বল্টুর নতুন ধান্ধা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মার্চ মাস। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। সকাল থেকেই তুষারপাত হচ্ছে। জানালার পাশে বসে তুষারপাত দেখছি। পাতাশূন্য গাছে তুষার পড়ে পাথর হয়ে গাছের ডালপালাসহ পুরো গাছটা যেন এক বরফের গাছ হয়ে গেছে। প্রকৃতির এই অপরূপ রূপ দেখছি আর মনে মনে শামসুর রাহমানের কবিতা ‘কে যেন তরঙ্গ তোলে কুয়াশায়’ মনে মনে আওড়াচ্ছি, এমন সময় ভাগনে বল্টুর ফোন।

মামা কেমন আছেন?

এই তো, ঠান্ডা, তুষারপাত

কী যে বলেন মামা, ঠান্ডা তো চলে যাচ্ছে।

যাচ্ছে যাচ্ছে বলেও তো আর যাচ্ছে না। আচ্ছা বলো, তোমার খবর কী?

না মামা, ভাবছি একটা অনুষ্ঠান করব।

তা তো তুমি প্রতিবছরই করো, তো এবার কী ধরনের অনুষ্ঠান করবে বলে মনস্থির করেছ।

পুরস্কার বিতরণী।

সেটা তো এবার প্রচুর হয়েছে।

না মামা আমার অনুষ্ঠান হবে ব্যতিক্রমী।

সেটা কী রকম

এই ধরেন কমিউনিটিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বিশেষ পুরস্কার।
সবকিছুতেই বিশেষ বিশেষ বলে বিশেষ শব্দটারই বিশেষত্বের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছ।
আরে না মামা এবারের অনুষ্ঠান হবে ফাটাফাটি, আলোঝলমল, জাঁকজমকপূর্ণ।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু এই ফাটাফাটি অনুষ্ঠান করতে তো অনেক খরচ—হল ভাড়া, সাউন্ড সিষ্টেম, পুরস্কার, খানাপিনা, গানবাজনা।
এসবের কোনো চিন্তা নেই মামা।
কেন?

ওই যাদের পুরস্কার দেব তাঁদের কাছ থেকে ৩০০ ডলার করে নেব।
এটা কেমন কথা?

আরে মামা দিন এখন পাল্টেছে, কইয়ের তেলে কই ভাজা আর কি, অন্তত ৩০ জন এক পায়ে লাইনে খাড়া আছে, টাকা দিয়ে পুরস্কার নিতে।
ভালো, তো অপাত্রে পুরস্কার দিচ্ছ না তো।

আরে মামা পাত্র আর অপাত্র, এখন তেল পানি সমান দর, কে দাতা আর কে গ্রহীতা বোঝার কোনো উপায় নেই। সবই ধুলায় অন্ধকার।

ভালো, সমাজ–সংস্কৃতি এগিয়ে চলেছে তোমাদের মতো ক্ষণজন্মাদের কারণে, তো এত এত পুরস্কার, বিতরণ করবে কে?

মামা গরিবের বন্ধু, যার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র আমাদের এলাকার বড় নেতা মফিজ ভাই, এ জন্য তার কাছ থেকে নেব ১ হাজার ডলার, বিশেষ অতিথি থাকবেন কমিউনিটির বহুরূপী নেতা আমাদের চটকু ভাই, তিনি দেবেন ৫০০ ডলার। হল ভাড়া দেবেন বিল্টু চাচা—এই শর্তে যে তিনি ১০ মিনিট বক্তব্য দেবেন। কমিউনিটির উদ্দেশে, তিনি এই কমিউনিটির জন্য কি বিরাট বিরাট কাজ করেছেন, আপনারা কষ্ট করে কানে তুলা দিয়ে এ সময়টা পার করতে হবে। কারণ, অনেক সময় বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়।

স্বার্থটা তো হবে তোমার, আমরা কষ্ট করতে যাব কেন?

মামা একটা কথা আছে না, সকলের তরে সকলে আমরা। তাহলেই না সমাজ, কমিউনিটি এগিয়ে যাবে। দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের নাম, হাঁকডাক।
ভালো, এত বড় অনুষ্ঠান প্রচার, প্রসারের কি কোনো ব্যবস্থা রেখেছ?

আরে মামা আমার প্রচার বাহিনী তো ভিডিও ক্যামেরা, ক্যামেরা নিয়ে রেডি, সরাসরি লাইভ হবে ফেসবুক, ইউটিউবে।

সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এত পুরস্কার প্রাপক, নেতা, উপনেতা, পাতিনেতা, সঞ্চালক, পরিচালক, বক্তা মঞ্চে উঠলে মঞ্চ না আবার ভেঙে পড়ে। এখন তো নেতাদের ভারে মঞ্চ ভেঙে পড়ার এক সংস্কৃতি আমরা দেখছি। ধরিত্রী যেন আর চাপ নিতে পারছে না।
আরে মামা কী যে বলেন, সমস্যাতো সেটা না, মূল সমস্যা হচ্ছে  দর্শক। এখন তো দর্শক পাওয়া যায় না। হাততালি দেওয়ার মানুষ নেই, সবাই নেতা, সবাই বক্তা। বক্তৃতা শোনার লোক নেই। দর্শক সারি, চেয়ার খালি পড়ে থাকে।

একটা কাজ করতে পারো, একটা ঘোষণা দাও— দর্শকদেরও পুরস্কার দেওয়া হবে, অবশ্য সবাই তো আর তোমার মতো ধান্ধাবাজ নয়।

মামা আপনি সব সময় বলেন নতুন কিছু করো, আমি যখনই ভালো একটা কিছু করার চেষ্টা করি, তখনই আপনি আমাকে বলেন ধান্ধাবাজ, দুই নম্বরি। আপনারা যদি আমাদের অ্যাপ্রিশিয়েট না করেন, তবে আমরা নতুন প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দেব কীভাবে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তা অবশ্য ঠিক। তো এই নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণের জন্য কোনো ব্যবস্থা—কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা রেখেছ কি?

আরে মামা নতুন প্রজন্মের এরা তো আসতে চায় না আমাদের এসব অনুষ্ঠানে।
আসবে কীভাবে, তারা এসেতো তোমাদের এই লম্বা বক্তৃতা, তামাশা দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গেছে।

মামা এবার কিন্তু আপনাকে আমাদের অনুষ্ঠানে আসতে হবে।

তা না হয় আসব।

আপনাদের উপস্থিতিতে আমাদের অনুষ্ঠান হয়ে উঠবে সুন্দর, সফল এবং অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে গড়বে এক নতুন মাইলফলক।
তা অবশ্য আমি দিব্যদৃষ্টি দিয়েই দেখতে পাচ্ছি।