প্রবাসের দোটানার ঈদ
প্রবাসের ঈদ আমার কাছে আসলে কখনোই ঈদ মনে হয় না। সেখানে যতই জৌলুশ থাকুক। দেশে থাকতে ঢাকায় যতবারই ঈদ করেছি, ততবারই একই কথা মনে হতো। মসজিদে ঈদের নামাজ পড়াকে আমার সর্বোচ্চ জুমার নামাজ বলেই মনে হতো। কারণ, গ্রামে ঈদের নামাজের জন্য আলাদা জায়গা আছে, যার নাম ঈদগাহ। ঈদগাহে ঈদের নামাজ না পড়লে ঈদ হয় নাকি আবার। পাড়ার সবাই একে অপরকে ডেকে নিয়ে উৎসব করে দলে দলে ঈদগাহে যাওয়া। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজ পড়া। নামাজের পর সবার সঙ্গে কোলাকুলি করা। গ্রামের সবাই তো সবাইকে চেনে, তাই কোলাকুলির পর্বটা যেন আর শেষই হতে চায় না।
আমি অবাক হয়ে মানুষগুলোর মুখের দিকে দেখি। সবাই যে সুখে আছে ব্যাপারটা এমন না; কিন্তু সবাই সবার সাথে খুশিমনে কোলাকুলি করছেন। সেখানে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উঁচু-নিচুর কোনো বিভেদ নেই। এরপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় আর সেমাই খিচুড়ি খাওয়া। আমাদের এলাকায় ঈদের দিন খিচুড়ি রান্নার চল আছে। বিকেলে পাড়ার মাতব্বরের বাড়িতে সব বাড়ি থেকে খিচুড়ি শিরনি নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর সেগুলো একসঙ্গে মিশিয়ে বিলি করা হতো। জানি না, এখন আর এই চল আছে কি না; কিন্তু সেটাও ছিল সামাজিক সাম্যের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এভাবেই আসলে উৎসবগুলো আমাদের একই সুতায় বাঁধে।
শুরুতেই বলেছিলাম, প্রবাসের ঈদকে আমার ঈদ মনে হয় না। কারণটা একটু ব্যাখ্যা করা জরুরি। প্রবাসে আসার পর সবাই রাতারাতি কঠিন ধার্মিক বনে যায়। এর কারণ সম্পর্কে আমি ভেবেছি। ভেবে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছি। কোনো মানুষ যখন জীবনে সব অর্জন করে ফেলে, তখন শেষ জীবনে দানশীল হয়ে যায়। আর প্রবাসীদের যেহেতু জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অর্জিত হয়ে যায়, তাই তারা তখন পরকালের নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দেয়। আর পরকালের নিরাপত্তার সঙ্গে সঠিকভাবে ধর্ম পালন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই কেউই ধর্মের সামান্য নিয়মকানুনের ব্যত্যয় করতে চায় না। যে যে মতবাদের ধর্ম পালন করে, সে সেই মতবাদের কঠিনতম অনুগামী হয়ে যায়। এতে ধর্ম পালনে অনেক দল তৈরি হয়ে যায়।
একইভাবে ধর্মীয় উৎসবগুলোও বিভাজিত হয়ে পড়ে। রোজার ঈদের বেলায় দেখা যায়, একদল সরাসরি সৌদি আরবের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করে। আরেক দল বৈজ্ঞানিকভাবে যেদিন চাঁদ ওঠার কথা, সেদিনের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদ্যাপন করে। আরেক দল আছে স্থানীয়ভাবে সত্যিকার চাঁদ দেখে ঈদ উদ্যাপন করে। আমি তৃতীয় দলের সাথে ঈদ উদ্যাপন করি, কারণ পাড়া–প্রতিবেশী সবাই প্রায় সেই দলের অনুগামী। অবশ্য ব্যক্তিগত একটি কারণও আছে। চাঁদ দেখতে গিয়ে ছোটবেলার চাঁদ দেখার স্মৃতি মনে পড়ে। আর বাচ্চাদের চাঁদ দেখার আনন্দটা দিতে ইচ্ছা করে। কে কার আগে চাঁদ দেখল, সেটা তো একটা আনন্দের বিষয়। আর উৎসব মানেই তো আনন্দ। উৎসব তো শুধু ধর্মের অনুষঙ্গ ছাড়া বিজ্ঞানের হিসাব নয়। এটা অনুভবের একটি বিষয়। সেই অনুভবটায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে চালিত হোক। কারণ, আমরা দিনে দিনে অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ছি।
কোরবানির ঈদও একইভাবে মোটামুটি একইভাবে উদ্যাপন করা হতো। তবে দেখা যেত শেষ পর্যন্ত দুটী দলে উদ্যাপন করা হতো। এবার অবশ্য কোরবানির ঈদ তিন দিনে পালন করা হচ্ছে। এক দল সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ করে ফেলেছে গতকাল। আরেক দল আজ ঈদ করছে সৌদি আরবের এক দিন পরে হিসাব করে। আর চাঁদ দেখা দল আগামীকাল ঈদ উদ্যাপন করবে। মোটামুটি একটা ভজঘট অবস্থা। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য এগুলোর কোনোটারই পরিপন্থী নই। আমার যুক্তি হচ্ছে, যত বেশি দিনে ঈদ উদ্যাপন করা হবে, আনন্দও তত বেশি বেড়ে যাবে। দ্য মোর দ্য মেরিয়ার। একই দিনে বা পাশাপাশি দুই দিন ঈদ উদ্যাপন করলে ঈদের দাওয়াই খেয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারা যায় না। তাই বিভিন্নজন বিভিন্ন দিনে উদ্যাপন করলে মন ও শরীরের ওপর ততটা চাপ পড়ে না।
প্রবাসের ঈদের আরও কিছু বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে বিভাজন তৈরি হয়। রোজার ঈদের আগে ফিতরা কি দেশে দেবেন, নাকি এখানেই দেবেন। দিলে সেই হিসাবটাই বা কেমন হবে। তবে আমি দেশে দেওয়ার পক্ষপাতী। কারণ, দেশের দরিদ্র মানুষের এই টাকাটা অনেক কাজে লাগে। এখানে আসলে এগুলোর তেমন দরকার নেই। কারণ, রাষ্ট্রই মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এখানে বিভিন্ন সংগঠনের নামে তহবিল সংগ্রহ করা হয়। এটাকেও আমার কেন যেন আদিখ্যেতা মনে হয়। কারণ, সেই তহবিলের বেশির ভাগ অংশই কিন্তু চলে যায় সেই সংগঠনের বিলাস ব্যাসনে। আবুল মনসুর আহমদের ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ গল্পের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। পৃথিবীব্যাপী দাতব্য প্রতিষ্ঠানের চিত্র একই।
কোরবানির ঈদের সময় কোরবানি কোথায় দেওয়া হবে—দেশে না এখানে। সেটা নিয়েও অনেক মত প্রচলিত। আবার স্থানীয়ভাবে দিলে সেটা কি দোকানের মাধ্যমে দেওয়া হবে, নাকি খামারে গিয়ে নিজ হাতে জবাই করে দেওয়া হবে। তবে যেভাবেই দেওয়া হোক না কেন, দিন শেষে প্রবাসের কোরবানি মানে আসলে মাংস খাওয়ার মহোৎসব। অনেকেই অবশ্য মাংস প্রতিবেশীদের সাথে ভাগাভাগি করেন; কিন্তু সবাই যেহেতু মোটামুটি কোরবানি দেন, তাই এই বিলিবণ্টন আসলে শুধু আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করা। অবশ্য সবাই কোরবানির পশুর দামের সমপরিমাণ টাকা দেশে গরিব মানুষদের দিয়ে কোরবানির মাংস খাওয়াটাকে হালাল করার চেষ্টা করেন। তাই অনেকেই দেশে কোরবানি দিতে পছন্দ করেন। তাহলে মাংসের তিন ভাগ ঠিকঠাক বিলিবণ্টন করা যায়।
যাহোক উৎসবের দিনগুলো প্রবাসীদের জন্য সবচেয়ে কষ্টের সময়। বছরের অন্যান্য দিন তো কর্মব্যস্ততায় কেটে যায়; কিন্তু উৎসবের দিনগুলোতে যেহেতু সবাই ছুটি নেয়, তাই কিছুটা বাড়তি অবসর পায়। তখন সবার মনেই দেশের কথা নিজেদের ছোটবেলার ঈদ উদ্যাপনের স্মৃতি ভিড় করে। অবশ্য প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মকে সেটি অতটা স্পর্শ করে না; কারণ তাদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এগুলোর মধ্যেই। বড়দের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরেই আবার সেই ডিভাইস নিয়ে বসা আর গেম খেলা; কিন্তু বড়রা ভোগেন দোটানায়। প্রায় সবাই দেশে ঈদ করতে যেতে পারেন না। তারা তখন ঈদের দাওয়াত খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দেশে থাকা মা–বাবা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। করেন শুভেচ্ছা বিনিময়। এটাই অনেকটা ভার্চু৵য়াল কোলাকুলির কাজ করে।
ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই খুশি। ঈদ মানেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই মন্ত্রকে ধারণ করেই ঈদ উদ্যাপন করে থাকেন। হয়তোবা সবারই আলাদা আলাদা মতবাদ আছে। সেগুলোকে ছাপিয়ে দিন শেষে ঈদ হয়ে ওঠে একটা আনন্দময় অভিজ্ঞতা। পৃথিবী যত দিন টিকে থাকবে, নিশ্চয়ই তত দিন ঈদ উদ্যাপনের এই একই মূল্যবোধ বজায় থাকবে। তবে প্রবাসীদের ঈদ সারা জীবনই কাটবে দোটানায়। একটা টান দেশে ফেলে আসা স্বজনের জন্য, আরেকটা টান প্রবাসে জন্ম নেওয়া সন্তানদের জন্য। ইচ্ছা করে প্রবাসের সব ছেড়েছুড়ে দেশে গিয়ে ঈদ করতে; কিন্তু সন্তানদের একা ফেলে যেতেও তাঁদের খারাপ লাগবে। আর ঈদের সময় সবাইকে নিয়ে যে দেশে যাবে, যেভাবে ঢাকার মানুষ ঈদ করতে গ্রামে চলে যায়; কিন্তু সেই সামর্থ্য সবার থাকে না। তাই তাদের বাকি জীবনটা কাটে দোটানায়।