ফটোগ্রাফিক মেমোরি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বাজারে এসে রাসেল কিছু জিনিস চোখ বন্ধ করে নেয়। যেমনটা প্রিয় রেস্তোরাঁয় গিয়ে পছন্দের খাবার অর্ডার দেওয়া হয়, অন্যকিছু খাওয়া হোক আর না হোক। আজকেও কাঁচাবাজারে ঢুকেই কলমিশাকের ওপর লোলুপ দৃষ্টি আটকে গেল। কলমিশাক রাসেলের ভালো লাগে। হালকা একটু তেল, একটু পেঁয়াজ–রসুন আর পোড়া মরিচ দিয়ে ৫ থেকে ১০ মিনিটে অসাধারণ এই খাদ্য তৈরি হয়। এরপর ঘুরতেই চোখে পড়ল তাজা ধনেপাতা! আহা! একেকটা পাতা নিজেদের মাঝে আড়াল করে চোখাচোখি করছে। একথাবায় এক আঁটি নিল রাসেল।

রাসেল ভুলোমনা। কথা ভুলে যায়, বাজারের লিস্ট ভুলে যায়, কাজ ভুলে যায়। যদিও রাসেল একমত নয় এ অপবাদের সঙ্গে। এই তো কিছুদিন আগেই স্ত্রী মিতু কাঁচা হলুদ আনতে বলল রূপচর্চা করবে বলে। রাসেল বলল, ‘তুমি চা বসাতে থাকো, হালকা বাজারও নিয়ে আসব। এই গেলাম।’ সেদিন একদম সব আনা হয়েছিল। এমনকি ভবনের দারোয়ান চাচার জন্য পান পর্যন্ত এনেছিল রাসেল, কিন্তু কাঁচা হলুদ আনা হয়নি।

মিতু ওই দিন অনেক রাগারাগি করেছিল এই ভুলে যাওয়া নিয়ে। বানানো চা বেসিনে ফেলে দিল। পরে চায়ের পাতিল রাসেল নিজেই মেজে সাজিয়ে রাখল। আর ভাবল, ‘হলুদ তো নিলাম মনে হলো, কিন্তু ব্যাগে নাই কেন?’ কিন্তু মিতুর চোখের মধ্যে আগুন দেখে ভয়ে সোজা নিচের দোকানে আবার গেল। ভেবেই চলেছে, কীভাবে হলুদ মিসিং হলো?

গোয়েন্দা বই পড়তে পড়তে বড় হওয়া রাসেল গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়েই দোকানদারকে বলল, ‘হলুদ দ্যান!’ দোকানদার গুঁড়া হলুদ দিতে দিতে বলল, ‘কতটুকু দিতাম ভাই?’ বজ্রপাত এসে আঘাত করল যেন তাকে। রাসেল এখন অন্য এক দুনিয়ায়। কোন হলুদ নিতে সে এসেছিল? উত্তেজনায় ঘেমে গেছে সে। কিন্তু গোয়েন্দার মন তার, বুদ্ধির নেই অভাব।

যদিও সেটা কেউ মানে না, কিন্তু রাসেল নিজে বিশ্বাস করে তার অনেক ইন্টিলিজেন্স আছে! ভারিক্কি গলায় বলল, ‘গুঁড়া হলুদ আধা কেজি আর কাঁচা হলুদ পাঁচ থেকে ছয় পিস!’ এ দুই ধরনের হলুদ ছাড়া আল্লাহর রহমতে আর কোনো হলুদ নেই—এটা ভেবে চোখে খুশিতে জল এসে গিয়েছিল সেদিন রাসেলের। মিতুর রাগ আবার বেশিক্ষণ থাকে না! এ ঘটনার ঘণ্টাদুয়েক পরই হিন্দি গান চালিয়ে দুই গালে হলুদ মেখে গুনগুন করে গান গাইছিল! এভাবে আরও কত ঘটনা ঘটে গেল রাসেলের ভুলোমন নিয়ে, তার ইয়ত্তা নেই।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ইদানীং মিতু বাজারের ফর্দ পকেটে দেয়, মুঠোফোনেও মেসেজ পাঠায়। আজ শুক্রবার ছুটির দিনে দুই ধরনের ডিজিটাল ও অ্যানালগ ফর্দ নিয়ে রাসেল বাজার করছে। সব মোটামুটি নেওয়া হলো। রাসেল খুব প্রো মুডে এক এক করে লিস্ট মিলিয়ে দেখল। একেকটার নাম বলে ব্যাগে হাত দিয়ে ওই জিনিস ধরে আর নিজেই নিজের মাথা নাড়ায়। যেমন আলু বলেই ব্যাগের আলুর গায়ে হাত দিল, কাঁচা মরিচ বলে একটা বের করে আবার ছেড়ে দিল ব্যাগে। মনে হলো প্রতিটা আইটেম রাসেল ডাকলেই বলছে ‘জি, জনাব, ব্যাগে আছি।’ সব ক্রস চেক করে দুই হাতে বাজারের ব্যাগ হাতে সদর্পে বাসার দিকে হেঁটে যেতে লাগল।

মিতু সব বাজার চেক করে দেখল ঠিক আছে। এমনকি হাতে লেখা লিস্টও বাজারের ব্যাগের মধ্যে। সব কটির পাশে টিক চিহ্ন! মিতু রান্নাবান্না শেষ করে গোসল করতে যাবে বলে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে যাওয়ার আগে বলল, ‘বাজার সব ঠিক ছিল আজ। কলমিশাকগুলো অনেক তাজা ছিল আর মজা করেই ভাজি করেছি, শুকনা মরিচও টেলে রেখেছি, আমি গোসল শেষ করে এলে খাব একসঙ্গে। ওকে। রাসেল বিজয়ীর হাসি হেসে বলল, ‘নো প্রব্লেম মাই লাভ! বাজারের দু–একটা জিনিস ভুলে না আসতেই পারে, কিন্তু আমার যে সব মনে থাকে, তা তো তুমি জানো! কি? দেখলে তো?’ রাসেলের চওড়া হাসি মুছে যাওয়ার আগেই মিতু বলল, ‘হুম! তা বুঝলাম, কিন্তু একটা ফুল তো আনতে পারতে আমার জন্য? নাকি ভুলেই গেলে এমন একটা দিন?’

দৌড়ে খবরের কাগজ নিল রাসেল। কী বার আজ? কত তারিখ? কী হয়েছিল আজ? কী? মিতু বাথরুমের দরজা একটু জোরেই লাগাল। সেই শব্দেই বলা যায় কাকতালীয়ভাবে রাসেলের মনে পড়ল আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী। না না, বিয়ের নয়! আজ ২৯ জুলাই! ঠিক পাঁচ বছর আগে এই দিনে ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল। প্রেমের অফিশিয়াল ডে বলা যায়! রোলার কোস্টার অনেক ওপরে উঠে ধাম করে যখন নিচে পড়ে, তখন এক হ্যাঁচকা টান লাগে কলিজায়, হাত–পা টানা দিয়ে সব ভয়–উৎকণ্ঠা সারা শরীরে দৌড়াদৌড়ি করে। রাসেলের এখন সেই অনুভূতি হচ্ছে। এটা সে কি করে করল? পাঁচ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে সে ফুল না এনে কলমিশাক আর ধনেপাতা আনল?

রাসেল আস্তে করে দরজা বন্ধ করে বাহিরে এল। সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় যেতে যেতে লজ্জায় শুয়ে যাচ্ছে প্রায়। কী উত্তর দিবে মিতুকে আজ? এই ভুলের জন্য মিতু কত দিন রাগ দেখাবে এবং কোন প্রকারের রাগ দেখাবে? নাকি রাগ না দেখিয়ে মন খারাপ হবে? নিমিষেই নিচতলার মেইন গেটের সামনে আসতেই দেখল দারোয়ান চাচা আগায়ে আসতেছে গেট খুলতে। উনি অনেক ছিদ্রযুক্ত স্যান্ডো গেঞ্জির সামনের দিকে হাত ঢুকায়ে চুলকাচ্ছেন আর হেঁটে এগিয়ে আসছেন। ওনার প্রতিটা হাত চালানোয় এক অদ্ভুত জঘন্য শব্দ তৈরি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ কৈ মাছ অমসৃণ পাকার ওপর ডলে পরিষ্কার করছে। একপর্যায়ে কৈ মাছ ডলা থামল।

চাচা ধীরে ধীরে দরজা খুলে হেসে বললেন ‘ভাইজান? আজকে পান আনেন নাই গো! ভুইলা গ্যাছেন?’

  • লেখক: মাঈনুল ওয়াদুদ সুমন, ডার্টফোর্ড, যুক্তরাজ্য