প্রাইভেসির হাটবাজার

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্লগ এবং লাইভ ভিডিও চালু হবার পর তা খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয় সবার মধ্যে। নানা বিষয়ের ওপর প্রতিদিন লাখ লাখ ভিডিও আপলোড হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভ্রমণ, শিক্ষা, খেলাধুলা, বিনোদন, মোটিভেশনাল স্পিচ, রাজনীতি, অর্থনীতি, খাবারদাবার কিংবা রান্নাবান্নাসহ শত শত টপিক নিয়ে মানুষ ভিডিও বানাচ্ছেন। এতে অনেকেরই হিডেন ট্যালেন্ট ও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এ ভিডিও বা ভ্লগ বানিয়ে অনেকেই এখন নিয়মিত আয় করছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করছে এসব কনটেন্ট থেকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিউ এবং ফলোয়ার হওয়ার পর সেই ভিডিও বা ভ্লগ নির্মাতারাও মাসে হাজারো ডলার কামাচ্ছেন। এ যেন এক প্রতিযোগিতা। অনেকটা নিজের দক্ষতা ও ট্যালেন্ট বেচে খাওয়া। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকেই চাকরি বা ব্যাবসার পাশাপাশি বিকল্প আয়ের প্লাটফর্ম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভ্লগ বা ভিডিও বানাচ্ছেন। ব্যাপারটি খুবই ইতিবাচক এবং সময়োপযোগী।

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। অনেকেই ভ্লগের নামে নিজের প্রাইভেসি বেচে খাওয়া শুরু করেছেন। মানুষের অন্যের হাঁড়ির খবর জানার প্রতি আগ্রহ ও দুর্বলতা রয়েছে। ব্যক্তিগত বা গোপনীয় কোনকিছুর প্রতি মানুষের ঝোঁক থাকে। ঠিক এই জায়গাটাকে কাজে লাগিয়ে কিছু কিছু ভ্লগ নির্মাতা নিজের প্রাত্যহিক ব্যক্তিগত জীবন তুলে ধরেন মানুষের কাছে। এ যেন লাইভ সিসিটিভি, যা লাগানো রয়েছে বেডরুম থেকে শুরু করে লিভিং রুম, টয়লেট, কিচেন, ঘরের বাহিরসহ সব জায়গায়। সকালে ঘুম থেকে কখন উঠল, কোনো টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করল, কখন টয়লেটে গেল, কী রাঁধল, কী মেকাপ করল, কী কাপড় পরল, কোথায় গেল, কী গাড়ি চড়ল, কী শপিং করল, ঘরে মেহমান কে এল, কার বিয়ে হল, কে মারা গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। পুরো লিস্ট লিখে শেষ করা যাবে না। তাঁদের এই চমকদার আর শোঅফের ভ্লগ লাইফ দেখে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হন। অনেকে ঐ ভ্লগারদের মতো লাইফ লিড করতে পারছেন না মনে করে আফসোস করেন, ডিপ্রেসড হন, সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয়। অথচ তাঁরা জানেন না এই ভ্লগারদের ক্যামেরার পেছনের লাইফ সম্পূর্ণ ভিন্ন!

এসব ভ্লগ দেখতে না চাইলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অটোমেটিক তা সামনে চলে আসে। দেখলে সেই প্রবাদটি মনে পড়ে যায় ‘খালি কলসি বাজে বেশি, ভরা কলসি নড়ে না।’

এরা যে শুধু নিজেদের প্রাইভেসি বিক্রি করছে, তা না। নিজেদের বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়ে, পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধবদের পরিবারেরও প্রাইভেসি সারা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরছে। বিনিময়ে আয় করছে কয়েক শ ডলার। একজনের দেখাদেখি আরও দশজন শুরু করছে এ ধরনের ভ্লগ। এ যেন এক প্রাইভেসি বিক্রির হাটবাজার! এ প্রাইভেসি হাটের বেশিরভাগ বিক্রেতাই দেখা যায় বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষ, যারা বাংলাদেশের বাইরে ইউরোপ–আমেরিকাসহ বিদেশের বিভিন্ন দেশে থাকেন।

ইদানীং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআইয়ের অপব্যবহারের ভয়াবহতার খবর দেখতে পাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ হবে এই প্রাইভেসিকে পাবলিকে নিয়ে আসা মানুষদের জন্য। নিজের ট্যালেন্ট বা দক্ষতাকে কাজে লাগান। প্রাইভেসিকে প্রাইভেট রাখুন। দুইটা ডলারের জন্য নিজের প্রাইভেসিকে খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধ করুন। এ কালচার সমাজের জন্য ক্ষতিকর। অনেক আগে বিটিভিতে একটা শাড়ির বিজ্ঞাপনের ডায়লগ ছিল এরকম, ‘ঘরের কথা পরে জানলো কেমনে? এই যে এমনে..।’