মানুষ এবং দূরদর্শিতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মানুষ ভুল করার সময় যদি বুঝতে পারত, সে ভুল করছে, তাহলে পৃথিবীতে কেউ ভুল করত না। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মানুষ তা বুঝতে পারে। মানুষের যেকোনো ভুলের জন্য কি তাহলে তার অদূরদর্শিতা দায়ী? দূরদর্শী চিন্তা করার মতো বুদ্ধিমত্তা সবার থাকে না; তা ছাড়া ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ পরিস্থিতিতে না পড়লে অভিজ্ঞতা কেমন করে অর্জন করবে? এ ক্ষেত্রে বই মানুষের চিন্তাকে আরও সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্যই মানুষের জীবনে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

একজন লেখক অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানসহ, সতর্কতা নিয়ে লেখেন, যা মানুষের জীবনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে, চিন্তার উৎকর্ষ ঘটায়। মানুষের জীবনে দুঃখ, হতাশা, কষ্ট—কিছু না কিছু থাকবেই। এ সময় মানুষকে স্থিতিশীল রাখে তার চিন্তার প্রসারতা। মানুষ জানে না বলে ভুল করে, তার পারিপার্শ্বিকের সাপেক্ষে কিছু বিশ্বাস তাকে ভুল করায়। কিন্তু পৃথিবীতে সবকিছুই আপেক্ষিক; কাজেই শুধু একটি পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়ে ভুল হতে পারে। যেমন ধরুন, কোনো নারী তাঁর চারপাশের কিছু পুরুষের নেতিবাচক কিছু দিক দেখেছেন, তাই বলে কি সব পুরুষ সেই নেতিবাচক দিক ধারণ করেন? তেমনই কোনো পুরুষ তাঁর চারপাশের কিছু নারীর নেতিবাচক দিক দেখেছেন, তাই বলে সব নারী কি একই রকম? কাজেই কোনো বিষয়ে বদ্ধমূল ধারণা জন্মানোর আগে আপনাকে আরও জানতে হবে।

২.

মানুষের চিন্তাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার পারিপার্শ্বিক–কেন্দ্রিক হয়, এ জন্যই সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে মানুষে মানুষে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন আমরা আমাদের জীবনকে যেভাবে দেখি বা পরিচালিত করতে চাই, ভিন্ন সংস্কৃতির লোকজন তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাপেক্ষে জীবন নিয়ে ভাবে এবং সে মোতাবেক পরিচালনা করতে চায়। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যা সঠিক বলে মনে করি, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে কখনো তা ভুল। আমরা যা পাপ বলে মনে করি, তারা কখনো তা ভাবে জীবনের প্রয়োজন। তাই আমাদের ভুলগুলো হয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাপেক্ষে। যেমন আমাদের সমাজব্যবস্থায় ভালো রেজাল্ট, ভালো চাকরি সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয় আপাতদৃষ্টে, তাহলে বাকি মানুষগুলো কি অসফল? আমি মনে করি, মানবজাতিকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা যে রাখে, সে–ই সফল। একজন মানুষের চিন্তার উৎকর্ষ ও মানবিকতা তাকে সমৃদ্ধ করে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে, সে কোন সমাজব্যবস্থায় আছে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

৩.

জীবনে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার নেতিবাচক দিকগুলোও ভাবুন। অর্থাৎ আপনি যেমন করে ভবিষ্যৎ কল্পনা করছেন, তা তেমন না হলে আপনি মেনে নিতে কতটা প্রস্তুত বা বিকল্প কোনো পথ আছে কি না? মানুষের চাওয়ার মতো করে যদি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত বা ফলাফল না হয়, তখন সে মনে করে তার সিদ্ধান্তে ভুল ছিল, কখনো এর জন্য সে আফসোস করে। মানুষের যেকোনো সাফল্য শুধু তার একক প্রচেষ্টা বা ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, এদের মধ্যে কেউ যদি সঠিক ভূমিকায় না থাকে, আপনার কি করার আছে? কাজেই আপনার ব্যর্থতার জন্য অন্যরাও দায়ী থাকে। কাউকে বিশ্বাস করলে সে আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা নাও রাখতে পারে। কেউ আপনার মতো চলতে বা কাজ করতে বাধ্য নয়। মানুষ জানে না তার চলার পথে কোন কোন বাধাবিপত্তি অপেক্ষা করছে এবং তা জয় করতে কতটা সক্ষম? তাই মানুষের পরিকল্পনা কখনো কখনো বাস্তবায়িত হয় না। মানুষের নিজেরও কিছু দূরদর্শিতা থাকতে হবে। আবেগের চেয়ে বিবেক দিয়ে চলা জরুরি। আবেগ মানেই সেখানে অনুভূতির তীব্রতা বেশি, সময়ের সঙ্গে অনুভূতিগুলো রং বদলায়, কাজেই বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নেওয়া যুক্তিযুক্ত। জীবনে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তা না হলে মানুষ গতিশীল কী করে হবে? জীবনের কোন সিদ্ধান্ত ভুল আর কোনটা সঠিক, তা সময় সবচেয়ে ভালো জানে। যেকোনো কাজে একনিষ্ঠতা ও সততা থাকা জরুরি। কাজে ভুল নিয়ে আফসোস নয়, বরং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিন।