মালয়েশিয়ার কৃষি ও মৎস্যজীবীদের গ্রাম ‘সেকিনচান’

ছবি: লেখকের পাঠানো

চারদিকে দিগন্তজুড়ে ধানখেত। ডানে-বাঁয়ে-সামনে-পেছনে একই ধরনের একই আকারের ধানখেত। মৃদু বাতাসে হালকা দোল খাচ্ছে সবুজ ধানের শীষ। কোথাও কোথাও ধানের ফুল বেরিয়েছে। ধানের জমিগুলো ছোট ছোট নয়, একেকটা জমি মনে হয় কয়েক একর আয়তনের। প্রতিটা জমির চারপাশে আল নেই! বরং চারপাশে আছে ইটের সুরকি দেওয়া সড়ক। এই সড়কে ঘুরে ধানখেত দেখার জন্য পর্যটন-রিকশা ভাড়া নেওয়া যায়। নিজে প্যাডেল রিকশা চালিয়ে ছোট–বড় সবাইকে নিয়ে গ্রাম্য আবহাওয়া উপভোগ করছে মালয়েশিয়ান পরিবার। এ রকম কয়েক জমিকে ঘিরে আছে পিচঢালাই পাকা সড়ক। পিচঢালাই কালো সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বিশাল ধানখেতের পুরোটা ঘুরে দেখা যায়। ধানখেতের একদিক থেকে অন্যদিকে, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো যায়। কিছু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে বাংলোর মতো পাকা ঘর। ঘরগুলোতে সম্ভবত কৃষিকাজে নিয়োজিত মানুষেরা থাকেন আর ধান মাড়ানো ও ধান রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার হয়। সময়স্বল্পতার কারণে বিস্তারিত তথ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি আমাদের। তবে ধারণা করে যা বললাম, সেটাই সঠিক হবে।

ধানখেত ঘেঁষে আছে উন্নত মানের রেস্তোরাঁ। ধানখেতের আশপাশে মূল সড়কের পাশে অনেক খাবারের দোকান আছে। রেস্তোরাঁগুলোয় সি ফুড খাওয়ার জন্য দূরদূরান্তের মানুষেরা আসে। ধানখেত ঘেঁষে আছে ফটোসেশন করার মতো নানা স্থাপনা। ধানখেতকেও পর্যটন স্পটে রূপান্তর করা যায়, এটা এই প্রথম দেখলাম সেকিনচানে এসে।

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের চারপাশ ঘিরে আছে সেলাঙ্গর প্রদেশ। এই সেলাঙ্গরের শেষ প্রান্তের এক জায়গার নাম সেকিনচান। জায়গার নামটা শুনতে চমৎকার। আমাদের দেশে চায়নিজ ভাষার শব্দ একেবারে না জানা মানুষেরা যেভাবে মশকারা করে চায়নিজ ভাষা উচ্চারণ করে, ঠিক সে রকম একটা শব্দ যেন ‘সেকিনচান’। অথবা বাংলা সিনেমায় নায়িকা শাবনূরের বড়লোক পিতা ভিলেন রাজীবের সঙ্গে চীন দেশ থেকে আসা ব্যবসায়ী সেজে কাবিলা যেভাবে চায়নিজ ভাষা বলেন, ঠিক সে রকম।

এক শনিবার বিকেলে মাকে নিয়ে আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম সেকিনচান। কুয়ালালামপুর থেকে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে যাওয়ার সময় কুয়ালালামপুরের পরে ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালালেই সেলাঙ্গর প্রদেশও পার হওয়া যায়। কিন্তু সেকিনচানে যাওয়ার সময় বুঝলাম সেলাঙ্গর প্রদেশের এই পাশটা অনেক বড়। কুয়ালালামপুর থেকে আমরা সেকিনচানে যাচ্ছিলাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেলে’। মালয়েশিয়ায় চলছিল দীপাবলির ছুটির সময়। তাই হয়তো হাইওয়েতে গাড়ির জ্যাম ছিল। ‘হয়তো’ বলছি এই কারণে, যাওয়ার পথে আমাদের মধ্যে ঘটে এক ঘটনা, যা আমাদের জন্য অভূতপূর্ব না হলেও কিছুটা ব্যতিক্রম বটে। ছোট ভাই নাছির গাড়ি চালাচ্ছিল, আমি সামনে বসা। পেছনে মা, নাছিরের স্ত্রী, আট বছরের সুইটকিডস আলী ও দুই বছরের পুতুল আলিয়া।

ছবি: লেখকের পাঠানো

মালয়েশিয়ায় গত এক দশক থেকে মানুষ গাড়ি চালায় ওয়াইজ ব্যবহার করে। বা গুগল ম্যাপের মাধ্যমে। ওয়াইজ যে দিকে পথ দেখায়, চালক গাড়ির স্টিয়ারিং সেদিকে ঘোরায়। মাঝেমাঝে নানা কারণে ওয়াইজ এমন পথ দিয়ে নিয়ে চলে যে পথে ঢুকলে ভয় লাগে এমন। এমনই এক পথ দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল সেদিন এই ওয়াইজ। যেন পথ হারিয়ে বনের পথে পথে দিশাহারা হয়ে ঘুরছি আমরা। দুপাশে ঘন বন, সরু রাস্তা। খুবই ঘনঘন বাঁক, প্রতি মিনিটে ২–৩টা বাঁক, গাড়ি চালাতে হচ্ছে ধীরে। পথে তেমন গাড়ি নেই। মাঝে মাঝে দু–একটা দেখা যাচ্ছে। পথের ধারে ধারে পাহাড়ি বাঁদর বসে থাকে মানুষের মতো করে। তবে কোনো মানুষের দেখা নেই। দোকানপাট নেই। এভাবে পথ চলতে হয়েছে ১২–১৩ কিলোমিটার। একসময় এই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে গাড়ি চলে আসে গ্রামের মতো জায়গায়। এখানে এসে মানুষ, বাড়িঘর ও দোকানপাটের দেখা মিলেছে। এরপর গাড়ি নিয়ে গেল একেবারে সরু গ্রাম্য পথ দিয়ে কয়েক কিলোমিটার। পরেই গাড়ি তুলে দিল হাইওয়েতে। পাশে রেস্তোরাঁ ও দোকানপাট দেখতে পেয়ে থামলাম আমরা। রেস্তোরাঁয় বসে চা-নাশতা খেলাম, একটু আরাম করলাম। পাহাড়ি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসায় (যদিও গাড়ি করে আসা) মনের ভেতর যে ক্লান্তি ও কালো মেঘ জমেছিল, তা কাটার পর আমরা আবারও রওনা দিলাম সেকিনচানের দিকে ওয়াইজের দেখোনো পথ হাইওয়ে ধরে। পরবর্তী ৩৫ মিনিটের মধ্যে আমরা প্রথমে পৌঁছে যাই ‘পানতায় রেডাং সেকিনচান’। পানতায় মানে হচ্ছে সৈকত। সেকিনচানে শুধু ধানখেত নয়, আছে সমুদ্রসৈকতও। পানতায় রেডাং বিচের বাইরে দোকানপাটগুলো দেখে মনে মনে ভাবছিলাম, এটা তো দেখতে আমাদের পতেঙ্গার মতো। সাথে সাথে ছোট ভাই নাছিরও বলে উঠল, এখানে অনেকটা পতেঙ্গার মতো। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত কিন্তু এখন অবশ্যই আগের মতো নেই, উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। পতেঙ্গায় দোকানপাটগুলো রেডাং বিচের মতো ছিল নব্বইয়ের দশকের দিকে। রেডাং বিচে তেমন বেশি পর্যটক নেই। সেকিনচানে ও সেকিনচানের আগের গ্রামগুলোতে প্রচুর নারকেলগাছ আছে। গাছে গাছে ডাব ও নারকেলে ভরা। ভাবছিলাম এখানে হয়তো ডাবের দাম একটু কম হবে। কিন্তু না, বরং কুয়ালালামপুরের ৫ রিঙ্গিতের ডাব এখানে ৬ রিঙ্গিত।

সমুদ্রের তীর ঘেঁষে সেকিনচান গ্রামটির মাঝবরাবর চলে গেছে বড় রাস্তা। সড়কের বাঁ পাশে সৈকতের তীরে গড়ে উঠেছে জেলেপাড়া। সেকিনচান পৌঁছানোর পর এই পাশ থেকে নাকে আসে মাছের তীব্র গন্ধ। এখানে আছে মাছের অসংখ্য আড়ত। মাছের গন্ধ পেয়ে মনে হচ্ছিল আমরা চট্টগ্রামের ফিশারি ঘাটে আছি। চারদিকে মাছের গন্ধ।

ছবি: লেখকের পাঠানো

রাস্তার অন্য পাশে ধানখেত। একটা সত্যিকারের গ্রাম যেন সেকিনচান। পরে গুগল করে দেখলাম, এই সেকিনচান এখনো মালয়েশিয়ার অন্যতম ধান উৎপাদনের স্থান। এখানকার জমি ধান উৎপাদনের জন্য মালয়েশিয়ার অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি উর্বর।

সেকিনচানে যাওয়ার সময় বনজঙ্গলের মাঝ দিয়ে ছোট সড়ক ধরে আসার সময় আমরা ভেবেছিলাম ফেরার সময়ও হয়তো একই রাস্তায় ফিরতে হবে। এ জন্য সন্ধ্যার পরপর আমরা দ্রুত ফেরার পথ ধরেছি। তাই আরও সময় নিয়ে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের এই ধানখেত আর মৎস্যজীবীদের গ্রাম খানি প্রাণ জুড়িয়ে দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া। ফেরার সময় ওয়াইজ আমাদের এনেছে সরাসরি হাইওয়ে ধরে। আর কোনো বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসতে হয়নি। বড় রাস্তায় সাঁইসাঁই করে গাড়ি চালিয়ে কথা বলতে বলতে ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মধ্যে আমরা ফিরে এলাম প্রবাসের ব্যালকনিতে। যাওয়ার সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা।

পর্যটনশিল্পের আদলে গড়া ধানখেত, জেলেপল্লি, মৎস্য আড়ত, সৈকত, গ্রামে শহুরে ছোঁয়া—সবকিছু মিলে সেকিনচানকে মন ভরে দেখার জন্য, জানার জন্য আরেক দিন যেতেই হবে। সেকিনচানকে জানলে মালয়েশিয়ার মাটিগন্ধা সংস্কৃতির নির্যাস কিছুটা হলেও হৃদয়ঙ্গম হবে।

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]