জেফরির নায়ক ও আ কেস অন করাপশন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পড়ে শুনাও এবার।

আমি স্পষ্ট উচ্চারণে জোরালো গলায় পড়তে শুরু করলাম। এ ধরনের জরুরি অর্থপূর্ণ তবে প্রায় অর্থশূন্য কাজে অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে গেলাম। পণ্ডিত–গবেষকদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কিছু কাজ করে থাকি। পয়সাও সামান্য জোটে, তবে এতে পয়সার চেয়ে বেশি জোটে আনন্দ।

হতাশ পিতা বিরক্ত চোখে চেয়ে চেয়ে আমাকে দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মা বলে, না হোক বিদ্বান, না হোক বিত্তবান। কারোর ক্ষতি তো করছে না, গরিবানা সুরতেই জীবনটা ওর না হয় কাটল, কী তাতে আসবে–যাবে।

বৈষয়িক ব্যাপারে অতি অভিজ্ঞ বাপ বলে, যেটুকু গুণ আছে, তা দিয়ে ফায়দা তুলতে পারত, সেটাও করবে না; গাদা গাদা বই পড়া আর দিস্তা দিস্তা কাগজ ও কালির অপচয় শুধু। লিখে দে একখানা রসালো বই, তা থেকে পয়সা কীভাবে বানাতে হয়, তা আমি বুঝব।

বাবার বিরক্তি আমার কাজে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটাতে পারে না। কিছুদিন হলো অপরাধ আর দুর্নীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে কিছু তথ্য জোগারে মেতে উঠি। ক্রাইম শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যাদের কথা মনে ভাসে, তারা সমাজের নিচুতলার লোক। আর দুর্নীতি হচ্ছে ধবল বা সফেদ পোশাকধারীদের বা হোয়াইট কলারদের কর্ম। সুবিধা আদায়, স্বার্থসিদ্ধির জন্য অতি সূক্ষ্মভাবে ভদ্রলোকেরা দুর্নীতি করে থাকে। মুশকিল হয় কোনো দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র বা বহুজাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান যখন অন্য দেশে ঘুষটুস দিয়ে কাজ আদায়ে কোমর বেঁধে নামে। দুর্নীতি দমনের আইন আর দুর্নীতি বন্ধের আইনি উদ্যোগ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির শুরুতে এই কাজের প্রস্তাব পাই। গল্পটা কাজের অংশ।

জেফরি আর্চারের গল্পের নায়ক একজন মন্ত্রী। আফ্রিকা মহাদেশের হতদরিদ্র, শিক্ষাদীক্ষা বঞ্চিত এক দেশের সে মন্ত্রী। এমনি এক দেশ যে দেশে যখনি যারা শাসনক্ষমতা পেয়েছে, জনগণের সম্পদ লুট করেছে দুই হাত ভরে। সেই সম্পদ তারা অবশ্যই দেশের বাইরে বিদেশের ব্যাংকে নিরাপদে গচ্ছিত রেখেছে। কথিত গল্পের নায়ক মন্ত্রী ক্ষমতা পেয়ে ঘুষ আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ করে খুবই সম্মান পান, জনপ্রিয় হন। এমন কি সরকারপ্রধানও তার কর্মকাণ্ডে চমৎকৃত, বিস্মিত, শংকিতও কিছুটা। এর মধ্যে সরকারপ্রধানের কাজেরও তথ্যতালাশ করে কিছু গড়বড় বের করে ফেলেন মন্ত্রী। গল্পেতে দেখা যায় মন্ত্রীর বস সরকারপ্রধানও মন্ত্রীর এই কাজে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান করে করে ক্লান্তশ্রান্ত মন্ত্রী সপরিবার ছুটি কাটাতে বিদেশ গেলেন। পরিবার-পরিজনকে হোটেলে রেখে সবার অজ্ঞাতে উড়াল দিয়ে পাশের দেশ সুইজারল্যান্ডে পৌঁছালেন মন্ত্রীবর। এসেই গেলেন সেই ব্যাংকে, যাতে পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে যে কেউ যত টাকা ইচ্ছা রাখতে পারে। ঐ ব্যাংক টাকার উৎস কি, তা যেমন (চুরি-রাহাজানির টাকা নাকি আয়কর ফাঁকি দেওয়া টাকা কিছুই) জানতে চায় না, তেমনি তারা টাকার বিষয়ে কোন তথ্য (যেমন কার টাকা, কত টাকা) কাউকে কক্ষণো দেয় না। কর্মবীর, আপাত সৎ মন্ত্রীমহোদয় তার পুরাতন জীর্ণশীর্ণ ব্রিফকেসটি নিয়ে ব্যাংকে ঢুকলেন। পরিচয় দিতেই তারা তাকে সমাদরে বসালেন। উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা মন্ত্রীর খেদমতে তখনি এসে হাজির হলেন।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জানকোরবান করা মন্ত্রী জানতে চাইলেন তার দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডার অসৎ লোকদের নাম ও ব্যাংক একাউন্টের হিসাব। কর্মকর্তা নম্রভাবে অপারগতা প্রকাশ করলেন। মন্ত্রী রুক্ষ হলেন, রুষ্ট হলেন। ব্যাংক কর্মকর্তা আরও বিনয়ে গলে গিয়ে নিজের অক্ষমতা জানিয়েই গেলেন। এবার মন্ত্রী কৌশল খাটালেন। তার কথা হল যদি সুইসব্যাংক এই তথ্য তাকে না দেয় তবে তার দেশ সুইজারল্যান্ডের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে। মন্ত্রীর অনুরোধ-উপরোধ, বাকবিতণ্ডা, যুক্তিকৌশল সব অর্থহীন আর্তনাদমাত্র। দুর্নীতির তথ্য উদ্ধারে ব্যর্থ পরাজিত লোকটি এবার ভয়ানক রেগে গেলেন। উত্তেজিত হয়ে পকেট থেকে পিস্তল বার করে কর্মকর্তার মাথায় ঠেকিয়ে আবারও সেই তথ্য জানতে চাইলেন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কর্মকর্তা তথ্য না জানাতে অটল, অনঢ় রইল। শেষে কি ঘটল?

জেফরির গল্পে চমক অভূতপূর্ব তাই পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। এবার দরিদ্র দেশের পরাজিত মন্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল। পিস্তল ফেলে এবার মন্ত্রী জীর্ণ ব্রিফকেস টেনে নিয়ে তার ঢাকনা খুলল। তাতে থরে থরে সাজানো ডলারের বান্ডিল। এ টাকা বিষয়ে এরাই তার ভরসা। এই ব্যাংক জানতেও চায় না টাকার উৎস, তাই সে চোখ বুজে নিরাপদে এই ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখবে। কাকপক্ষীও কোনোদিন জানবে না, তার টাকার খবর।

গল্প পড়ে কী বুঝলে? সেই মন্ত্রীকে খুঁজেছিলে কি? কালোপনা, নাদুসনদুস, তেল চকচকা লোকটি কোথায় গেল? গরুব দেশের জঘন্য এক মন্ত্রীকে দেখানো হয়েছে এতে।

—দরিদ্রলোকমাত্রই অসৎ আর দুর্নীতিবাজ। তাদের আত্মমর্যাদা বলে কিছু আছে নাকি? দরিদ্র দেশে এমন চোর-ধাওর-লোভী মন্ত্রীর অভাব নাই। দরিদ্রলোক একবার ক্ষমতায় গেলে তলানীটুকুও চেটে-পুটে খায়, এই জন্য গরিবদের ক্ষমতা দিতে নাই।
সমাজবিদ্যার অধ্যাপক–গবেষক হাসলেন।

—তুমি এক সরল গবেট।
—কেন এমন কথা বলছেন? গরিব দেশেই তো দুর্নীতির ঘটনা ঘটে চলেছে, এটাতো অস্বীকার করার উপায় নাই।
—তা বুঝলাম। তবে ঘুষের টোপ কারা ফেলে বলতো? কারা চুরির টাকা নিরাপদে রাখতে সাহায্য করে? অসৎ পথে অর্জিত অর্থের অভয়ারণ্য কোথায় আছে? সুইজারল্যান্ডে, তাই না?

—শুনেছি আরব আমিরাতও কালোটাকা গচ্ছিত রাখার স্বর্গপুরী যাকে বলে ট্যাক্স হ্যাভেন।

—আরব আমিরাত কি দরিদ্র? যাক গল্পটা চমৎকার বেছে এনেছ। কোর্স ম্যাটেরিয়াল হিসাবে এটাও কাজে লাগবে। আরও কিছু তথ্য জোগার কর তো।
এক টুকরা কাগজে খস খস করে কিছু লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
তারপরের কয়েক দিন তথ্য জোগারে ব্যস্ত রইলাম। দৈনিক পত্রিকার পাতা তন্ন তন্নèকরে দুর্নীতির বিষয়ে খবর খুঁজে বের করে সারাৎসার লিখা। বিভিন্ন দেশের সরকারের ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ব্যবসা বাগানোর ফন্দি (পরিশীলিত ভাষায় যাকে বলে বিজনেস এক্সপানশন বা প্রমোশন স্ট্র্যাটেজি) জানার ও বোঝার জন্য প্রাণপাত করছি।

কাজে গভীরভাবে নিবেদিত থাকি। বাপ অবহেলায় দেখে আমার মতো অর্বাচিন অপগণ্ডকে। মায়ের আদর অপগণ্ড বাঁদরটিকে আগলে রাখতে সদা সচেষ্ট থাকে।
হলিউডি ছবি ‘সিরিয়ানা’ দেখা হলো। দুর্নীতির জটিল জট চিত্রিত হয়েছে এতে। ‘সিরিয়ানা’তে জর্জ ক্লুনির অভিনয় এমন অসাধারণ যে অস্কারের জন্য নমিনেশন পেয়েছিল সে। শেষ পর্যন্ত তাকে অস্কার দেওয়া হয়নি।

অধ্যাপক বললেন, না দেওয়ার কারণটা কী মনে হয়?
—ছবির অস্বস্থিকর বিষয়বস্তু। ঘুষ দিয়ে নানা সুবিধা আদায়ের যে চিত্র ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে, তা এক সিআইএ কর্মকর্তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার সত্যিকার বয়ান।
—ঠিক, অস্কার দিলে ছবিটি সম্পর্কে মানুষের আগ্রহকে আরও উস্কে দেওয়া হবে ভেবেই হয়তো।

অনুসন্ধান আর অধ্যয়ন একটি বিষয়ে আলো ফেলল, তা হলো ঘুষ আর নানা প্রলোভনের বড়শি পেতে গরিব দেশের আমলা-মন্ত্রীদের কৌশলে গেঁথে ফেলা হয়। চাওয়ার আগেই এনভেলপভর্তি অর্থ হাজির হয় তাদের কাছে এবং পরবর্তী সময়ে তারা ঘুষখোর–দুর্নীতিবাজ হিসাবে নিন্দিত ও কলঙ্কিত হয়। অথচ যারা নিজেদের ব্যবসায়িক সুবিধা পাওয়ার জন্য ঘুষের উপঢৌকন দিয়েছে, তারা প্রায় কখনোই চিহ্নিত ও নিন্দিত হয় না। ঘুষ দেওয়া ব্যবসা আদায়ের কৌশলমাত্র, তেমন মারাত্মক কোনো অন্যায্য কাজ এটি নয়, এই ধারনাটি চালু রয়েছে ঘুষদাতাদের মধ্যে। সুতরাং বিবেক দংশন, নৈতিক যন্ত্রণা নামে কোনো অনুভূতিই ওদের নাই।

একদিন অধ্যাপক বললেন, গরিব দেশের পত্রিকাতে খবর প্রকাশেও থাকে নিজেদের হীনম্মন্যতার ছবি। যেমন দেখ এখানে লেখা, ‘জারদারি (পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর স্বামী) অমুক কাজের জন্য শত হাজার ডলার ঘুষ নিয়েছিল’, লিখতে পারত, ‘অমুক কাজ আদায়ের জন্য তমুক কোম্পানি জারদারিকে শত হাজার ডলার ঘুষ দিয়েছিল।’

আমি বললাম, গরিব দেশ নাইজেরিয়া এবার অস্ট্রেলিয়ার এক কোম্পানির ঘুষ দেওয়ার ঘটনা নিয়ে খুব চেঁচামেচি করছে। খবরটা অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকায় প্রথম পাতায় শিরোনাম সংবাদ হয়েছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকলেই সব হয় না, সঙ্গে থাকতে হয় সাহস, সততা ও প্রজ্ঞা, বুঝেছ?
অধ্যাপকের সৎ ও আন্তরিক ব্যাখ্যায় আমি মুগ্ধ।

কাজ আগাচ্ছিল। মাঝেমধ্যেই অধ্যাপককে কাজের অগ্রগতি অবহিত করে আসি। শেষদিন গেছি। ভদ্রলোকের কাছে তার একজন পণ্ডিত বন্ধু বসে ছিলেন। অধ্যাপক আমাকে দেখিয়ে বললেন, ও আমাদের কোর্স ম্যাটেরিয়াল তৈরিতে সাহায্য করছে; নতুন কোর্স চালুর কথা ভাবছি আমরা।

—কী কোর্স হবে?
-করাপশন অধ্যায়ন করব আমরা। এ ইতিহাস, সাহিত্য, সিনেমা কোনো কিছুই বাদ দেয়নি। বাস্তব ঘটনা তো আছেই। ভারতের কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত ঘুষের কথা থেকে বর্তমানে জেফরি আর্চারের গল্প, হলিউডি মুভি—সব কিছুই ওর চোখে ধরা পড়েছে। করাপশন বন্ধের জন্য ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন কাজে লাগানোর কথাও এনেছে সে।

ভদ্রলোক শুনতে আগ্রহী হলেন। আমার নাতিদীর্ঘ উপস্থাপনার শেষে দুজনেই খুশি হলেন। নতুন ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, আচ্ছা, কোর্স চালু না হলে এই ম্যাটেরিয়ালের মালিক কে হবে?

—আমরা পারিশ্রমিক দিচ্ছি ওকে। সুতরাং, মালিক হব আমরা, মানে বিশ্ববিদ্যালয়।
—আমার মনে হয় এটা ওর ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি, সে যদি বই হিসাবে ছাপায়, তা কোর্সের কাজে যেমন লাগবে, আবার যার মেধাসম্পদ, তারই রইল। ঠিক তো?
অধ্যাপক ভদ্রলোক জোর গলায় সাতপাঁচ বুঝিয়ে পণ্ডিতের কথা উড়িয়ে দিলেন। এবার পণ্ডিত আমার দিকে ফিরে জানতে চাইলেন, এই সময়ে করাপশনকে নিয়ে কী ভাবনাচিন্তা চোখে পড়ছে, বল তো!

—গরিব দেশ নাইজেরিয়াও যখন করাপশন বা ঘুষের উৎস খুঁজে বের করতে চেঁচাচ্ছে, তখন ঘুষকে ব্যবসা পাওয়ার কমিশন আখ্যা দিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা হচ্ছে। একদিন করাপশনকে ইন্সটিটিউশনালাইজ করার সূক্ষ্ম ছলচাতুরী হবে, করাপশনকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার কথা বলা মানে করাপশনকে কিছুটা সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার মনোবৃত্তি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।

আমার তৈরি, দলিল-দস্তাবেজ সব অধ্যাপককে বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে এলাম। বেশ কিছুদিন পর ঘুরতে ঘুরতে ঐ পথে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, দেখি অধ্যাপক কোর্সটি চালু করতে পারলেন কি না। গিয়ে শুনি ভদ্রলোক বেশ আগেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে অন্য দেশে চলে গেছেন। করাপশনের উপরে ওরা কোর্স অফার করছে কি না, জানতে চাইলাম। এটাও বললাম যে সেই ভদ্রলোক আমাকে দিয়ে কোর্স ম্যাটেরিয়াল তৈরিসহ এ বিষয়ে অনেক কাজও করিয়েছিলেন।

প্রশাসনের দায়িত্বশীল লোকটির উত্তর শুনে আমি স্তম্ভিত!
—ভীষণ করাপটেড লোক ছিল সে। ডিপার্টমেন্টের টাকায় নিজের অনেক কাজ করিয়ে নিত। দেখে নিয়ো ওই কাজ সে নিজের নামেই পাবলিশ করবে একদিন।