১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট: আমার লেখা একটি চিঠি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম যদিও, তখন ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার কথাই আমার এখনো মনে আছে। সেই  সময় বাড়িতে আমাদের একটি রেডিও ছিল। প্রতিদিন রেডিওতে বাবা এবং আশপাশের অনেকে সংবাদ শুনতেন। বড় বোনেরা শুনত গানের অনুষ্ঠান দুর্বার। মাঝেমধ্যে বাংলা নাটক শোনার কথাও মনে আছে।

যেদিনের কথা বলছি, সেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বড় বোনদের কেউ একজন রেডিওতে টিউনিং করছিল গান শোনার জন্য। সময় সঠিক মনে নেই। তবে সকালবেলা রেডিও অন করতেই শুনতে পাই, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার সংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে বোনেরা চেঁচিয়ে বলল, এই, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। সেদিনের সেই চিৎকার দিয়ে বলা বোনদের দুঃসংবাদটির কথা এখনো আমার কানে বাজে। কোনোভাবেই আমি সেদিনের অপ্রিয় সেই সত্য কথাটি ভুলতে পারছি না।

যুদ্ধ চলাকালে আমরা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা রেডিওতে দেশের অভ্যন্তরে কোথায় কী ঘটছে, তা শুনেছি। সেই থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নিয়মিত সংবাদ শুনেছি। বাড়িতে বাবা ছিলেন সংবাদ শোনার পাগল। বোনেরা ছিল দুর্বার অনুষ্ঠান শোনার পাগল। সন্ধ্যার পর দুর্বার শুনে রেডিও বিছানায় নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত। সকাল হলে বাবা এসে বোনদের বিছানা থেকে রেডিও চেয়ে নিতেন কিংবা আগে কেউ উঠলে বাবাকে আবার সকালের সংবাদ শোনার জন্য রেডিও নিয়ে দিত। যে কারণে সেদিন বোনেরা সংবাদ পাঠ করার সময়ের আগে রেডিও অন করে অন্য কোনো অনুষ্ঠান শুনতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের সংবাদটি শুনেছিল।

ঘটনার আগের দিন ১৪ আগস্ট, বাবা বাজার থেকে অনেকগুলো অ্যারোগ্রাম কিনে এনেছিলেন। বড় ভাই তখন থাকেন লন্ডন। ছুটিতে দেশে এসে বিয়ে করে বাড়িতে নতুন বউ রেখে আবার লন্ডন ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর সেই ঘটনা। বড় ভাইকে প্রায়ই বৌদি, বাবা-মা সবাই নীল খামে (এয়ারমেইল) বা অ্যারোগ্রামে (চিঠি লেখার নীল কাগজ) চিঠি লিখতেন। আগের দিন রাতে একটি অ্যারোগ্রামে বৌদি, বাবা-মা অল্প কথায় চিঠি লিখে আমার জন্য কয়েক লাইন লেখার স্পেস রেখেছিলেন। আমি যেহেতু ছোট ছিলাম, হয়তো আদর করার কারণেই সেই অ্যারোগ্রামে চিঠি লেখার সুযোগ দেওয়া। সবাই বলাবলি করছিলেন, আমি লিখলেই অ্যারোগ্রাম বন্ধ করে তা পোস্ট করবেন।

সকালবেলা সেই সংবাদ শোনার পর বাড়িতে শুরু হয় একধরনের অস্থিরতা। চারদিকে চলতে থাকে কানাঘুষা। অদৃশ্য কোনো কারণে সবার মনে তখন ভয় আর আতঙ্ক। ভয়ে কেউ মুখ খুলছিল না। সকালে আমি স্কুলে যাওয়ার আগে বৌদি আমাকে বলছিলেন দাদাকে চিঠি লিখতে। সেদিনই বাবা বাজারে নিয়ে এই অ্যারোগ্রামে লেখা চিঠি পোস্ট করার কথা। আমি বৌদির আদেশ মান্য করতে লিখে ফেললাম কয়েক লাইনের চিঠি। সেই চিঠি পড়ে বাড়িতে শুরু হয়ে গেল অন্য রকম কানাঘুষা। কোথায় আমাকে বাধ্য ছেলের মতো সবাই আদর করবে, তা না করে উল্টো রাগারাগি করতে শুরু করলেন আমার সঙ্গে বাবা এবং অন্যরা। যত দূর মনে পড়ে, সেদিন সেই চিঠি আর লন্ডনে বসবাসরত বড় ভাইয়ের উদ্দেশে পোস্ট করলেন না বাবা। তাঁদের সবার ভেতরে নাকি প্রচণ্ড এক ভয় কাজ করেছে। সবাই বলছিলেন, সেই চিঠি পোস্ট করলে বাড়িতে পুলিশ এসে সবাইকে নাকি ধরে নিয়ে যাবে। বারবার বাবা বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কারণে ঢাকায় জিপিওতে চিঠি খুলে পড়া হবে। এই চিঠি পড়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা দেখতে পেলে সবারই বিপদ হতে পারে, এমন অজানা ভয়ে ভীত ছিলেন পরিবারের বড়রা।

চিঠিতে আমি লিখেছিলাম, দাদা তোমার প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে।

এটাই নাকি ছিল তখন আমার অপরাধ। লাইনটি লেখার কারণে সেদিন অ্যারোগ্রামে লেখা সেই চিঠি আর পোস্ট করা হয়নি। বলা হয়েছিল, আমার জন্য এত টাকার একটা অ্যারোগ্রাম নষ্ট করা হয়েছে। শাস্তিস্বরূপ আমাকে আর কখনো অ্যারোগ্রামে চিঠি লিখতে দেওয়া হবে না। আমার সেই দিনের এই কষ্টের কথা পরবর্তী সময়ে কাউকেই আর বলা সম্ভব হয়নি। আস্তে আস্তে যতই বড় হলাম, কষ্ট যেন মনে জমাট বাঁধতে থাকল। স্কুলজীবন শেষ, এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হলাম। বড় ভাই এর মধ্যে দেশে ফিরলেন। দেশে এসে ব্যবসা করার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়ালেন। যে কারণে দেশের নানা শ্রেণির লোকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, সম্পর্ক। বলা যায়, বড় ভাইয়ের বদৌলতে দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের খুব কাছ থেকে দেখার এবং কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের প্রায় সবারই আনাগোনা ছিল বড় ভাইয়ের বাসায়।  

আমার যতটা মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমি প্রথম তর্ক করি দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক ভয়েস অব আমেরিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি প্রয়াত গিয়াস কামাল চৌধূরীর সঙ্গে। এরপর উনার পরামর্শে বিষয়টি সম্পর্কে আরও বেশি জানার জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের সঙ্গে নানাভাবে নানা সময় দেখা করে কথা বলেছি। কথা বলেছি তাঁর বিরোধী আদর্শের রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও।

কলেজজীবন থেকে লেখক-সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ছিলাম বদ্ধপরিকর। যে কারণে নানা সময় চলে যেতাম দেশের বিভিন্ন রাজনীতিবিদদের কাছে। সেই সময়; অর্থাৎ দেশে থাকাকালে আমার থেকে বয়সে বড়দের সঙ্গে, বিশেষ করে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন কিংবা দেশের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কারও সঙ্গে দেখা হলেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা করে নানা প্রশ্নবাণে ভাসিয়ে দিতাম তাঁদের। বেশির ভাগ সময় আমাকে থামিয়ে দেওয়া হতো। তাঁরা বলতেন, বেশি করে পড়াশোনা করতে। নিজেই একসময় সত্য ঘটনা উদ্‌ঘাটন করতে পারব। এমনকি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালে একবার বঙ্গভবনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তখন রাষ্ট্রপতির হাত ধরে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, হলঘরে বিভিন্নজনের ছবি থাকলেও বঙ্গবন্ধুর ছবি নেই কেন। তাঁর উত্তর ছিল একই। তুমি অনেক ছোট, বড় হও, পড়াশোনা করো, একদিন তুমি নিজেই জানতে পারবে সব ঘটনা।

সেদিন আমাকে এমন প্রশ্ন করতে শুনে উনার সঙ্গে থাকা কয়েকজন লোক (সিকিউরিটি) আমার দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে শাসাচ্ছিলেন। ভাগ্য ভালো, সেই যাত্রা আমি রক্ষা পাই। কারণ, বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক প্রয়াত সমর দাস উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তাঁর নজরে বিষয়টি এলে তিনি এগিয়ে এসে আমাকে সেভ করেন।

১৯৯১ সাল থেকে আমি জাপানপ্রবাসী। জাপানে আসার পরও চেষ্টা করেছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু এখানে কিংবা ওখানে (দেশে) কোথাও আমি আমার ইচ্ছার বিষয়টি উপস্থাপনের সুযোগ পাইনি। যেখানেই গিয়েছি সর্বত্রই দেখেছি, প্রকৃত আওয়ামী লীগারের অভাব। তেলবাজদের জয়জয়কার। যাঁরা প্রকৃত কাজ করার লোক, তাঁদের কাজে সুযোগ করে দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো যেন বাধাগ্রস্ত করে। তাই এখন পর্যন্ত কাজটি করতে আমি ব্যর্থ। যে কারণে আমি সরে গিয়েছি আমার ইচ্ছাপূরণের স্বপ্ন থেকে। তবে আমার খুব ইচ্ছা, আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুযোগ পেলে বড় কোনো লেখা লেখব। যেখানে থাকবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করার শোকাবহ স্মৃতির কথা। যেখানে লেখা হবে আমার সেই চিঠি লিখে পোস্ট না করার দুঃখের কথা।