মমি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভোর পাঁচটার সময় মেসেঞ্জারে রিং হচ্ছে, চোখ খোলার আগেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল অনিলার। রিঙ্গার টোন সাইলেন্টই থাকে, ঠিক সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে অ্যালার্ম বাজার কথা, লেপের ভেতর থেকে হাত বের করে খুবই কষ্ট করে এক চোখ খুলে দেখে মিলা আপা কল করেছে, ফোন সাইলেন্ট করে লেপের ভেতরে ঢুকে গেল অনিলা, মনে মনে খুবই বিরক্ত সে! এই বাংলাদেশে থাকা মানুষজন নিয়ে এ একসমস্যা... যখন মন চায় ফোন দিয়ে বসে, না ধরলে কথা শোনায়, কিন্তু তখন আমাদের কয়টা বাজে, সেটা ফোন করার ঠিক সময় কি না, সেটা মাথায় রাখবে না। আর ফোন করেই শুরু করে দিবে সমস্যা আর সমস্যা... যেন আমরা বেহেস্তে আছি, কোনো সমস্যা নেই।
আমরা বলি না তাদের যে টেনশন করবে, এতো দূর থেকে কি বা করার আছে। তা ছাড়া... ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল অনিলা। ঠিক সাড়ে ছয়টার অ্যালার্মে ঘুম ভাঙল, অ্যালার্ম বন্ধ করতে গিয়ে দেখে মিলা আপা আটবার কল করেছে.. আর মেসেজ, ‘ফোন ধরিস না কেন? কেউ এত ঘুমায়?’

যাহ বাবা, ঘুমানোও যাবে না দেখছি...
অনিলা উঠে বাথরুম সেরে কিচেনে কেটলিতে পানি ভরে সুইচ অন করে মোবাইলে হেডফোন লাগাতে লাগাতে ভাবছে, আবার খারাপ কোনো খবর না তো! সকাল বেলা কি শুনতে হয়, কে জানে! মিলা তার বড় খালার মেয়ে, উনারা তিন বোন মিলা, শিলা, পলা। (এরপরের মেয়ের নাম বড় খালা গলা রাখতো কিনা এটা আম্মুকে জিজ্ঞাসা করে একদিন ভীষণ বকা খেয়েছে অনিলা) অনিলার অনেক বড়, প্রায় ১o বছরের বড় মিলা আপা, এরপর শিলা আপা তার ৭ বছরের বড়, শুধু পলাই অনিলার ৩ বছরের ছোটো, বড় খালার বুড়ো বয়সের মেয়ে পলা। ৩ বোনই খুবই ভালো এবং সরল, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সবাই অনিলাকে খুবই পছন্দ করে, যা কিছু হবে তাকে বলা চাই, অনিলার হয়েছে জ্বালা। ১০ বছর হলো প্রবাসী, কিছুতেই ব্যস্ততায় সময় মিলাতে পারে না কিন্তু মুখের ওপরে না বলতেও পারে না, মায়া লাগে। বয়সে বড় এক বোন ফোন করে একটানা কথা বলে যায়, আমরা কেমন আছি না আছি সেটাও জিজ্ঞাসা করবে না! অস্থির কিশোরী বড় বোন।

সকালের নাশতা রেডি করতে করতে ফোন দিলো অনিলা, একবার রিং হতেই ফোন ধরে ফেললো মিলা আপা।
সঙ্গেসঙ্গে কান্নার শব্দ শুনতে পেলো অনিলা।
কী হয়েছে আপা? কাঁদছ কেনো?
কেঁদেই যাচ্ছে, অনিলা চা বানিয়ে চুমুক দিচ্ছে আর হেডফোন এ সকালবেলা কান্নার রেওয়াজ শুনছে!

আপা, আমি কী তাহলে ফোন রেখে দেব? কিছু বলছ না তো, আর বাংলাদেশ এ তো অনেক রাত এখন, ঘুমাও না কেন?

কান্নার শব্দ বেড়ে গেলো। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তোর কি সময় আছে আমার কথা শোনার? কখন থেকে ফোন দিচ্ছি, ধরিসই তো না। বলে আবারও কান্না।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

অনিলা বিরক্ত হতে শুরু করল, সাড়ে সাতটায় সবাইকে ওঠাতে হবে, আটটার মধ্যে বের হয়ে যেতে হবে, বাচ্চাকে কিন্ডার গার্ডেনে দিয়ে অফিস যেতে হবে।
কান্নার যে গতি, কখন যে ছাড়া পায়, ভাবছে মনে মনে।
এমন সময় মিলা আপা বলে উঠল, তোর দুলাভাই আমাকে ‘মমি’ বলেছে, বলে আবারো কান্না। অনিলা হাফ ছেড়ে বাঁচল, এতক্ষণ যা ভেবেছে, তা নয়। যাক ঘূর্ণিঝড় না, কালবৈশাখী মনে হচ্ছে। অনিলা বলল, বল কি!

দুলাভাইয়ের এত সাহস? তোমাকে মমি বলে।

ঘটনা কী? তাড়াতাড়ি বলো বা আমি না হয় সন্ধ্যায় ফোন দিই, এখন একটু তাড়াহুড়া আছে।

মিলা আপা গলা উঁচিয়ে বলল, না না ফোন রাখবি না, এখনই শুনতে হবে, আটবার কল করার পর কল ব্যাক করেছিস, একবার ফসকে গেলে আবার আট দিন পর ফোন দিয়ে বলবি ব্যস্ত ছিলি! তোদের আবার ব্যস্ততা শেষ হয় না।

আমাদের জীবন তোমরা বুঝবে না, আচ্ছা বলো তাড়াতাড়ি শুনছি।

—শোন, গেল শুক্রবার সামায়লার বিয়ের অনুষ্ঠান হলো রাওয়া হলে, আপন মামাতো বোনের বিয়ে, একটু সাজব না? পার্লার এ গিয়ে আমরা তিন বোনই সেজে এসেছি, এরপর গত বছর চেন্নাই থেকে আনা কানজিভরম শাড়িটা পরে গেলাম, সবাই খুবই সুন্দর বলল, তোর দুলাভাইয়ের সকালে সার্জারি ছিল (দুলাভাই পিজি হাসপাতালের চিকিৎসক), আমি বলে দিয়েছিলাম বিয়েতে অবশ্যই আসতে হবে। তা না হলে খুবই বাজে দেখাবে, তুমি বাড়ির বড় জামাই, তাই তোর দুলাভাই হাসপাতাল থেকে সোজা বিয়ে বাড়িতে এসেছে। এসে এক কোনায় ঘাপটি মেরে বসে আছে, আমি তো জানতাম না, তোর ভাগ্নি রায়লা এসে বলল, আম্মু আম্মু আসো, আব্বু এসেছে, এসে না একটা কর্নারে বসে আছে, আমাকে দেখেও কিছুই বলল না।
(এই বাড়ির সব মেয়ের নামের পিছনে ‘লা’ আছে, বোনের মেয়েও বাদ যায়নি)।

শুনে আমি খুশি হয়ে তার কাছে গেলাম, তোর দুলাভাই আমাকে দেখে বলে আস সালামু আলাইকুম, ভালো আছেন আন্টি?

আমি চোখ বড় করে বললাম, আমাকে তুমি সালাম দিয়ে আন্টি ডাকছো কেনো? বয়স কী বাড়ছে, না কমছে!

আমার গলা শুনে তোর দুলাভাই থতমত খেয়ে বলে, ওহ, তুমি!
কেমন লাগে বল, শাড়িটা কিন্তু তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গেই কেনা চেন্নাই থেকে, ১৪ বছর হলো বিয়ে হয়েছে, নিজের বিয়ে করা বউকে চেনে না? বলে আন্টি!
এতো সুন্দর শাড়িটা ও ভুলে গেলো!
অনিলা অনেক কষ্টে হাসি আটকাল, মিলা আপা হাসি শুনলে খবর আছে, ঢোক গিলে বললো, কি বল! তারপর?
এরপর আমাকে বলে, এখানে একটু বসো, আমি বসলাম।
বলে রেস্ট রুম কোন দিকে বল, তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
একটু আগে শিলাকে তুমি ভেবে বলে ফেলেছি, এই টয়লেট কোনো দিকে তাড়াতাড়ি বল, ইমার্জেন্সি।
সে কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ছি, দুলাভাই, আপনার এতো অধঃপতন! আমাকে টয়লেট দেখাতে বলেন।
আমি বিব্রত হয়ে বললাম, ও আমি ভেবেছি তুমি মিলা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এরপর আমার পাশ দিয়ে এক ভদ্রমহিলা হেসে যাচ্ছিল, আমি বললাম, আপা রেস্ট রুমটা কোনদিকে.... উনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলে, তুমি মিলার জামাই সাদিক না? আমাকে আপা বলছ কেনো? আমি তোমার ছোটো মামি! এইবার তো আমার ঘাম ছুটে গেল।

সবাই দেখতে এক রকমের, চিনব কী করে?

কোনো রকমে ঢোক গিলে দুঃখিত বলে কোনায় এসে বসে আছি, সবাই মিলে মমি সেজে বসে থাকলে চিনবো কীভাবে? একটু আগে রায়লার মতো একটা মেয়ে দেখলাম, ভয়ে কাছে ডাকিনি, কার না কার মেয়ে, শেষে না বিয়ে বাড়িতে অন্যের মেয়েকে ইশারার অভিযোগে থাপ্পড় খেতে হয়!

এখন কি বলবা, বাথরুম কোন দিকে? নাকি বাসায় চলে যাব?
বল কেমন লাগে? এই লোকের ঘর করি ১৪ বছর!

অনিলা আর থাকতে পারলো না, হো হো করে হেসে দিলো, হাসতে হাসতেই বললো, আহা বেচারা দুলাভাই, উনি তো ঠিকই বলেছেন, এখন তো পার্লারে এমনই সাজায়। সবাইকে একই রকমের দেখায়, কে বিয়ের বউ, কে মেয়ের মা, কে বোন, কে মামিশাশুড়ি চেনার কোনো উপায় নেই তো, সবার একই মেকআপ! আমিও তো গেলবার বাংলাদেশ গিয়ে রাতুলের বিয়েতে ওর বউয়ের মাকে ছোটো বোন মনে করে তুমি বলে ফেলেছিলাম, পরে সে কি লজ্জা, কতবার যে সরি বলেছি, পুরো বিয়ে বাড়িতে কাঁটা হয়ে ছিলাম।

আমার তো দুলাভাইয়ের কথা ভেবে খারাপই লাগছে।
—তোর এই এক সমস্যা, সব সময়েই শত্রু পক্ষের জন্য দরদ।

শুধু কী তাই, তোর দুলাভাই পলাকে পেত্নী বলেছে, চিন্তা কর? আর ছোটো মামির কাছে তো আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না, পুরো বিয়েবাড়ি ফিসফাস আর আমাকে দেখে সবাই চুপ হয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত সামায়লার কাছে গিয়ে বসলাম, বোনটার বিয়ে হয়ে গেলো, কেমন যে হয় পরের ঘর, অন্য জীবন! আমাকে দেখে সামায়লা বলে, মিলাপু এর পর থেকে যে শাড়ি পরে বিয়েতে আসবে, সেটার ছবি তুলে আগেই বড় দুলাভাইকে পাঠাবে, যেন উনি তোমার শাড়ি দেখে তোমাকে চিনতে পারে, উনি সার্জারির ডাক্তার, এত মমি একসঙ্গে দেখে ভাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে!

চিন্তা কর অনিলা, একটু পর গাড়িতে উঠে শ্বশুরবাড়ি যাবে, কই মামা–মামির জন্য মন খারাপ করবে, তা না, তিনিও উপদেশ দেয়, আর মুখ টিপে হাসে।
কেয়ামতের বেশি দেরি নাই।
বললাম, তোকে এসব কে বলল?

বলে রায়লা, একটু আগেই এসে বলে গেলো বাবা, মা কে মমি বলেছে! আর পলা আন্টিকে পেত্নী।

দেখেছিস ঘরের শত্রু কেমন বিভীষণ, সারা দিন–রাত আমি খাওয়াই, পড়াই, স্কুলে দিয়ে নিয়ে আসি, ঘুম পাড়াই, কিন্তু বাপের এক নম্বর চামচা। বলে আবার কান্না শুরু।
অনিলার হাসতে হাসতে পেটে খিল, হাসি থামিয়ে বললো, বুঝেছি, এখন যা বলি একটি শোন—

রায়লামনি বেঠিক কিছুই করে নি, তুমিও খালুর নেওটা ছিলে, আমিও আমার বাবার, সব মেয়েরাই এমন।

পলা আমারও ছোট, দুলাভাইয়ের তো অনেক ছোটো, এখন উনি যদি নিজের ছোট্ট শালির সঙ্গে একটু ইয়ার্কিদুষ্টামি করে, করুক না, বড় ভাই তো না, দুলাভাই।
সামায়লাও ভুল কিছু বলেনি, ও একটা সহজ সমাধান দিয়েছে, একটা শিক্ষিত সাবলম্বী মেয়ে বিয়ে করছে, কান্না করবে কেনো, বা মন খারাপ করবে কেনো? বিয়ে তো খুশির খবর।
আর মনে করে দেখ, ১৪ বছর আগে তোমার বিয়েতেও কিন্তু আমরা সবাই পার্লারে সেজেছিলাম, তখন কিন্তু সবাই সবাইকে চিনতে পেরেছিল, কারও ভুল হয়নি। তাহলে এখন কী সমস্যা?

দুলাভাইয়ের মতো নামকরা ডাক্তার, যিনি কিনা এত জটিল জটিল সার্জারি করেন, তাঁর তো চোখে সমস্যা না, সমস্যা হলো এখনকার মেকআপে, সবাইকে একরকমের বানিয়ে ফেলে, একগাদা সাদা সিমেন্ট মুখে লাগিয়ে তার ওপর রং তুলি দিয়ে পেইন্ট করে, কাউকেই চেনা যায় না, সবাই এক রকমের দেখতে।

এটা কিছু হলো? পার্লার থেকে সেজে আসার পর যদি কে মিলাপা, কে শিলাপা চেনা না যায়, তাহলে সেজে কী লাভ?

সাজতে না বলছি না, কিন্তু সবার চেহারায় একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, সেটা ঠিক রেখে সাজো, বা নিজেই ঘরে সাজো, সাদা সিমেন্ট মাখতে যাও কেন?
তুমি যে মিষ্টি মিলাপা, এটা তো বোঝা যেতে হবে, তাই না?
—তুই আমার বোন, নাকি সাদিকের বোন?
অনিলা বলল, আমি দুজনেরই বোন।
মিলা আপা, আমার অফিস আছে, ফোন রাখতে হবে, অলরেডি আমার দেরি হয়ে গেছে, দুলাভাইকে সালাম দিয়ো।
—আচ্ছা একটা কথা বলে ফোন রাখ, মমি কি সাদা হয়?
উফ মিলাপা!!!

[বি. দ্র. ওপরের গল্পের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক, কারও সঙ্গে মিলে গেলে কাকতালীয়মাত্র।]

** দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]