধীনতা দিবসে লাল–সবুজ, নারী দিবসে লাইলাক। পুনরাবৃত্তিতেই এর পুনর্নির্মাণ। তবে ভিড়ের একজন না হওয়ার কথা ভেবে আপনি অন্য কিছু পরতেই পারেন। তাতে কারও কিছু হয় না। ক্ষতি হয় নিজের। যেকোনো মহতী যুদ্ধ ও ব্যাপক আয়োজনের নিমিত্ত বুঝে নিজেকে মিলিয়ে নেওয়াটাই কথা।

এ বছর রমনার সেই অশ্বত্থ বিস্তৃত হয়ে শাখা প্রবেশ করেছে সারা দেশের অলিগলিতে, ঘরে ঘরে রান্না হচ্ছে মিষ্টান্ন, মাছ–ভাত–ভর্তা, অলিগলিতে গানের, পার্কে শিশুদের খেলা। আজ পুরো দেশ ছেয়ে গেছে। লাল-সাদা, সবুজ-লাল, সাদা-কালোতেই আমাদের আছে আমাদের অনুভূমিক সংস্কৃতি-অভিজ্ঞান সেই অনুপান।

এসেছে নতুন বছর। উড়ে যাক আমাদের সাবটোপিয়ানিজম, সব কূপমণ্ডূকতা।

শুভ নববর্ষ