ট্রাম্পের চোখে বিশ্ব; ট্রাম্পকে জয় করতে মরিয়া ভারত!

ট্রাম্পের চোখে বিশ্বে এখন শুধুই ‘আমেরিকা ফার্স্ট।’ অভিবাসন ও অর্থনীতিকে সামনে টেনে আমেরিকার মিত্রদের নিয়ে বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কাকে বৈশ্বিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চান ট্রাম্প। ট্রাম্পের ১০০ দিনের কার্যতালিকায় বৈশ্বিক এজেন্ডায় অন্তত দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে আগাম চিন্তাভাবনা নেই। তবু  ট্রাম্পকে ‘দ্রুত জয়’ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত কী চায়, তা এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।

ভারতীয় কর্মকর্তার ট্রাম্পের দুটি শীর্ষ অগ্রাধিকার অর্থনীতি ও অভিবাসন নিয়ে ভারত ছোট-বড় ছাড় দিতে প্রস্তুত। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তাঁর জন্য সামনের দিকে একটি আসন ছিল। সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিওর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ শেষে সংবাদ সম্মেলনে জয়শঙ্কর বলেছিলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে অবৈধ গতিশীলতা এবং অবৈধ অভিবাসনের বিরোধী। ভারত অবৈধভাবে বিদেশে বসবাসকারী তার নাগরিকদের ভারতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য “সর্বদা উন্মুক্ত” ছিল।’ ২০২২ সালের পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে অনথিভুক্ত অভিবাসীদের তৃতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী ‘ভারতীয়’। দ্বিতীয় এল-সালভেদর, প্রথম এশিয়ানরা—এর মধ্যে বেশি চায়নিজরা যুক্তরাষ্ট্রে ‘অনথিভুক্ত অভিবাসী’ হিসেবে বিবেচিত। এ ছাড়া ৩৪ হাজার চায়নিজ প্রত্যাখ্যাত অভিবাসী রয়েছে। এদিকে ভারতীয় অভিবাসীরা কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে পাড়ি জমাচ্ছেন এমন সময়ে; যখন ট্রাম্প কানাডার সীমান্ত লক না করলে ‘অটোয়ার’ বিরুদ্ধে শুল্কের হুমকি দিয়েছেন।

নন প্রফিট আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিল জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ অবৈধ লোকজন বসবাস করছেন। এ ব্যাপক অভিবাসন অভিযানে খরচ হবে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন। এ ব্যয়বহুল ব্যয় পোষাতে ফান্ড কংগ্রেসে পাঠানো হয়েছে।

আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ‘ট্রাম্প অনেক বৈশ্বিক দায়িত্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, যা সম্ভবত ট্রাম্পের জন্য কৌশলগত উদ্বেগের শীর্ষ অঞ্চল হবে না।’

ট্রাম্প নিয়মিত ভারতের সুরক্ষাবাদের নিন্দা করেছেন এবং আমেরিকান ব্র্যান্ডের ওপর ভারতের আরোপিত শুল্কের সমালোচনা করেছেন। তবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ব্যাপক বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছানোর আশা করেছিল, কিন্তু তা কখনোই ফলপ্রসূ হয়নি।

সম্প্রতি ট্রাম্প-মোদির ফোনালাপে একটি ন্যায্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের দিকে অগ্রসর হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন ট্রাম্প। মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, জ্বালানি আমদানি ও প্রত্যাবাসনে ট্রাম্পকে ভারতের ছোট ছাড়গুলো ‘একটি খোলা দরজায় ঠেলে দেওয়ার মতো’। এশিয়া গ্রুপের ভারতীয় অনুশীলনের চেয়ার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অশোক মালিক বলেন, ‘ভারতীয় প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব সংরক্ষণের জন্য যদি শুল্ক ছাড়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, ঠিক আছে, তাই হোক।’

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকারগুলোর একটি আভাস দিতে গিয়ে সম্প্রতি সাংবাদিকদের সেক্রেটারি অব স্টেট মার্কো রুবিও বলেন, এ জাতি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বিপজ্জনক কাছাকাছি সমকক্ষ প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করেছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, বেইজিংকে মোকাবিলা করাই হবে আগত প্রশাসনের মূল ফোকাস।

সম্প্রতি এক ভাষণে চীনের নেতা সি চিন পিং মার্কিন প্রেসিডেন্ট অভিষেক অনুষ্ঠানে চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের সমালোচনা করে বলেছিলেন, চীন-তাইওয়ান আবার মিলিত হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় ঝড়ের মোকাবিলা করে বড় হয়েছি এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শক্তিশালী হয়েছি।’ ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের চীনের অর্থনীতিবিদ ইয়্যু সু, বলেছেন, ট্রাম্পের বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতিগুলো চীনকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করার অনুমতি দিতে পারে। শুল্ক শুধু চীনা পণ্যের ওপর আরোপ করা হবে না, অন্যান্য দেশও। তিনি বলেন, চীনের জন্য একটি সুযোগ হতে চলেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা রোডিয়াম গ্রুপের সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে চীনের জিডিপি ২০২৪ সালে ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বাড়ানোর সুস্পষ্ট উপায় খুঁজে বের করেছে। চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, যা সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে আগ্রাসী চীনা সম্প্রসারণবাদের কাঠামো প্রদান করেছে। চীনের দ্বারা নির্মিত এবং অর্থায়নে আরব সাগর বন্দর গোয়াদারে উঁচু হিমালয় পেরিয়ে পাকিস্তানে হাইওয়ে নির্মাণের মতো এত নাটকীয় উদ্যোগ আর কোথাও নেই।

এদিকে ভারত তাদের যৌথ সীমান্তে চীনের সঙ্গে সমস্যায় পড়েছে। চীন ভারতের সঙ্গে সীমান্তে তিনটি গিরিখাতের চেয়ে বড় একটি বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করেছে, যা ব্যর্থ হলে ভারতে প্লাবিত হবে। সমুদ্রপথও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। বাঁধটি এশিয়ান এবং ভারতীয় প্লেট বরাবর নির্মিত হচ্ছে। যেখানে  প্রচুর ক্রিয়াকলাপ রয়েছে। নরেন্দ্র মোদি সে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে মিত্রদের খুঁজছেন। কারণ, এটি চীনের নতুন ফাঁদ। এদিকে ভারতীয় তদবিরের পরে, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আগে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ দিয়েছিল। ভারতীয় আধিকারিকরা দাবি করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র তার গণতন্ত্রপন্থী বক্তব্যকে কমিয়ে দেবে, যদি বিরোধীদের একটি উন্মুক্ত নির্বাচনে ক্ষমতা লাভের অনুমতি দেওয়া হয়। ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হবে। সে সময় ভারতীয় তদবিরের পরে, ওয়াশিংটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা কমিয়েছিল। এখন ভারতকে মোকাবিলা করতে হবে তারা বাংলাদেশকে ভুল ব্যবহার করেছে কি না। বর্তমানে প্রতিবেশী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ মিত্র, আগস্টে একটি জনপ্রিয় বিদ্রোহে ক্ষমতাচ্যুত হন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত বাংলাদেশে তার প্রভাব বজায় রাখতে চাইবে এবং ট্রাম্পকে পুরো অঞ্চলে তার নেতৃত্ব অনুসরণ করতে উৎসাহিত করবে।