ভিনদেশে বাংলা নববর্ষ পালনের অনন্য অনুভূতি
১০ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে এবারও বৈশাখের রং ছড়িয়েছিল প্রশান্ত পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখ অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনবাসীদের জীবনে এক অন্য রকম অনুভূতি আনে। কর্মব্যস্ত জীবনের একটা দিন ব্রিসবেনে বাংলাদেশিদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন ব্রিসবেন ইনক. (ব্যাব)-এর উদ্যোগে বৈশাখী মেলায় বাংলাদেশিরা এসেছিলেন। কিছুটা হলেও মনে এক রকম বাঙালিয়ানা ভাব ফুটে উঠেছিল।
২১ মে ব্রিসবেনের লগান সিটির অন্তর্ভুক্ত কিংস্টন বাটার ফ্যাক্টরির সাংস্কৃতিক মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা ১৪৩০। ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল বাঙালি নববর্ষ উদ্যাপন, মাল্টি কালচারাল ফেস্টিভ্যাল, লাইভ কনসার্ট, বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আতশবাজি, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার, মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো জমকালো সব আয়োজন।
ব্রিসবেনে আমাদের বেশি দিন না হলেও ব্যাবের এ আয়োজনের কথা মুখে মুখে শুনতাম। অনেক দিন থেকেই পরিকল্পনা ছিল মেলায় যাওয়ার; যেন ভিনদেশেও একটু পয়লা বৈশাখের স্বাদ পাওয়া যায়। সম্প্রতি ব্রিসবেনে আসা সহকর্মী উৎপল দার পরিবারসহ বাচ্চাদের নিয়ে ট্রেনে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম ভেন্যুতে। এদিক থেকে ব্যাব একটি বিশেষ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ, আমাদের যাঁদের নিজস্ব গাড়ি নেই, তাঁদেরও নাগালের মধ্যে রেখেছিল মেলাটিকে। বেলা ১১টায় মেলার গেট খুলে দেওয়া হলে প্রতিজনকে ২৫ ডলারের টিকিট কিনে প্রবেশ করতে হলো। আমরা অবশ্য ১০ ডলার লস করলাম! কারণ, আগে টিকিট বুকিং রাখলে আমার ও আমার স্ত্রীর শিক্ষার্থী হিসেবে ১০ ডলার ডিসকাউন্ট পাওয়ার কথা ছিল। যেহেতু ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়ার অনেক শহরের তুলনায় কম বাংলাদেশি বাস করেন, এখনো কোথাও বাংলায় কথা শুনলে গিয়ে পরিচিত হতে ইচ্ছা করে। এটাও ভাবি, দেশে মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্বে কত রকম ভিন্নতা কাজ করে। সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমন ভাষা, এলাকা, বয়স, পছন্দ ইত্যাদি হরেকরকম বিষয়। সেই মানুষই যখন আমরা দেশ থেকে বহুদূরে আসি—ব্যবধানটা অনেকটাই কমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে বাঙালি সংস্কৃতির উপাদানকে একসঙ্গে পাওয়ার প্রত্যাশায় লসটা আসলেই নস্যি মনে হয়েছে।
মেলায় অংশ নেওয়ার প্রথম কারণটা পারিবারিক। নিজের পাশাপাশি বউ-বাচ্চাকে ভিনদেশে ছুটির দিনে একটু পয়লা বৈশাখের স্বাদ দেওয়া-নেওয়া। দ্বিতীয়ত, নতুন আসা সহকর্মীর পরিবারকে সুন্দর একটি ছুটির দিন উপহার দেওয়া। তৃতীয়ত, আমার উচ্চশিক্ষা গবেষণার একটি অংশে রয়েছে ভিনদেশি বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বাচ্চাদের ওপর ডিজিটাল মিডিয়ার প্রভাব। সবকিছু মিলিয়ে একটা চমৎকার দিন কেটেছে। চারপাশে ছিল বাংলা ভাষা, বাংলা গান, সুর, তাল, মানুষ সঙ্গে বাংলা খাবার! আর কি লাগে? আরও ভালো লাগল, যখন দেখলাম বেশকিছু বিদেশি এসে আমাদের বাংলা সংস্কৃতিকে সম্মান জানাচ্ছেন। বিদেশিদের মধ্যে ছিল অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্য, মন্ত্রী থেকে শুরু করে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০ জনপ্রতিনিধিও। আমরাও কম কিসে? আয়োজকেরা যেমনটি বাংলাদেশিদের দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয় সংগীতের আয়োজন করেছিলেন, তেমনই সেই শিল্পীরাই খালি গলায় দরাজ কণ্ঠে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতও গাইলেন। দুটি জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় ছিল সুনসান নীরবতা, সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছেন। এমনকি বন্ধ ছিল স্টলের বেচাকেনা কার্যক্রমও।
মেলায় নানা পণ্য আর মুখরোচক খাবারের বিভিন্ন স্টলগুলোতে জমজমাট ভিড় ছিল। বিশেষ করে খাবারের স্টলগুলোর নামও ছিল মনে রাখার মতো। না খাইলেই মিস, উড়াধুড়া মেজবান, জগাখিচুড়ি, বেঙ্গল কিচেন ইত্যাদি। অনেক দিন পর আমরা স্বাদ নিলাম মালাই চা, চটপটি, ফুচকা আর চিনির জিলাপি।
বাংলাদেশি শিশু-কিশোরদের উপস্থাপনায় গান-বাজনাসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই শিশু-কিশোর ভিনদেশে, ভিন্ন পরিবেশে বড় হচ্ছে। এদের অনেককেই আমি চিনি। যারা হয়তো ইংরেজি কারিকুলামে পড়াশোনার কারণে বাংলা ভাষায় ততটা পারদর্শী নয়, কিন্তু নিয়মিত অনুশীলন করে সংস্কৃতিকে নিখুঁতভাবে ধারণ করছে। কেউ কেউ তো অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশি গুরুদের কাছ থেকে দীক্ষা নিচ্ছে। ভাবা যায়! বিশেষ করে ছেলেমেয়ে ও শিশুদের বাহারি সাজ, বর্ণিল জামাকাপড় মিলে পরিবেশটা ছিল রমনা বটমূলের কাছাকাছি। ছোট শিশুদের উপস্থাপনার পাশাপাশি বাধভাঙা আনন্দ এক অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করেছিল। আমার ছেলে রাহিল, সহকর্মীর ছেলে পরম আর উপম তো মহা আনন্দে দিনটা কাটাল।
সবশেষে রাতে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী তপু ও রাফার পরিবেশনায় সবার নেচেগেয়ে নতুন বছর উদ্যাপনটা বছরব্যাপী মনে থাকবে। অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। আমার ধারণা উৎসবে উপস্থিত সবার অনুভূতিটাও এমনটিই ছিল। আর আয়োজকেরা সপ্তাহব্যাপী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এমন সুশৃঙ্খল একটি অনুষ্ঠান উপহার দেওয়ায় অনেক ধন্যবাদ। এভাবেই দেশ থেকে যে যত দূরেই থাকি না কেন, ঐতিহ্য-সংস্কৃতির আবর্তে দেশ ও কমিউনিটিকে অস্তিত্বে ধারণ করে একসঙ্গে বাঁচি—এমনটাই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: মামুন আ. কাইউম, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া