লারু ও আমাদের চিন্তাধারা

আমরা যখন আমেরিকার টেক্সাসের গ্রেইপভাইনে থাকতাম, তখন আমি চার্চে ফ্রি ইংরেজি ক্লাস করতাম। বিনা পয়সায় সব ধর্মের মানুষদের ইংরেজি শেখানো ওদের খুব ভালো উদ্যোগ। যা–ই হোক, ওখান থেকে লারু উইলিয়ামসনের সঙ্গে পরিচয় হয়। উনি আমার শিক্ষক ছিলেন। ৭৫ বছরের প্রাণোচ্ছল এক মহিলা। কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য মনে দাগ কাটেন, উনি ঠিক তেমন একজন। ওনার স্বামীকে চার্চে বড়দিনের গান গাইতে দেখতাম, ভালো মানুষ ছিলেন। পরে আমার বাচ্চাকাচ্চা হলো, জব হলো, তাই আমি সময় করে ওখানে যেতে পারি না। ফেসবুকে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ হতো। ওনাদের আপডেট পেতাম। হঠাৎ ২০১৮ সালে দেখি ওনার স্বামী মারা গেছেন। আমার খুবই কষ্ট লাগল। আমি লারুকে মেসেজ দিলাম। উনি যথারীতি সুন্দর করে উত্তর দিলেন।

ফেসবুকে দেখতাম ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে ভালোই আছেন লারু উইলিয়ামসন। ২০২২ সালে উনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন—তিনি আবার বিয়ে করছেন, বিয়ে অক্টোবরে! আমি বেশ নড়েচড়ে বসলাম, বলে কি! ৮১ বছর বয়সে বিয়ে! কিছু জিজ্ঞাসা করার মতো কথা নয়, তবে যা অনুমান করলাম, উনি যেহেতু ধার্মিক মানুষ তাই নিয়মিত চার্চে যেতেন। হয়তো স্বামীর মৃত্যুর পর আরও বেশি যেতেন।

ওখানে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় চার্লির সঙ্গে। চার্লির স্ত্রীর মৃত্যু হয় ২০১৯ সালে। দুজন একাকী মানুষের পরিচয় হয়। কথা থেকে দুজনের ভালো লাগা সৃষ্টি হয়, তারপর তাঁরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন।

ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল! আমাদের দেশে হলে কী হতো? সমাজ ছি! ছি! করত, ছেলেমেয়েরা আপত্তি করত, ফলে যা হওয়ার তাই হতো, দুজন একসঙ্গে থাকার চিন্তা বাদ দিতেন।

এখানে যা হলো দুইপক্ষের ছেলেমেয়েরা খুবই আনন্দের সঙ্গে তাঁদের গ্রহণ করলেন আর ধর্মীয় রীতিতে ওনাদের বিয়ে হলো। বিয়ের সময় বরের বয়স ৮৯, স্ত্রীর ৮১! ব্যাপারটা ভালো লাগল। আমি বিয়ের লাইভ দেখলাম। যা আমি সচরাচর করি না, কিন্তু সেদিন করতে ইচ্ছা হলো। লাইভে দেখি বর যেন তরুণ ছেলের মতো খুশি নতুন সহধর্মিণীকে পেয়ে। আমাদের দেশে কয়েক বছর আগে একজন কথাসাহিত্যিকের প্রথম স্ত্রী আবার বিয়ে করেন ৬০–এর মতো বয়সে। সমাজ এটি সহজভাবে নেয়নি।

আমারই আপনজন বলল, ‘এই বয়সে ওনার বিয়ে করে কী লাভ হলো? ব্যাপারটা কেমন।’ আমি তখনই বুঝেছি, আমাদের সমাজ বদলাতে আরও অনেক যুগ লাগবে। ‘ব্যাপারটা কেমন’ দূর হতে বহুদূর যাওয়া বাকি। এই যে লারু দ্বিতীয় বিয়ে করলেন, এতে যে তিনি তাঁর প্রথম স্বামীর সব ছবি ডিলিট করে দিয়ে নতুন স্বামীকে নিয়ে গদগদ পোস্ট দিচ্ছেন, তা কিন্তু নয়। সবই আগের মতো আছে শুধু তাঁর নিঃসঙ্গতা দূর হলো। বিয়ের পর তাঁকে আমি মেসেজ দিয়ে বললাম, ‘তোমার বিয়েটা আমাকে নতুন করে অনেক কিছু শেখাল। আমি যদি কিছু লিখি, তাহলে তোমাদের বিয়ের একটি ছবি ব্যবহার করতে চাই।

গোপনীয়তা রক্ষার জন্য ছবির মুখ অস্পষ্ট করে দেব।’ উনি বললেন, ‘অস্পষ্ট কর না, এমনই পোস্ট দাও।’ ছবিতে আপনারা দুজন নতুন বিবাহিত দম্পতিকে দেখছেন। প্লিজ ওনাদের জন্য দোয়া করবেন।

  • লেখক: অপলা হায়দার, ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র