আত্মজা এবং অভিবাসী মন

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

লার্নারস পারমিটের জন্য লিখিত পরীক্ষা দিয়ে শানু ডিএমভি অফিস থেকে বের হয়ে এল। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার পূর্বশর্ত হলো ‘লার্নারস পারমিট’ অর্জন করা। হাতে ধরা অর্জিত এ পারমিটের ওপর বারকয়েক চোখ বোলানোর পর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে নিরাপদে তা সংরক্ষণ করল ও। হাতের চেটো দিয়ে ব্যাগ থাবড়িয়ে আবারও পরোক্ষ করে নিল, খচখচ শব্দে প্রমাণ মিলল, যথাস্থানে আছে কাগজটি। এখন আর ওর ক্যালিফোর্নিয়ার রাস্তায় গাড়ি চালানো শিখতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বাধা নেই!

গত কয়েক দিন যথেষ্টই খেটেছে ও, এই টেস্টের জন্য। কাজ থেকে এসে রান্না ও ঘরের টুকটাক কাজ সেরে ‘ডিপার্টমেন্ট অব মোটর ভেহিকেলসের’ নিয়মকানুন-সংবলিত স্টাডি গাইডটি নিয়ে বসত। বড় মেয়ে আরোহী আশ্বস্ত করেছিল, ‘মা, রিলাক্স থাকো। ছয় থেকে সাতটি প্রশ্নের ভুল উত্তর দিলেও পাস করতে পারবে তুমি।’

তবে এ বয়সে শানু কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। ফলাফল, ৪৬-তে ৪৬-ই পেয়েছে ও। মনটা এখন লটারি জেতার মতো আনন্দের তুঙ্গে না ভাসলেও একটা ভালো লাগা বোধ ওর মনে ছড়িয়ে পড়ল। যেকোনো অর্জন আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। গত নয় মাসের প্রবাসজীবনে এ ধরনের অর্জনের স্বাদ খুব একটা পায়নি ও। তাই আত্মবিশ্বাসের পারদ এখন বেশির ভাগ সময়ই থাকছে হিমাঙ্কের কাছাকাছি। আজকের প্রাপ্তিটা সে জন্যই উপভোগ করতে চায় শানু। যদিও মস্তিষ্ক তাঁকে বারবারই তাগাদা দিচ্ছে, ‘আসল পরীক্ষা তো সামনে। দেশে কখনো ড্রাইভিং সিটেই বসোনি, আর এখন আমেরিকার রাস্তায় “রোড টেস্টে” পাস করবে কীভাবে?’

পেছনে ঝরা পাতার মর্মর শব্দে ঘাড় ঘোরাল শানু। শুকনা পাতা মাড়িয়ে ইতস্তত পায়ে এগিয়ে আসছে ছেলেটি। মাথার ওপরের বোটলব্রাশগাছের চিরোল পাতার ফাঁক গলিয়ে রোদ এসে পড়েছে ওর মুখে। হাতের মুঠোয় সাদা কাগজ ঝুলছে, মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। হয়তোবা শানুর বড় মেয়ের বয়সী হবে। দৃষ্টি বিনিময় হতেই প্রশ্ন ছুড়ল শানু। মস্তিষ্কের নেতিবাচক তাড়না থেকে মুক্তি চায় ও। ততক্ষণে ছেলেটা ওর পাশাপাশি চলে এসেছে।

‘তুমি কি টেস্ট দিয়ে এলে?’
‘হ্যাঁ, লার্নারস পারমিটের জন্য রিটেন টেস্ট, তৃতীয়বারের মতো। তবে এবারও পাস হলো না।’
‘মাত্র ছয় পয়েন্টের জন্য।’
‘কী বলছ!’

শানু ভেবে পেল না এ পরীক্ষায়, ১২টা প্রশ্নের ভুল উত্তর দেয় কীভাবে এই বয়সের কেউ! পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল। অতিরঞ্জিত ব্যক্তিস্বাধীনতার এ দেশে, মনের ভাব বা কৌতূহলের সীমানা কখন, কতটা বিস্তৃত করা যায়—এ ব্যাপার বোঝার চেষ্টায় এখনো শানু নাজেহাল। তাই মৌনই বড় সমাধান।

শানুকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটিই গল্প জুড়ল, ‘বাবার পুরোনো গাড়ি আমিই হাঁকিয়ে বেড়াই। কিন্তু লাইসেন্স ছাড়া। ধরা পড়লে বড় বিপদ।’ ফেল করা লিখিত টেস্টের ওপর মনের ঝাল মিটাল ‘এফ’ শব্দের গালি ছুড়ে দিয়ে।

পথ মাপল শানু। এসব গালিগালাজের সঙ্গে ধাতস্থ হতে পারেনি এখনো। আশঙ্কা হলো ওর মেয়েদের কণ্ঠ নিংড়েও কি ভবিষ্যতে বেরিয়ে আসবে এসব স্তুতি? তবে ছেলেটার হতাশাবোধটাও বুঝতে অসুবিধা হলোনা শানুর। মনে মনে হাসল। শানুর কাছে যা কঠিন...সেই গাড়ি চালানোর কাজ, এই পুঁচকে ছেলের কাছে তা খুবই সহজ। আর ফুল মার্ক নিয়ে যে পরীক্ষা শানু মাত্র ডিঙিয়ে এল, সেই পরীক্ষা তিনবার দিয়েও ছেলেটা পাস করতে পারছে না।

মাস চারেক পরের কথা। ড্রাইভিং টেস্ট শানুকে দুবার দিতে হয়েছিল, প্রথমবার গাড়ি পেছাতে গিয়ে চাকা রাস্তার বাঁকে খানিকটা গুঁতো খায়। ব্যস ফেল। বাসায় ফিরে খুব লজ্জা লাগছিল ওর। এত জোগাড়যন্ত্রের পর ও ‘ফেল’! দেবর, স্বামী ও চেনাপরিচিতদের সামনে খুবই অস্বস্তিতে ভুগছিল। কেন যে এত নার্ভাস হয় ও ড্রাইভিং সিটে বসলে?

তখনো সংসারের খরচের অনেকটা জোগান হয় দেশ থেকে আনা গচ্ছিত ডলার দিয়ে। হিসাবি সংসারে পেশাদার ড্রাইভারের কাছে গাড়ি চালনা শেখার বাড়তি খরচ যেমন ওর মনে পীড়া দিত, তেমনি ড্রাইভিং শিখাতে গিয়ে স্বজনদের খবরদারিও শানুর মনঃকষ্টের পরিমাণ বাড়িয়ে দিত। শানুর কেবলই মনে হতো, কী সুন্দর সবাই গাড়ি চালায়! ওরই যত ভয় আর শঙ্কা! রাস্তার চলন্ত গাড়ি, বিশেষ করে বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসা গাড়ি...এমনকি রাস্তার দুধারের পার্ক করা গাড়িগুলোকেও মনে হতো, ওর গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার জন্য ওত পেতে আছে।

ড্রাইভিং হুইলে রাখা কম্পমান হাত একসময় সাবলীল হাতে রূপান্তরিত হলো। দিন বিশেকের কসরত শেষে বৃষ্টিভেজা এক সকালে পেটের মাঝে হাজারো প্রজাপতির দাপাদাপি, আর বুকের মাঝে ক্রমাগত হাতুড়িপেটার ধুকধুকানি নিয়ে শানু পাস করল রোড টেস্ট!

তবে টেস্টে পাস করা মানে রাস্তায় অবাধে গাড়ি নিয়ে...শহর দাপিয়ে বেড়ানোর মতো কিছুই ঘটল না শানুর জীবনে। আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল এ ব্যাপারে, আর স্বামীর কাছে তো পুরো ব্যাপারই ছিল অবান্তর। তাই লাইসেন্স পেয়েও সঙ্গী ছাড়া গাড়ি চালাত না শানু। এভাবেই কেটে গেল মাস দুয়েক।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তখন ‘মার্ভিনস’ নামের একটি পোশাকের স্টোরে কাজ করত ও। পোশাকের যে এত ভিন্ন নাম থাকতে পারে, তা বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা শানু কল্পনাতেও ভাবেনি—ট্যাংক টপ, ক্রপ টপ, রেপ ড্রেস, হুডি, টাক্সিডো, আরও কত-কী! কোনোটা বিনি, কোনটা সম্ব্রেরো, কোনোটা ফেডোরা। মুখস্থ করেও নাম মনে রাখা যাচ্ছিল না কিছুতেই। আর আন্ডার গার্মেন্টস ডিপার্টমেন্টের ব্যাপারটা তো ছিল বাড়াবাড়ি রকমের কঠিন! দেশে দোকানে আন্ডার গার্মেন্টস খরিদ করতে গিয়ে লজ্জায় প্রচণ্ড জড়তা নিয়ে কোনোরকমে ‘ব্রা’ শব্দটা উচ্চারণ করত। আর এখানে ক্রেতারা, তাদের হরেক চাহিদায় সোচ্চার! ব্রালেট, স্ট্র্যাপলেস, বাসটিআর, প্লাঞ্জ, স্ট্রিং, থং, চিকি, বয়শর্ট, অথবা হিপস্টার। নিজের প্রয়োজনের ব্যাপারে কোনো আপসের অবকাশ নেই কারও।

‘থ্যাংকস গিভিংসের’ সেল চলছিল দোকানে দোকানে। উপচে পড়া ভিড় ওদের স্টোরে। সুন্দরী, কেতাদুরস্ত এক নারী এলেন রেজিস্টারে। সঙ্গে দুই মেয়ে ও স্বামী। শপিং কার্টে উপচে পড়া পসরা। সপ্তাহ দুয়েক হয়েছে শানু রেজিস্টারে দাঁড়িয়েছে।

নারী প্রথমেই অনুযোগ ছুড়ে দিলেন, ‘তোমাকে কি ঠিকমতো সম্ভাষণ করতেও শেখায়নি ওরা?’

দুহাতে জিনিস স্ক্যান করে চলছে শানু। চার দুগুণে আটটি চোখ অবলোকন করছে ওকে। খুব অস্বস্তি আর নার্ভাস লাগছে ওর।

তার ওপর ক্রমাগত খবরদারি করেই গেলেন ওই নারী।
‘ওটার আমার আর দরকার নেই, ক্যানসেল করে দাও।’
‘আমি মিডিয়াম সাইজ চাচ্ছিলাম পেলাম না, মিডিয়াম কি তোমাদের নেই?’
‘আমার তাড়া আছে, একটু কি দ্রুত হাত চালাবে প্লিজ?’

মায়ের এ বাড়াবাড়িতে মেয়েরা অস্বস্তিতে হালকা অনুযোগ করল। কিন্তু কোনো অনুযোগই গায়ে মাখলেন না উন্নাসিক নারী। অব্যাহত থাকল প্রশ্ন আর অনুযোগের উপর্যুপরি ধারা।

‘আমাদের মার্ভিনসে চাঙ্কি লুপওলা বাথ-রাগ দেখেছিলাম। এখানে পেলাম না, তোমাদের স্টকে কি আরও বাথ-রাগ আছে বলে তুমি মনে করো?’ ‘চাঙ্কি লুপ?’ সে আবার কী?’ ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হলো শানু। ‘টোটাল’-এ চাপ দিতে গিয়ে কোথায় অনামিকা ঠেকল নিজেও বলতে পারে না। রেজিস্টারের পর্দা থেকে সব সংখ্যার তালিকা যেন মুছে গেল! নাকি শানু ভুল দেখল? প্রচণ্ড বিব্রত শানু সংশোধনে ব্যস্ত হয়ে সব ট্রেনিং ভুলে গিয়ে, অর্থহীনভাবে কি-বোর্ডে আঙুল চালাল। বাতিল হয়ে, হারিয়ে গেল সম্পূর্ণ হিসাবের তালিকা! অন্তত পক্ষে তা-ই মনে হলো শানুর।

এদিকে পার্স থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে দাম মেটাতে গিয়ে শানুর ইতস্তত ভাব দেখে থমকে গেলেন ওই নারী।
হাজারো ভাবনা তালগোল পাকাল শানুর মাথায়। আবার কী সব মালামাল এক এক করে স্ক্যান করতে হবে?

কত বড় দুর্যোগ যে অপেক্ষা করছে ওর জন্য, তা এ কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়ও বুঝে নিতে কষ্ট হলো না শানুর! হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হলো এক প্রিয় কো-ওয়ার্কারের মুখ। একসঙ্গেই ট্রেনিং নিয়েছে ওরা। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো ড্রেসগুলো পরিপাটি করছে ও। হাত উঁচিয়ে সাহায্য চাইল শানু। মেয়েটি কাছে আসতেই ইশারায় দণ্ডায়মান ক্রেতাকে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে ছুট দিল ও ফ্লোরের বিপরীত দিকে। আপাতদৃষ্টে শেল্ফের কাপড় ভাঁজ করায় নিযুক্ত শানু শত চেষ্টা করছে চোখের পানি সামাল দিতে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুল আরজি পেশ করল, ‘রেজিস্টারে কাজ করার পূর্বাভিজ্ঞতা আছে ম্যালিসার, বয়সও কম। হে খোদা, ও যেন সামাল দিতে পারে সহজে।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সামাল দিয়েছিল ম্যালিসা। ‘অডিট হিস্ট্রিতে’ গিয়ে খুব অল্পতেই উদ্ধার করেছিল শানুর হাতে ‘বাতিল’ হয়ে যাওয়া হিসাবনামা। আর তড়িঘড়ি দাম চুকিয়ে ব্যাগ হাতে দ্রুত প্রস্থান করেছিলেন ওই নারী ও তাঁর পরিবার। ভিন্ন শহর থেকে আসা পরিবারটির পার্টিতে যোগ দেওয়ার সময় বাঁধা ছিল মাত্র ১৫ মিনিট পর। শানুর নামে কোনো রকম অনুযোগ করারও ফুরসত পাননি নারী। ব্যাপারটি নিয়ে শানুর সঙ্গে প্রচুর হাসাহাসিও করেছিল ম্যালিসা। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকুর করেছিল শানু, এ বিদেশবিভুঁইয়ে কাজের জায়গায় অন্ততপক্ষে একজন তো প্রকৃত বন্ধু আছে ওর! কিন্তু এসব ঘটনা ওর আত্মবিশ্বাসকে আরও নড়বড়ে করে দিল, যা এতটুকু মেয়ে ম্যালিসা পারে, তা কি কখনোই পারবে না শানু?

সপ্তাহ দুই পরের ঘটনা। কাজফেরত, ক্লান্ত শানু গাড়ি পার্ক করল শপিং মলের পার্কিং লটে। সঙ্গে কেবল ছোট মেয়ে আরাধনা। তরতর করে বেড়ে ওটা মেয়েটার জন্য ড্রেস কিনবে ওরা। এই সপ্তাহান্তে আরাধনার কাজের জায়গা, লাইব্রেরিতে এশিয়ান-আমেরিকান হেরিটেজ মাস উদ্‌যাপন উপলক্ষে পার্টি আছে। আরাধনা ঠিক করেছে দেশি উৎসবধর্মী পোশাক পরবে। বাজেট বুঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পোশাক নির্বাচনের চেষ্টা করছে মেয়েটি। তবে সব প্রশ্ন শানুর জন্যই।

‘মা, এটার হাতা কেমন?’ ‘লম্বা কম মনে হচ্ছে না?’ ‘প্রিন্টের চেয়ে সলিড কালারেরটাই আমার কাছে ভালো ঠেকছে, তুমি বলো কোনটা নেব?’

হঠাৎ এগিয়ে এল ফিনফিনে সাদা শার্ট গায়ের সেলস গার্ল। এসেই মাছি তাড়ানোর মতো ইশারা করল শানুর দিকে।

‘তুমি সরে এসো, ওকে আয়না দেখতে দাও ঠিকভাবে।’
কথা থামিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে সেলসের মেয়েটার দিকে হাত তুলল আরাধনা।
মুখে বলল, ‘আমার মা-ই আমার প্রতিবিম্ব।’ ‘তোমাদের আয়নার আমার দরকার নেই।’

হকচকিয়ে গেল মেয়েটি, আর শানু নিজেও। মেয়েটি রূঢ় ব্যবহারের লজ্জায়, আর শানু প্রচণ্ড গর্বে! ওর সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি কথা বলল কী প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে! শানুর মন থেকে একনিমেষে দূর হয়ে গেল দিনের সব ক্লান্তি, একরাশ ভালো লাগা বোধ আর আশার আলো যেন ছড়িয়ে পড়ল শানুর হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে! হৃদয় দিয়ে অনুভব করল নিজ আত্মজা তার ‘আত্মবিশ্বাসকে’ কীভাবে ফিরিয়ে দিল। হেরে যাওয়ার চাপা ভয় সরে গিয়ে শানুর ঠোঁটে ফুটে উঠল ঝলমলে হাসি, ও চেয়ে রইল আরাধনার পানে।

*লেখক: শবনম চৌধুরী, এলিমেন্টারি স্কুল টিচার, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

*দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। মেইল করতে পারেবেন [email protected]