শিশুশিক্ষায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করুন

ফাইল ছবি ছবি: প্রথম আলো

শিশু তার জন্মের শুরুতেই মাকে জানিয়ে দেয় তার চাওয়া-পাওয়ার সংবাদ। সে তার ভূপৃষ্ঠে আগমনে এমনভাবে তৈরি হয়ে আসে যে সে আকার-ইঙ্গিত বা সংকেতের মধ্য দিয়ে জানিয়ে দেয় তার কী দরকার। ভূপৃষ্ঠে জন্মের পরপরই কিন্তু একটি শিশু দ্রুততার সঙ্গেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে।

যেসব মা-বাবা শিশুকে তার মতো করে গড়ে উঠতে সাহায্য করে, সেসব শিশুই বড় হয়ে নিজের, সমাজের তথা দেশ-জাতির জন্য অবদান রাখে বেশি। যেসব শিশু জন্মের শুরুতে সোনার চামচের সঙ্গে পরিচিত হয়, তারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা ছাড়া অন্য কিছু অনুভব করা বা বোঝার ক্ষমতা, দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। ফলে সমাজে এরা বড় হয়ে যখন দায়িত্বশীল হয়, সেটা একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।

অন্যান্য জীবজন্তুর মধ্যে মানুষ জাতি বেশি পিছিয়ে রয়েছে মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে। যে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মানবজাতিকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, সেই অনুপাতে মানবজাতি তথা আমাদের বিকাশ ঘটেনি। এই বিকাশ না ঘটার পেছনে যে মূল কারণ জড়িত তা হলো, বড়দের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব।

জন্মের শুরুতেই শিশুকে বড়দের তৈরি সিস্টেমের মধ্যে ঢুকিয়ে তাদের সিস্টেমের জালে আটকে বড়দের ইচ্ছেমতো তৈরি করা থেকে শুরু করে বড়দের অনুকরণ, অনুসরণ করার কারণই দায়ী মানবজাতির অধঃপতনে।

স্রষ্টা যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আমাদের পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন আমরা তার এক অংশ সুযোগও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শিখিনি। তবে ধ্বংসাত্মক, হিংসাত্মক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আত্মকেন্দ্রিক দিকগুলোর ওপর প্রচণ্ড জোরালো হয়েছি, যার ফলে গোটা বিশ্বের মানুষের মাঝে ঘৃণা, বিদ্বেষসহ ধ্বংসাত্মক মনোভাব বেশি বিরাজমান। এই অপ্রিয় সত্যের পেছনে যে কারণটি বেশি দায়ী, সেটা হলো আমাদের আচরণ।

আমরা যা জানি এবং ভালো মনে করি সেটাই সারাক্ষণ শিশুকে শিক্ষা দিতে উঠেপড়ে লেগে আছি। যার ফলে শিশু কখনো তার নিজ সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারছে না। তারা কখনো নতুন কিছু উদ্ভাবন করার সুযোগ পাচ্ছে না। বাবা-মা থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তার সবকিছুই কেউ না কেউ জানে, তা নতুন কিছু নয় এবং অন্যের জানা জ্ঞানকেই মূলত শিশু থেকে শুরু করে মানুষের বৃদ্ধ জীবনের কর্মের শেষ অবধি পর্যন্ত শেখানো হচ্ছে, অথচ মানুষ সৃষ্টি হয়েছে তার নিজ নিজ গুণে। কিন্তু তার সঠিক বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না। অতএব আমরা যেমনভাবে জন্মেছি, সেই শুরুতে ঠিক বলতে গেলে তেমনই রয়ে গেছি।

অনেকে বলবে আমরা মহাশূন্য থেকে শুরু করে কত কিছু আবিষ্কার করেছি ইত্যাদি। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই, আমাদের যেখানে থাকার কথা ছিল, সেখানে উপনীত হতে পারিনি এবং এ ব্যর্থতার জন্য আমরা আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিকেই দায়ী করতে পারি। আমরা সারাক্ষণ অতীত জানতে জানতে ভবিষ্যৎ জানার সুযোগ হারিয়ে ফেলছি, আবার সারাক্ষণ অতীতের ভুল শোধরাতে সময় ব্যয় করছি, যার ফলে খুব অল্প সময় ভবিষ্যতের জন্য ব্যয় করার সুযোগ পাচ্ছি। ফলে উন্নতির শীর্ষে যেভাবে ওঠার কথা, সেটা হচ্ছে না। আমার এই অপ্রিয় সত্যকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে যে কাজটি করা দরকার তা হলো, শিশুশিক্ষায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা।

আমাদের ফিঙ্গারপ্রিন্টই বলে দেয় আমরা প্রত্যেকেই নিজ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এখন সেই ব্যক্তিত্বকে বাধাবিঘ্ন ছাড়া গড়ার সুযোগ দিতে হবে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তিত্ব তার মতো করে ফুটে উঠবে যেমন ফুলের বাগানে ফুটন্ত ফুলগুলো ফুটে ওঠে। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আমরা শুধু পরের কথা শিখতে শিখতে জীবন পার করে দিচ্ছি, বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজ, তাদের তো নিজস্ব বলে কিছু বলারই নেই।

সমাজে যারা কম শিক্ষায় শিক্ষিত, তাদের কারণে পৃথিবীর ন্যূনতম উন্নতি হয়েছে। কারণ, পুঁথিগত বিদ্যা তাদের মস্তিস্ক ধোলাই দিতে পারেনি বিধায় ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়ে সমাজের অশিক্ষিত তথা আমার মতো মূর্খরা মাঝেমধ্যে আজগুবি কিছু করে বা বলে, যার ফলে মূর্খের ভুল শোধরাতে পণ্ডিতেরা যখন ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখনই মুর্খের ভুল সত্যে প্রমাণিত হয়, যেমনটি হবে আমার কথার সত্য প্রমাণ, যেদিন শিশুশিক্ষায় হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে।

লেখক: রহমান মৃধা