ভালোবাসা–১

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ইবাদুল্লাহ ইবু আমার পাশ দিয়ে তিরের বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল।
পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, থুতনিতে এক মুঠো দাড়ি কিন্তু মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলের অধিকারী পলায়নপর ইবাদুল্লাহ ইবু হাতের আঙুলে লুঙ্গির কোনা ধরে, খালি পা আর খালি গায়ে টানা বারান্দার আলো আঁধারিতে অন্য কিছু চোখে পড়ার আগেই উধাও; যেন কর্পুর, সিঁড়ির মুখে পৌঁছানোর আগেই নেই হয়ে গেল। শুধু ছুটন্ত একটা সাদা রেখা বারান্দার আলো-আঁধারিতে এক দিক থেকে অন্য দিক টানটান হয়ে পড়ে রইল।

পলায়নপর ইবুর পেছনে পেছনে ম্যাক্সি পরা নবিরন; দৌড়াতে গিয়ে তার চুলের খোঁপা আর বুকের ওড়না খুলে পড়ছে। ধাবমান নবিরনের হাতে বঁটি আর মুখে সচিৎকার গালি, তরে কাইট্যা ফালামু। ...খাড়া, তোর... কাইট্যা সমান কইরা দিমু... খাড়া…
ঘরে ঢুকব বলে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার কাণ্ডজ্ঞান গুলিয়ে গেল। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেও বুঝতে পারলাম না, ভেতরে ঢোকা উচিত নাকি ইবু-নবিরনের হেস্তনেস্ত পর্যন্ত বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকা উচিত?
আমার হাতে চারটা নেপালি কলা আর পাউরুটি। খানিক আগে নীলক্ষেত থেকে কিনেছি। দোকানদার বলেই দিয়েছে এগুলো নেপালি জাতের, সাগর কলা নয়। এ যে দেখেন, মাথার দিকটা ভোঁতা, এটা সাগর কলা না। সাগর কলার আগা চোকখা থাকে। দামও বেশি। আপনি এইডাই নেন। সাগর হইলেই কি আর নেপালের পাহাড় হইলেই কি। খাওয়া দিয়া কাম।

খাঁটি কথা। হালিতে চার টাকা কম বলে নেপালি কলাই কিনেছি।
দুই কাঁধে আমসত্ত্বের মত সেঁটে আছে ব্যাগপ্যাকের বেল্ট। ভেতরে বিসিএসের দুটো গাইড বই। একটা আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী। বেশ ভারি। ঘামে ভিজে জামা, গেঞ্জি চপচপে হয়ে গেছে। বুকের লোম বেয়ে শিরশিরে একটা ঘেমো অনুভূতি নাভির দিকে নেমে যাচ্ছে।

দিন কয়েক হল শেভ করা হয় নি। আজকাল ইচ্ছেই করে না শেভ করতে। একটা জিলেট ব্লেডে মাস শেষ হয়ে যায়। আগে সাত দিনও চলত না। আমি নিশ্চিত ব্ল্যাক বেঙ্গল পাঁঠার গন্ধ আর আমার গায়ের গন্ধে এ মুহূর্তে কোন ফারাক নেই।

ছুটন্ত নবিরন আমার গায়ের বদগন্ধ পেল কি না, কে জানে। পেলেও এখন তার দুর্গন্ধে কোনো পরোয়া নেই। অন্য সময় হলে অবশ্য নাকে আঁচল দিয়ে বার কয়েক থু থু ছিটিয়ে গোটা কয়েক কড়া কথা শুনিয়ে দিত। এ মুহূর্তে নবিরন যারপরনাই ব্যস্ত। পায়ের নিচে ডাস্টবিন থাকলেও সে বুঝবে না। আমার গায়ের বোঁটকা গন্ধ শুঁকে আমাকে দুকথা শোনানোর চেয়ে ইবুকে পাকড়াও করা অনেক জরুরি।

আজকাল নবিরনের তুচ্ছতা মেশানো দৃষ্টি, ঘেন্না মেশানো গলার স্বরের ‘ছি, ওয়াক থু’ শুনলেই আমার বুকটা শুকিয়ে যায়। তার গলার স্বরকে মনে হয় বিষমাখানো ছুরি। বুক ছ্যাঁদা করে ভিতরে ঢুকে সোজা মাথায় পৌঁছে যায়।

ইবুকে ওভাবে পালাতে দেখে আমি হতবুদ্ধি হলাম ঠিকই কিন্তু অবাক হলাম না। গত ছয় মাসে এ দৃশ্য আমি আগেও বার কয়েক দেখেছি। কখনো সিঁড়ির মুখে, কখনো টানা বারান্দায়, কখনো ঘরের মুখে এ একই রকম পলায়নপর ইবু পাশ কাটিয়ে ছুটে যায় আর পেছনে ধাবমান নবিরন।

যদিও দৃশ্যটা পুরোনো তবু ইবুর পলায়নপর গতি আর পথের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম আমি। তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগল। হাসিও পেল। কিন্তু কেন ভাল লাগল, কেন হাসি পেল বুঝলাম না!

এমনিতেই সিঁড়ি ভেঙে পাঁচ তলায় উঠতে হাঁপ ধরে গিয়েছিল। পলায়নপর ইবুকে দেখতে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস নেওয়ার অবসর মিলল। ইবু-নবিরন দৃশ্যকাব্যের এটাই মুফত মুনাফা।  

যে ঘর থেকে ইবু পড়িমরি দৌড়ে পালাল, সে ঘরের বারান্দাই গত ছয় মাস আমার ঠিকানা। আমি ইবু-নবিরনের বারান্দার সাবলেট বাসিন্দা।

ফুটখানেক জায়গা বাদ দিয়ে পুরো বারান্দাটা করোগেট টিনে আটকানো। রুপালি করোগেট টিন রোদে-বৃষ্টিতে পুড়ে-ভিজে পাকা সফেদার মতো হয়ে গেছে। ভেতরে আসতেই একটা ঝাঁজালো ধাতব ঘ্রাণ নিশ্বাসের সঙ্গে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। নাকের লোমগুলোও সেই ঘ্রাণে পিলপিল করে ওঠে।

আসবাবপত্র বলতে একটা চিতকাৎ চৌকি, দুই ফুটের একটা টেবিল, আর হাতলবিহীন নড়বড়ে একটা চেয়ার। টেবিলের ওপর একটা ছোট্ট ফ্যান। তবে কারোর গায়েপায়েই তেমন জোর নেই; যেন তেন ধাক্কা-গুতাতেই কঁকিয়ে ওঠে। টেবিল-চেয়ার দুটি থেকেই ঘুনপোকায় খাওয়া কাঠের হলদে গুঁড়ো ঝরঝর করে পড়ে। পায়ে পায়ে গুঁড়াগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে মেঝেটা হলদেটে হয়ে আছে।

দেয়ালের রশিতে জামা, লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা; যেন কোনো পীরের দরবারে ওরসের নিশান ঝুলছে। ফ্যানের বাতাসে খানিকটা নড়েচড়ে বটে তবে সেই নিশানের মতো পতপত করে না। চৌকির পায়ার নিচে তিনটা ইট। অতটুকু উঁচু না করলে কিছুতেই সবুজ টিনের ট্রাঙ্কটা নিচে ঢুকছিল না। তা ছাড়া অত নিচু খাটে শুলে কেমন কব্বরে ঢুকে যাওয়ার মতো বুক ধড়ফড় অনুভূতি হয়। সেই অনুভূতি থেকে বাঁচার জন্য এফ রহমান হলের বাগান থেকে একটা দুটা করে ইট এনে চৌকিটা উঁচু করতে হয়েছে।

এখন শুলে আর কব্বর কব্বর লাগে না। তাছাড়া চৌকিতে শুয়ে করোগেটের ফুটখানেক ফাঁকা জায়গা দিয়ে তাকালে রাস্তার ওপাড়ের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের বারান্দার মায়াবী হলদেটে আলো দেখা যায়।

চৌকির নিচের টিনের সবুজ ট্রাঙ্কের আংটায় এক ইঞ্চি লম্বা সোনালি রঙের একটা চাইনিজ তালা ঝুলিয়ে রেখেছি। চাবি নয়, যে কেউ আলতো আঙুল ছোঁয়ালেই খুলে যাবে। তবুও লাগিয়ে রাখি। মনের সান্ত্বনা। কিই–বা আছে ওতে। একজোড়া প্যান্ট আর শার্ট। মাঝেমধ্যে ভদ্র-সভ্য জায়গায় যেতে হয়। বিশেষ করে, ভাগ্যক্রমে কোনো ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়লে ঐ ভদ্র-দুরস্ত জামা-প্যান্ট লাগে। বাদবাকি সময় তো ঢাকা কলেজের সামনে থেকে কেনা টি–শার্ট আর জিনস।  

করোগেট ঘেরা এই খুপরিটাই আমার ঘর, আমার বসতি। আমি এর নাম দিয়েছি রোদমহল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী আবাসনে ইবাদুল্লাহ ইবুর নামে বরাদ্দ বাসায় আমার সাবলেট। আমি এখন মাস শেষে খামের ভেতর করে টাকা পরিশোধ করা ঝামেলাবিহীন সাবলেট ভাড়াটে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আমার রোদমহল দুপুরের রোদে ইটের ভাটার মতো গনগনে হয়ে ওঠে। রাতের বেলায় হয়ে ওঠে নান্নার বিরানির খুশবু ছুটানো গরম ড্যাগ। আহা কত দিন খাই না ওই বিরানি।
লালবাগ কেল্লার পাশ দিয়ে মদিনা ফার্মেসিটা হাতের বামে ফেলে পুষ্পরাজ সাহা লেন। ওখানে হেঁটে গেলে নান্নার বিরানির ঘ্রাণ পাওয়া যেত। পুষ্পরাজ সাহা লেনের ১৩ নম্বর বাড়িতে ৩ বছর প্রাইভেট পড়িয়েছি।

স্নিগ্ধা নামের মেয়েটি সপ্তম থেকে দশম শ্রেণিতে ঘষটাতে ঘষটাতে উঠল। অন্য কোথাও হলে বন্দুকের নল তাক করা হতো গৃহশিক্ষকের দিকে। অথচ স্নিগ্ধার মোটর পার্টস ব্যবসায়ী বাবা প্রতিবছরই আমার বেতন বাড়াত। বিকেলে পড়াতে গেলে নাশতাটা আয়োজন করেই আসত পড়ার টেবিলে। স্নিগ্ধাও তিন বছরে চোখের কাজল থ্যাবড়ান মোটা থেকে সুশ্রী চিকন করে লাগাতে শিখে গেল; দুই বিনুনির জায়গায় খোলা চুলে আমার সামনে পড়তে বসতে শুরু করল; আর আমি ফ্যানের বাতাসে খোলা চুলের ভেতর থেকে উড়ে আসা ভুরভুরে দামী শ্যাম্পুর ঘ্রাণে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে ১৩ নম্বর পুষ্পরাজ সাহা লেন থেকে বেরিয়ে আসতাম।

পুষ্পরাজ সাহা লেন থেকে বেরুতেই নান্নার বিরানির ঘ্রাণ আমার ওপর হামলে পড়ত। হলে ফেরার সময় মনে হতো, কেল্লার পুরানো ইটের গন্ধ বিরানির ওপর ছড়িয়ে কেউ একজন আমাকে ডাকছে, এভাবে চলে যাস নে, আয় খেয়ে যা। পাত পেতে রেখেছি আয়, আয়। সেই ডাক উপেক্ষা করে আমি এফ রহমান হলের দিকে পা বাড়াতাম।

তবে পুষ্পরাজ সাহা লেন থেকে বেরিয়ে নান্নার বিরানির দোকানের সামনের ঐ রাস্তাটা খুব ধীরে ধীরে হাঁটতাম। লম্বা লম্বা শ্বাস নিতাম। যতটা পারা যায়, বুক ভরে ঘ্রাণ নিতাম। বিরানি খেতে না পেলেও বুকের ভেতর ঘ্রাণ ঢুকলেও আমার সুখ হতো। বিরানির ঘ্রাণও কি আমার শরীরে শক্তি জোগাত? কি জানি।

যদিও স্নিগ্ধাদের বাড়ির নাশতাটা আয়োজন করেই আসত রোজ, তবে নান্নার বিরানির ঘ্রাণে আমার খিদে পেত। চোঁ–চোঁ খিদে। যেন তখনই পেটে কিছু না দিলে খিদেটা রক্তচোষা প্রাণীর মতো আমার নাড়িভুঁড়ি হজম করে ফেলবে। পড়ে থাকবে শুধু রক্ত আর তরল লালা। আমি হলের দিকে হাঁটতাম কিন্তু পেটের ভেতরে ঢক্কর ঢক্কর শব্দ শুনতে পেতাম।

আস্তে হাঁটলেও একসময় পথটা ফুরিয়ে যেত। বিরানির ঘ্রাণটা আর পাওয়া যেত না। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করতাম, বাকি পথটা আমি খুব দ্রুত হাঁটতে পারছি। পায়ে জোর পাচ্ছি। সে হাঁটায় ক্লান্তি নয়, একটা খুশি উছলে পড়ত।

হলে ফিরে জামা খুলে রাখলেও আমার গা থেকে বিরানির ঘ্রাণটা সজোরে ঠেলে বেরিয়ে আসত। বিছানার চাদরে বালিশে জামায় গামছায় ঘ্রাণটা পরদিন বিকেল পর্যন্ত লেগে থাকত। বিকেল হতেই আমি সেই জামা পরে আবার বেরিয়ে পড়তাম পুষ্পরাজ সাহা লেনের দিকে। স্নিগ্ধাকে পড়ানো নয়, নান্নার বিরানির ফুরিয়ে যাওয়া ঘ্রাণ পকেটে করে নিয়ে আসার জন্যই যেন আমার সব আয়োজন।    

নান্নার বিরানি খেতে পেতাম না ঠিকই কিন্তু বুকে পিঠে সুস্বাদু বিরানির ঘ্রাণ মেখে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়তাম।

আর এখন? মরচে পড়া টিন, ঘুনে খাওয়া কাঠ, আর জামাকাপড় থেকে ছড়িয়ে পড়া ঘামের গন্ধ ছাড়া আমার চারদিকে আর কোনো সুবাস নেই। আমার শরীর পথে পথে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়। তবুও ঘুমাতে পারি না।

ইবাদুল্লাহর করোগেট বারান্দার রোদ পোড়া গন্ধ, ভ্যাপসা গরম আমাকে ঘুমাতে দেয় না। সারাক্ষণ অচেনা একটা আশঙ্কা আমাকে জাগিয়ে রাখে। ভোরের দিকেই যা একটু ঘুমানো যায়। তাই যতটা পারি দেরি করে রোদমহলে ফিরি। চলবে....

**দূর পরবাসে লেখা পাঠতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা d[email protected]