ভালোবাসা-৪

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

আজকাল অবশ্য তারানা খুব একটা ফোন করে না। আমিই করি। ও যখন বলল, হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছে, তখন আমি প্রায় অনুনয় করে বলেছিলাম, মিনিটখানেকের জন্য হলেও যেন দেখা করে।

আমি তখন ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে। বললাম, তুমি তো কাকরাইল থেকে ও পথেই ফিরবে, শাহবাগ আসো, তারপর একসঙ্গে ফিরব।

তারানা রাজি হলো না। বলল, আমি খুব ক্লান্ত, রউফ। হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছি। তুমি কেন বুঝতে পারো না, বলো তো? এমন ছেলেমানুষি করলে চলে? কাল সাতটায় আসতে হবে। জুন ক্লোজিং। দম ফেলার সময় নেই। তুমি তোমার মতো ফিরে যাও। আমার খুব মাথা ধরেছে, রুমে ফিরে বিশ্রাম নেব।

অলংকরণ : আরাফাত করিম

আজকাল তারানা খুবই ব্যস্ত। ওর জীবনের চারদিকে গতি, সে গতিতে তাল মেলাতে হয়; পা চলিয়ে হাঁটতে না পারলে পিছিয়ে পড়তে হবে। তারানা পিছিয়ে পড়তে চায় না। তার জীবন আমার মতো শ্লথ নয়। আমরা আর একসঙ্গে হাঁটতে পারি না। আমরা তো থাকি রাস্তার এপার-ওপার। এত কাছে অথচ মাঝখানের এলিফ্যান্ট রোডটা আটলান্টিকের মতো দীর্ঘ মনে হয়। সাঁতরে তার ঢেউ, স্রোত, শীতলতা—কোনোটাই অতিক্রম করা যায় না।

গোসল করতে করতেই শুনতে পেলাম নবিরনের গলা। ‘খানকির পোলা, তরে আমি খাইছি। তুই ২১২ লম্বরে টোকা দ্যাস। কচির দিকে নজর, না? আরে, তর কোমরে কি জোর আছে? তুই কি পুতুলের লগে পারবি? আবার অন্য মাইয়ার ঘরে টোকা...খাড়া...।’
নবিরন ঘরে ফিরেছে। আমি জানি, এখন একা একা ইবুকে সে গালাগাল করবে। যতক্ষণ মন চায়, সাধ না মেটে। এই কয় মাসেই জেনে গেছি, এই গালাগাল সহজে থামবে না।

নবিরন ঘরের কাজ করবে, এক-দুবার থালা-গ্লাস মেঝেতে ছুড়ে ফেলবে। ঝনঝন করে শব্দ হবে। সেগুলো আবার কুড়িয়ে জায়গামতো রাখবে। দম নেবে। আবার গালাগাল শুরু করবে। সে গালাগাল ইবু শুনল কি না, তাতে নবিরনের কিছু আসে-যায় না।

আমার মনে হয়, নবিরন নিজের সামনে কল্পিত এক ইবুকে দাঁড় করিয়ে এসব অশ্রাব্য গালাগাল শুনিয়ে ভেতরে এক অপার্থিব প্রশান্তি পায়।

আমিও কি জলের ছোঁয়ায় বা বাথরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে কর্মজীবী হোস্টেলের একটা অজানা রুমের দিকে তাকিয়ে, এক কল্পিত তারানাকে ভেবে অপার্থিব আনন্দ পাচ্ছি?

নবিরনের গালাগাল আমার শুনতে আর ভালো লাগে না। আমি মাথার ওপর পানির ঝরনা ছেড়ে তারানার হোস্টেলের আলোর দিকে তাকিয়ে ভিজতে থাকি। জলের ঝরনা থেকে একটা হিসহিস শব্দ হয়। আমি সেই হিসহিস শব্দের ভেতরও তারানার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই।

অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল আমার। কারা যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছে।
চারদিকে অন্ধকার। আমার মাথার কাছে ফ্যানটা ঘুরছে। ছোট্ট টেবিল ফ্যান। তেমন কাজের না। মনের সান্ত্বনার জন্য চালিয়ে রাখি। ঘামে জবজবে হয়ে গেছি।

করোগেটের ঘেরার যেখানে এক ফুট ফাঁকা, সেদিকে তাকালাম। তারানার হোস্টেলের আলোকিত বারান্দাটা দেখা যাচ্ছে। ঘুম ভেঙে সেদিকে তাকিয়ে থাকি।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ফিসফিসানিটা আরেকটু স্পষ্ট হলো।

বারান্দা আর ঘরের মাঝখানে টিনের দরজাটা দিয়ে শব্দ আসছে। নবিরন কথা বলছে। মাঝেমধ্যে ইবু সাড়া দিচ্ছে। নবিরনের গলাটা ফিসফিসে নয়, কেমন হিসহিসানির মতো মনে হচ্ছে।

আর টোকা দিবি পুতুলের ঘরে?

খোদার কসম, আমি গেছিলাম করিমরে খুঁইজব্যার। প্রভোস্ট স্যারে পাঠাইছিল। ওর নাকি জ্বর, তাই?

হুন, আমি বোকা না। আমারে উল্টাপাল্টা বুঝাইস না। কেন রে, আমার ভিতরে কী নেই ক?

কসম খোদার, আমি কোনো বাজে মতলবে যাই নাই। তুমি পুতুলরে গিয়া জিগাইয়ো।
আমার কাউরে জিগাইতে অইবো না। বেশি তেড়িবেড়ি করলে কাইটা সোজা থানায় জমা দিয়া আমু। দারোগা কিন্তুক আমার চিনা। ক, আর টোকা দিবি পুতুলের দরজায়?
না, দিমু না।
কসম?
কসম।

নীরবতা। সময় কাটে। নীরবতা আরও জমাটা বাঁধে। তারপর সে নীরবতা একটা হিসহিসানি কণ্ঠস্বরে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। হিসহিসানি বলে, ল, এহন আয়, দেহি তর কোমরে কত জোর। আমারে দেহা। পুতুলের কাছে গিয়া পুতুপুতু-ছোঁকছোঁক করস? পুতুপুতু দরকার নেই, আমারে দেহা, তুই কত্ত বড় বীরপুরুষ। আইজ তোর কোমর আমি ভাইঙ্গা ফালামু। পুতুলের ঘরে টোকা দ্যাস, না?

আবারও খানিকক্ষণ নীরবতা। পাথরের মতো নীরবতা। আফ্রিকার আদিম বনের মতো নীরবতা। অদৃশ্য দেয়ালের মতো অন্ধকারে মোড়ানো নীরবতা। আমি সেই নীরবতার ভেতর ভাসতে থাকি, ডুবতে থাকি, ঘূর্ণিজলে ঘুরতে থাকি। নিজের কানের ওপর বালিশ চেপে রাখি।

তবু টিনের দরজার ওপার থেকে বিচিত্র সব আদিম শব্দ আমার কানে এসে আছড়ে পড়তে থাকে। গালাগাল, আদর, হিসহিস, ক্যাচক্যাচ। আমি কানের ওপর বালিশটা আরও জোরে চাপা দিয়ে আবার ঘুমাতে চেষ্টা করি।

পারি না।

ইবু আর নবিরনের নিবিড়তার শব্দগুলো আমার কানের ভেতর ঢোলের মতো বাজতে থাকে। ঢোলের বোল যেন বলে, এক ধামা চাল একটা পটোল, এক ধামা চাল একটা পটোল। এক ধামা চাল একটা...।

আমি জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাই। তারানার হোস্টেলের মায়াময় আলোয় ঘুমিয়ে থাকা বারান্দাটা দেখা যাচ্ছে। গভীর রাতে মায়াবী আলোটা আরও বেশি মায়াবতী মনে হচ্ছে। অমন হলুদ আলো যেন আমি আগে কখনো দেখিনি।

ওখানেই কোনো একটা ঘরে তারানা ঘুমিয়ে আছে। নাকি সেও জেগে? আমার মতো? তারও কি আমাকে মনে পড়ছে? নাকি তারানা এখন আর আমাকে মনে করে না? সে ব্যস্ত চাকুরে। আমাকে মনে করার মতো সময় কোথায় তার হাতে?

দেখা তো হয়ই না আজকাল। কথাও হয় খুব কম। দেখা হলেও কথা ওই একটাই, দেখ রউফ, বিসিএস না হলে কিন্তু মা-বাবাকে তোমার কথা বলতেই পারব না। বুঝতেই পার। মা-বাবার ইচ্ছাকে তো আমি অসম্মান করতে পারি না।

কিন্তু আমি তো চেষ্টা করছি? করছি না বলো? আমি কাটা লতার মতো নেতিয়ে পড়তে পড়তে বলি

চেষ্টা করছ, এটা তো কোনো অর্জন নয়। তোমাকে প্রমাণ করে দেখাতে হবে।
তুমি আমাকে ভালোবাসো না?

ভালোবাসার প্রশ্ন নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে সামাজিক পরিচয়ের। আমার মা-বাবা তাঁদের জামাইকে নিয়ে গর্ব করতে চান। এটা কি খুব বেশি চাওয়া তোমার কাছ থেকে?

তারানার গলাটা আমার কাছে অচেনা লাগে। তার মসৃণ গ্রীবায়, কপোলে চুল এসে পড়লে আমার মনে হতো, জগতের সব আনন্দ থই থই করে উঠছে, সেখানে কেবল অন্ধকার দেখতে পাই আমি। সে অন্ধকার আস্তে আস্তে তারানার মুখ ঢেকে দেয়। কাঁধ ঢেকে দেয়। তারপর গড়িয়ে নিচে নামে। একসময় আমার চোখের সামনে আর কোনো প্রিয় মানবীকে আমি দেখতে পাই না। কেবল এক তাল অন্ধকার জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে।

অথচ একদিন তারানা আমাকে সব দিয়েছিল। দুই বছর আগে। সেই যে মধ্যদুপুরের ঝুম বৃষ্টিতে। গাজীপুরের শালবনের মাঝখানের সেই টিনের ঘরটাতে। আমি তার গ্রীবাকে বলেছিলাম রাজহংসীর মতো, ঠোঁটকে বলেছিলাম অমিয়ধারা। চুলের নিবিড়তায় সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছিলাম। আর তারানা বলেছিল, আমার সর্বনাশ করো, তোমার সর্বনাশে আমার সব যন্ত্রণার বিনাশ হোক। সেই একবারই কি তারানা আমাকে চেয়েছিল, আর কোনো দিন চায়নি?

আমি হোস্টেলের আলোয় তারানার ঘরটা খুঁজতে থাকি। কোন ঘরটা? কোন ঘরটাতে দুই বছর আগে সর্বনাশের পথে অবহেলায় হেঁটে যাওয়া তারানা জেগে আছে? নাকি সে আর কোথাও জেগে নেই, এখন জাগরণে তার রাত কাটে না, এখন কেবল আমার মাথার ভেতরই সে জেগে থাকে স্মৃতির অবয়বহীন মূর্তির মতো!

নবিরন আর ইবাদুল্লাহর ভালোবাসার তাল-মাতাল-উত্তাল-অগোছালো শব্দেরা একসময় নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে। নৈঃশব্দ্যের পাঁজরে ধুকধুক করে শব্দ হয় হৃৎপিণ্ডের। আর আমি সেই নৈঃশব্দ্যের পটভূমিতে আলো-অন্ধকার-নিশ্বাস-শীৎকার-স্বপ্ন-সম্ভাবনা পেছনে ফেলে তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া তারানা আজিমের পায়ের চিহ্ন খুঁজতে থাকি। শেষ...

**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]