শান্তির দেশ থেকে সহিংসতার ছায়ায়: আয়ারল্যান্ডে নারী হত্যা ও সামাজিক সংকট
আয়ারল্যান্ড, যা একসময় শান্তি ও সৌহার্দ্যের দেশ হিসেবে ইউরোপে পরিচিত ছিল, সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতার ভয়াবহ উত্থানের কারণে তার সেই সুনাম হারাতে বসেছে দেশটি। সহিংসতা এখন এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যে এটি শুধু নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনকেই ধ্বংস করছে না, বরং আয়ারল্যান্ডের সামাজিক কাঠামো, আইনিব্যবস্থা ও ঐতিহ্যের ওপরও গভীরভাবে প্রভাব ফেলছে। ২০২০ সাল থেকে, আয়ারল্যান্ডে ৩৭ জন নারী সহিংসভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। পাশাপাশি, উত্তর আয়ারল্যান্ডে আরও ২৫ জন নারী একই পরিণতির শিকার হয়েছেন। এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়; এগুলো একেকটি গল্প, যারা নিজেদের জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে ছিলেন—কেউ কর্মজীবনের শুরুতে, কেউ মা, আবার কেউ ছিলেন বৃদ্ধা।
এসব হত্যার পেছনে একটি ভয়াবহ সাদৃশ্য রয়েছে। অধিকাংশ হত্যাকারী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি ছিলেন ভুক্তভোগীদের পরিচিত। আয়ারল্যান্ডের ক্ষেত্রে ৩৭ জনের মধ্যে অন্তত ১৫ জন নারী তাঁদের বর্তমান বা সাবেক সঙ্গীর হাতে নিহত হয়েছেন। আরও অন্তত আটজনের হত্যাকারী ছিলেন তাঁদের পরিবারের সদস্য। বাস্তবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে; কারণ, অনেক ঘটনা এখনো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্কের প্রকৃতি নিশ্চিত করা যায়নি।
রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস ইন আয়ারল্যান্ড (RCSI)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আয়ারল্যান্ডে নারীদের প্রতি ৫৬% সহিংসতার জন্য দায়ী ছিলেন তাঁদের বর্তমান বা সাবেক সঙ্গী। আরও ২০% ক্ষেত্রে দায়ী ছিল পরিবারের সদস্য। এই পরিসংখ্যান শুধু সহিংসতার গভীরতাকেই তুলে ধরে না, এটি সমাজে নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যাও প্রকাশ করে।
তবে আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, আয়ারল্যান্ডে সঙ্গী বা পারিবারিক সহিংসতার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই বিষয়ে তুলনামূলকভাবে কম এবং অপর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করে। এই তথ্যের অভাব সমস্যার গভীরতা এবং তার সমাধানের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যমের ভূমিকা। নিহত নারীদের প্রতি গণমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়ই অসংবেদনশীল এবং একপেশে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিহত নারীদের সম্পর্কে খুব কম তথ্য প্রকাশ করা হয়, যেখানে হত্যাকারীদের পরিচয় এবং তাদের ব্যক্তিত্বকে অযথা গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি শুধু ভুক্তভোগী নারীদের আরও অবমূল্যায়িত করে না, বরং হত্যাকারীদের প্রতি সমাজে অযাচিত সহানুভূতির জন্ম দেয়। ক্লোডাঘ হাওয়ে ও তাঁর সন্তানদের হত্যার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের আচরণ এর জ্বলন্ত উদাহরণ। হত্যাকারী অ্যালান হাওয়ের মতো একজন মানুষকে যখন শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়েছিল, তখন নিহত ব্যক্তিদের জীবন প্রায় ভুলেই যাওয়া হয়।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় উইমেনস এইডের মতো সংস্থাগুলো প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে। তারা শুধু নারীদের সুরক্ষার কথা বলছে না, বরং সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন, শিক্ষায় বিনিয়োগ এবং একটি কার্যকর ও সংবেদনশীল ন্যায়বিচারব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে। উইমেনস এইডের সিইও, সারাহ বেনসন, নারীদের প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির কথা বলেছেন এবং এটিকে বাস্তবায়ন করতে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
এটি আয়ারল্যান্ডের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। নারী হত্যার এই ভয়াবহ প্রবণতা বন্ধ করতে হলে সমাজে গভীর পরিবর্তন আনতে হবে—আইনি কাঠামোকে আরও কার্যকর করতে হবে এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্গঠিত করতে হবে। এ পরিবর্তন শুধু নারীদের জীবন রক্ষা করতেই নয়, আয়ারল্যান্ডের হারিয়ে যেতে থাকা শান্তি ও সৌহার্দ্যের সুনাম পুনরুদ্ধারের জন্যও অপরিহার্য। একটি নিরাপদ, মানবিক সমাজ গড়তে এখনই প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রচেষ্টা, যেখানে সহিংসতার কোনো স্থান থাকবে না এবং প্রতিটি নারী নিজের জীবনে মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে।