সিঙ্গাপুরের আবাসন বনাম ঢাকার আবাসন
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
১৯৬০ সাল থেকে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি আবাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেখানে ৭৭ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ এইচডিবি (হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ড) ফ্ল্যাটে বসবাস করে (স্মার্টওয়েলথ)। দেশটিতে ৯০ শতাংশের ওপর ব্যক্তির নিজস্ব বাড়ির মালিকানা আছে, যেটি সম্ভব হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি সাশ্রয়ী বন্ধক–ব্যবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালিত জমি ইজারা এবং আবাসনের জন্য বাধ্যতামূলক ভবিষ্য তহবিলের কারণে। ২০২৪ সালে ২৮ হাজার ৯৮৬ এইচডিবির পুনর্বিক্রয়যোগ্য ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে, যেটি আগের বছরের ২৬ হাজার ৭৩৫-এর থেকে বেশি। এটি একটি স্থিতিশীল ও উচ্চ কার্যকরী আবাসনের বাজারের নির্দেশ করে (দ্য বিজনেস টাইমস)। অপরদিকে, ঢাকায় বর্তমানে ২ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করছে এবং ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ এটি আড়াই কোটিতে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্রাম থেকে শহরে দ্রুত অভিবাসী আগমন, অপরিকল্পিত বসতি বৃদ্ধি ও ধারণক্ষমতার বাইরে বিস্তৃত অবকাঠামোর সঙ্গে লড়াই করছে পুরো শহরটি।
সিঙ্গাপুরের আবাসন সাফল্য মূলত তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে—জনগণের ভূমি ওপর মালিকানা, কেন্দ্রীকৃত পরিকল্পনা ও রাষ্ট্র প্রদত্ত অর্থায়ন। এইচডিবি ৯৯ বছরের মেয়াদে জমি বন্ধক দেয়, স্তরকৃত ভর্তুকি বণ্টন করে ও পুনর্বিক্রয় বিধিমালার মাধ্যমে অনুমাননির্ভরতা বন্ধ করে। সর্বসাধারণের আবাসন উন্নয়নে উচ্চমানের অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা ও যাতায়াতের মাধ্যম সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পনা করা হয়, যেমন একটি এইচডিবি সাইটের অধীন নতুন চালু হওয়া উডলে ভূগর্ভস্থ বাস চলাচল, যা পরিবহনব্যবস্থা এবং আবাসনকে ঝমেলামুক্ত করেছে। সিঙ্গাপুর চিন্তাভাবনা করে তার সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখছে। ২০২৫ সালে পরিণত ও নতুন শহরগুলোতে ১৯ হাজার ৬০০টি বিটিও ফ্ল্যাট মুক্তির জন্য নির্ধারিত হয়েছে। অপরদিকে দেশটির গৃহ উন্নয়ন কর্মসূচি পুরোনো ভবনগুলোকে বজায় রেখে আপগ্রেড করবে। ২০২৪ সালে ৫৩ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট সংস্কার করার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যার জন্য ৭৪২ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরিয়ান ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে (ohmyhome)।
ঢাকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। শহরটিতে প্রতিবছর নতুন প্রায় ৫ লাখ মানুষ নতুন করে আসে, যার জন্য প্রয়োজন ১ লাখ ২০ হাজার বাড়ি নির্মাণ করা, যার মধ্যে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নির্মাণ করা হয়, ফলে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষদের বস্তিকে বেছে নিতে হয়। জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ অবৈধভাবে বস্তিতে বাস করে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৫০ শতাংশের বেশি নগরবাসী বস্তিতে বাস করে এবং ঢাকায় হাজার হাজার বস্তি রয়েছে ( সায়েন্স ডিরেক্ট)। বস্তিবাসীদের অতিরিক্ত জনবসতি, বন্যা, রোগব্যাধি এবং অবৈধ ভূমি ও অধিকার না থাকার কারণে কঠোর জীবনযাপনের সম্মুখীন হতে হয়।
এ সংকট প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা, ভূমি জল্পনা এবং খণ্ডিত শাসনব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত। সিঙ্গাপুর তাদের মডেল একটি উদ্দেশ্য-নির্মিত সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করে, যা ভূমি অধিগ্রহণ, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের পরিকল্পনা এবং সমগ্র ক্ষেত্রটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। ঢাকার সমতুল্য প্রতিষ্ঠান রাজউকের স্বায়ত্তশাসন, সমন্বয় এবং সম্পদের অভাব রয়েছে। পূর্বাচলের মতো প্রকল্প বছরের পর বছর ধরে অসম্পূর্ণ থাকে। ভূমি বরাদ্দ করতে রয়েছে অস্বচ্ছতা এবং সমাজের উচ্চশ্রেণিদের সঙ্গে যুক্ত ডেভেলপাররা অসদুপায়ে প্রধান প্লটগুলো দখল করে। কৃষিজমি ও সরকারি জমি রাজস্বের জন্য বিক্রি করা হয় নাগরিকদের আবাসনের জন্য সংরক্ষিত না রেখে। সিঙ্গাপুরের সমন্বিত পরিকল্পনার বিপরীতে ঢাকা উন্নয়নকে দেখে সুযোগসন্ধানীভাবে। এখানে উচ্চবিত্তের আবাসন ও বিলাসবহুল টাওয়ারের অনুমোদন দেওয়া হয়, অথচ সামাজিক বাসস্থান ও টেকসই উন্নয়ন উপেক্ষিত থাকে।
এ রকম ভিন্ন আবাসনব্যবস্থার পেছনে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ঢাকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর আমূল পার্থক্যকে কারণ হিসেবে অভিহিত করা যায়। সিঙ্গাপুরের টেকনোক্র্যাটিক শাসনব্যবস্থা আবাসনকে জাতীয় উন্নতির ভিত্তি হিসেবে দেখে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যৌথ সঞ্চয় (সিপিএফের মাধ্যমে) এবং সরকারি মালিকানাধীন জমি সিঙ্গাপুরকে দামের নিয়ন্ত্রণ, জল্পনামূলক পুনর্বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ এ সামাজিক শ্রেণিগুলোর মধ্যে ন্যায়সংগতভাবে আবাসন বিতরণের ক্ষমতা দেয়।
অন্যদিকে ঢাকা পরিচালিত হয় বিভিন্ন পৌর প্রশাসন, জাতীয় দপ্তর ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর একধরনের জটিল কাঠামোর মাধ্যমে, যার কোনোটিই একটি ঐক্যবদ্ধ আবাসন পরিকল্পনার দায়িত্বে নেই। ২০০১ সালে গঠিত জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ অল্প কিছু নিম্ন আয়ের আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, কিন্তু এটি সিঙ্গাপুরের এইচডিবির মতো এত ব্যাপক নয় এবং সেই সঙ্গে জমি সংস্থান, বা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারীও এটি নয়। তবু পরিবর্তন সম্ভব যদি সিঙ্গাপুরের নীতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ঢাকা তার নিজ বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।
প্রথমত, ঢাকায় একটি আইনি আবাসন কর্তৃপক্ষ গঠন প্রয়োজন, যা রাজউকের পরিকল্পনাগত ভূমিকা ও এনএইচএ-এর সামাজিক উদ্দেশ্যকে একত্র করবে এবং যাকে জমি অধিগ্রহণ, নতুন নগর উন্নয়ন এবং আবাসন নির্মাণে অর্থায়নের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হবে।
দ্বিতীয়ত, লিজহোল্ড পদ্ধতি ও জমিমূল্য আহরণ কাঠামো (যেমন—ডেভেলপমেন্ট চার্জ ও কমিউনিটি ল্যান্ড ট্রাস্ট) রাজস্ব সংগ্রহের পাশাপাশি আবাসনের মূল্য নাগালের মধ্যে রাখতে সহায়তা করতে পারে।
তৃতীয়ত, ঢাকায় পরীক্ষামূলকভাবে মিশ্র-আয়ভিত্তিক ও পরিবহন-সংযুক্ত কমিউনিটি গড়ে তোলা উচিত, সিঙ্গাপুরের শহরগুলোর মতো, যেখানে আবাসনের পাশাপাশি স্কুল, ক্লিনিক, পরিবহনব্যবস্থা ও সবুজ খোলা স্থান একত্রে পরিকল্পিত হয়, এই ধাপগুলো তো কেবল কল্পনা নয়, বরং সিঙ্গাপুরের সমন্বিত আবাসন প্রকল্পগুলোয় সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়িত।
চতুর্থত, ঢাকা বেসরকারি সংস্থা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে যৌথভাবে গঠিত কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন বস্তি উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ২ হাজারের বেশি এনজিও ধাপে ধাপে আবাসন, স্যানিটেশন ও শিক্ষায় সহায়তা করছে। এই প্রচেষ্টাগুলোকে শহর পরিকল্পনার অংশ করে বরং বস্তিগুলোকে নিশ্চিহ্ন না করে এর অন্তর্ভুক্ত করা উচিত (arxiv)।
পঞ্চমত, সরকারকে একটি আবাসন অর্থায়ন শিকল গঠন করতে হবে, যা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বন্ধক সহজলভ্য করবে। সিঙ্গাপুরের বাধ্যতামূলক সঞ্চয়পদ্ধতি (সিপিএফ) একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে এটি বাংলাদেশের আর্থিক ও সামাজিক কাঠামোর থেকে ভিন্ন।
ঢাকার নতুন আবাসন কাঠামোটি হতে হবে জলবায়ু-সচেতন। উচ্চ পরিষেবা নিশ্চিত করে জমিতে করতে হবে সরকারি আবাসন নির্মাণ এবং সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক নিষ্কাশনের ব্যবস্থার সংযুক্তি। এগুলো হবে ঢাকার মধ্যমমেয়াদি ভবিষ্যতের লক্ষ্যের দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ, যা জলবায়ুগত ঝুঁকি ও অসমতা একসঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে। পাশাপাশি বড় গণপরিবহন ও দালানের আশেপাশে পরিবহনকেন্দ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দূরবর্তী জায়গাগুলোতে উন্নত অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব, যা কেন্দ্রীয় ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমিয়ে নতুন বাসযোগ্য নগরকেন্দ্র সৃষ্টি করতে পারবে।
ঢাকার আবাসনের এ সংকট মূলত অপব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, দক্ষ বেসরকারি সংস্থা ও প্রাণবন্ত নাগরিক শক্তি। শুধু যা নেই তা হলো স্পষ্ট কিছু নীতির এবং তা বাস্তবায়ন করা। সিঙ্গাপুরের উদাহরণ প্রমাণ করে যখন রাষ্ট্র আবাসনকে অবকাঠামো ও জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে, তখন আবাসনের মতো সংকটকেও দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পিতভাবে ও সাশ্রয়ী পদ্ধতিতে সমাধান করা সম্ভব। ঢাকা চাইলেই সেই পথ অনুসরণ করতে পারে শুধু বসবাসের জন্য একটি জায়গা নয় বরং মানসম্মত সুন্দর একটি জীবন নির্মাণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।
জমির যথাযথ ব্যবহার, সঠিক মূল্য নির্ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও সমন্বিত নগরনীতি গ্রহণ করলে ঢাকা তার জটিল আবাসন সমস্যাকে সমাধানে রূপান্তর করে একটি টেকসই নগরীতে পরিণত হতে পারে। নিষ্ক্রিয়তার মূল্য একসময়ে গিয়ে অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে বিবেচিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একসময়ে ঢাকাও এ রকম সিঙ্গাপুরের মতো হতে পারে, শুধু প্রয়োজন এখনই কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে তা রূপদানের।
*লেখক: শেখ আফনান বিরাহীম, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটিং সায়েন্স মাস্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত