ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একটি খোলা প্রশস্ত উঠান। সেখানে ঝলমলে সোনালি রোদ্দুর নিরন্তর আছড়ে পড়ছে। চারদিকে ঝিরঝিরে বাতাসে দোলায়মান প্রাণবন্ত সবুজ-শ্যামলিমা। ওপরে স্বচ্ছ নীল আকাশ। পাখিরা কিচিরমিচির কলকাকলিতে মাতিয়ে রেখেছে উঠানের উদাত্ত-প্রচ্ছদ! আহা কী প্রশান্তির সেই মোলায়েম দৃশ্য!

এ মুহূর্তে আমি এই প্রবাসে নিবিষ্ট হয়ে, ব্যাকুলচিত্ত নিয়ে আমারই বাড়ির উঠানটি দেখছি আমার সামনে। দেখছি, সত্যই আমি ফিরে গিয়েছি আমার একান্ত নিজের আঙিনায়! দেখছি, আমার উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি। আর কণ্ঠ ছেড়ে প্রাণের সব ব্যাকুলতা ঝেড়ে উদাত্ত সুরে গান গাইছি, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী...!’

আমি বরাবরই আমার গ্রাম, এলাকা সর্বোপরি আমার দেশটিকে একটি খোলা প্রশস্ত উঠানের অবয়বে দেখেই অনাবিল স্বপ্ন রচনা করি। আমার সেই নিরবচ্ছিন্ন স্বপ্নের বুননে থাকে অনেক বিচিত্র রঙের কী দীপ্তিমান ছড়াছড়ি! আছে সঙ্গে, তার আবহে মোহনীয় সুরের মূর্ছনা। স্বপ্নের আবাহনে সেই ছবিটা হয় বড়ই জীবন্ত!

একেবারে তৃতীয় নয়নে উপলব্ধি করার মতো। আর ইন্দ্রিয়ের সর্বোত্তম কাঠামোয় বাঁধিয়ে রাখার মতোই। কিন্তু হায়! আমার সাধ্য আর সেই স্বপ্নিল উঠানের কাছাকাছি বাস্তবতায় নিয়ে যেতে পারে না এই আমাকে! আমি এখন পরবাসী! স্বপ্নবিলাসী পরিযায়ী পাখির মতো উড়ে এসে অভিবাসনের খাঁচায় নিজেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছি। তাই স্বপ্নটি আমার পরিপূর্ণতা পাওয়ার আগেই মাঝপথে ভেঙে যায়। একেবারেই চুরমার হয়ে যায়! আর সঙ্গে সঙ্গে আমি থমকে যাই! আহা! কী কষ্ট! কী যাতনা!

এমনও হতে পারত, এখানে এখন অবস্থান করে আমি যেমন আমার সমাজকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে ভাবি, ইচ্ছে করলেই সেই সমাজ ও দেশকে আমূল পাল্টে দিতে পারি। কিন্তু না। এমনটি হয় না! এখানেই আমি দুর্বল। যদিও আমি জানি, মানুষ তার স্বপ্নের সমান উচ্চতায় অবস্থান করে। আমিও তাই করি। তারপরও আমি আমার স্বপ্নকে সামনে রেখে সব দৃশ্যমান সীমাবদ্ধতা ও অনুভূত বাধাকে উতরে যেতে পারি না। আমার স্বপ্ন সমস্তর সঙ্গে, একই সমান্তরালে দৌড়াতে পারি না আর এই আমি! হায়! কী ব্যর্থ আমি!

আমার অতীত জীবনের ছোট, বড় ভুলগুলো দৃশ্যত এখন পথের বাধা হয়ে, কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই আমারই সামনে। আমি বারবার আমার যত পুরোনো ভুলগুলোকে নেড়েচেড়ে খুঁটিয়ে দেখি। ব্যবচ্ছেদ করি তাদের চরিত্র। কখনো আমার মনে হয়, সেই ভুলগুলোর সবই কিন্তু নিছক ‘ভুল’ নয়। আমার জন্য সেগুলো অপরাধও বটে! তখন নিজেকে; এই আমি আর ক্ষমা করতে পারি না। এখন আমি সেগুলোর মাশুল একরকম চড়া মূল্যেই গুনছি কড়ায়-গন্ডায়!

আমি এখন দেখছি, আমার গ্রাম, আমার জনপদ, সর্বোপরি আমার দেশ দ্রুতই পাল্টে যাচ্ছে। আর এই পাল্টে যাওয়ার অভিঘাতের শিকার হচ্ছি আমি। এবং শিকার হচ্ছেন আমার আঙিনার বাকি সবাই। মূলত সারা বিশ্বে এখন পরিবর্তনের যে তুমুল ঝড় বইছে, সেই ঝড়ের তাণ্ডবে আমাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি, গ্রাম দ্রুতই নিজস্ব দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে! আমরা মানুষ, অনেকেই যুগ যন্ত্রণার বিভবে এই মাটির শিকড়ের নাড়ির টান ছিঁড়ে নানান দিকে ছিটকে পড়ছি! দিগ্‌বিদিক ছুটছি তো ছুটছি! সঙ্গে আমরা হারাচ্ছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। দেশজ কৃষ্টি। পরিবারের প্রিয়জনের সঙ্গে আমাদের রক্তের ও আত্মার সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরছে।

ভাঙছে আত্মীয়তার যোগবন্ধনের আবেশে সন্নিহিত সব মায়ার বন্ধন। সঙ্গে স্খলন ঘটছে আমাদের নীতিনৈতিকতার। আমাদের কোমল হৃদয় মন দ্রুতই পাষাণ হয়ে যাচ্ছে! প্রশ্ন, এভাবে যেতে যেতে তারপর কোথায় যাব? পরিশেষে আমরা কোথায় কোন কল্পিত ‘গন্তব্যে’ গিয়ে দাঁড়াব? ফলে কোন ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র শিকলে বন্দী করে রাখছি আমাদের আগামী প্রজন্মকে!

এখন একান্ত বাধ্য হয়েই আমরা বাপ-দাদার জমি-জিরাত বিক্রি করে দিচ্ছি। কারণ, আমরা যুগ পরিবর্তনের শিকার। আমাদের চির-আপন জমিগুলো ক্রমেই অন্যের হয়ে যাচ্ছে। একেবারেই পর হয়ে যাচ্ছে, স্থাবর-অস্থাবর সব! সেগুলোর বুক চিরে ভূমিদস্যুদের সাইনবোর্ড দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। পল্লিমায়ের আঁচল তছনছ করে দিয়ে, সব শ্যামলিমা লোপাট করে দিয়ে যন্ত্রের নির্মম কারুকর্মে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে  আকাশচুম্বী ইট-পাথরের অট্টালিকা। আম, কাঁঠাল, বাঁশঝাড়ের নান্দনিক অবয়ব নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বিদ্যুতের থাম, মোবাইল ফোনের টাওয়ার। হারিয়ে যাচ্ছে দখিনা বাতাসে দোল খাওয়া বাঁশঝাড়ের এবং অবারিত ধানখেতের, পাটখেতের প্রাণমাতানো দৃশ্য। পাখপাখালির কলকাকলি। ‘মরি হায় হায় রে ...!’  

নগরায়ণ ও শিল্পোন্নয়নের তেজস্ক্রিয়ায় ঝলসে যাচ্ছে, প্রজননক্ষমতা হারাচ্ছে প্রাণদায়ী সবুজ নিসর্গ। আমার মাতৃভূমি ‘বন্ধ্যাত্বের’ শিকার হচ্ছে!

মাটির বুক চিরে যন্ত্রদানবের চলাচলের জন্য তৈরি হচ্ছে সেখান দিয়ে, বীভৎস অজগরের মতো কালো পিচঢালা পথ। পাষাণময় সীমানাপ্রাচীরে পরিবেষ্টিত হয়ে যাচ্ছে আমাদের বিখণ্ডিত জমিগুলো। আমাদের ধানখেত, সবজি-বাগান, আম-কাঁঠাল, তাল-নারিকেল, কলা-আনারস, পেঁপে-লিচু সব, বাগানের আর বাঁশঝাড়ের সারি সবকিছুই সমূলে লুণ্ঠন করে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা!

তারপর এখানে গড়ে উঠছে এবং একনাগাড়ে গড়ে উঠবে বিশাল বিশাল স্থাপনা। কলকারখানা। বাস টার্মিনাল। ময়লা আবর্জনার উঁচু পাহাড়। নিয়তই ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে আমার প্রিয় গ্রাম। আমার প্রিয় আঙিনা!

আর এত কিছুর জন্য কি আমি বা আমরা দায়ী নই? আমরা কি ঠেকাতে চেষ্টা করছি? ঠেকাতে পারছি পরিবর্তনের এই সুনামিতে?

এবার একান্তই আমার নিজের কথা। যাদের আত্মিক সান্নিধ্যে আমি আমার শৈশবের, বাল্যকালের আর যৌবনের সময়টা অতিবাহিত করেছি, অপত্যস্নেহে নির্বিশেষে যাঁদের অকৃত্রিম আদরে, যত্নে বড় হয়ে উঠেছি সেই চেনা-মুখগুলোকে কি সচরাচর দেখতে পারব? হাটে, বাজারে, পাঠশালায়, ধর্মীয় উপাসনালয়ে, উৎসবে, পার্বণে যাঁদের উজ্জ্বল-উপস্থিতিতে আমি প্রাণিত হয়েছি। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আর কুশল বিনিময় করেছি, এই প্রবাসে আসার পর তাঁরা অনেকেই গত হয়েছেন। আর যাঁরা এখনো বেঁচেবর্তে আছেন, তাঁদের সঙ্গে কি শিগগিরই আবার সাক্ষাৎ করতে পারব? আমাদের যুবসমাজ কী নিয়ে উদ্দীপ্ত হবে?

আমরা কে কখন, কোথায় কীভাবে মারা যাব, তা কী জানতে পারব? আমাদের শেষ দেখা কি আর হবে? এই দৃশ্য বড়ই করুণ! বড়ই বেদনার! এখন দেখছি, আমাদের নিমজ্জমান ভবিষ্যতের গতিপথ একরাশ হতাশায় আর অন্ধকারে পরিপূর্ণ!
আমি আমার গ্রামের, এলাকার এবং দেশের সব মানুষের কাছেই ঋণী। ক্রমবর্ধমান আমার এ ঋণের দায় কখনো আমি পরিশোধ করতে পারব না। ছোটবেলায় সাথিদের সঙ্গে বিবাদ করেছি। কাঠের স্লেট মেরে কারও মাথা রক্তাক্ত করছি।

রাগের মাথায় কারও কপাল-গাল-মুখ আঁচড়ে দিয়েছি। ধূলিময় রাস্তার মাঝে কাউকে চিত করে শুইয়ে তার বুকের ওপর চেপে বসেছি। বিনিময়ে মায়ের, দাদির ও শিক্ষিকাদের দেওয়া শাস্তিও ভোগ করেছি অবলীলায়। বিদ্যালয় মাঠের পরিসরে উত্তর বনাম দক্ষিণ দলে বিভক্ত হয়ে ঝগড়া করেছি। ভাঙা ইটের টুকরা আর মাটির ঢেলা ছোড়াছুড়ি করেছি। একদল আরেক দলকে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া করেছি। তোমরা আমার আশৈশব বন্ধু যারা, আমার  করা এসব কর্মের শিকার, অতীতের সেসব ঘটনা কি তোমাদের স্থবির স্মৃতিতে সাড়া জাগায়? বস্তুত আমার কোনো সদিচ্ছাই এই আমার কোনো কাজে প্রতিফলিত হয়নি।

মোটকথা, আমার স্বপ্ন আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। সবকিছুতে আমার অবহেলা, ব্যর্থতা প্রকট জ্বলজ্বলে রক্তময় ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এসবই আমার গ্লানির কারণ। কারণ, আমি আগাগোড়াই অমনোযোগী এবং দুর্বিনীত চরিত্রের মানুষ। এখন এসব দুঃসহ স্মৃতির ভারে অবসন্ন আমি। ক্লান্ত আমি!

তাই এখন এ পরিস্থিতিতে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। আমার এসব  করা ভুলের জন্য ক্ষমাও চাইতে ইচ্ছে করে। আমার সব ভুল আর অপরাধের কথা স্মরণ করে এই আমি করজোড়ে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আমার যত গ্লানিমোচন প্রার্থনা করছি। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা ও গুরুজনদের উত্ত্যক্ত করেছি। আজ স্বর্গীয় ও জীবিত তাঁদের সবার কাছে আমি বিনম্রচিত্তে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।

তবু আমি সামনের ক্ষীণ আলোকচ্ছটাকে সামনে রেখে আশাবাদী হতে চেষ্টা করি। যেকোনো বড় পরিবর্তনই শুরুতে মনকে বেদনাহত করে। মানুষকে নিকট ও সুদূর অতীতে নিয়ে যেতে চায় তার আগের মধুর স্মৃতিময় দিনগুলো! তারপরও আশায় বুক বাধা হয়। মানুষকে পরিবর্তনের স্রোতের সঙ্গে এককাট্টা হতে হয়। বর্তমানের সঙ্গে নিজেকে, নিজেদের মানিয়ে নিতে হয়।

বিশ্বের সবকিছুর সঙ্গে আমার চরিত্রেও আজ পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। এখন অভূতপূর্ব ও অনিবার্য পরিবর্তনের স্রোতের মুখে দাঁড়িয়ে, তাই সবার কাছে বিনীত চিত্তে বলছি, ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো...!

  • দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস