লালমিয়ার দ্বিতীয় বিয়ে-২য় পর্ব
আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললাম, আপনি শুধু ভাবিকে উচিত শিক্ষা দিতেই দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা করছেন? না কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? সে একটু লাজুক কণ্ঠে বলল, ‘কি যে কন না ভাইসাব, হ্যায় তো আমার জীবনডা মনে করেন এক্কেরে তামা তামা কইরা হালাইছে। বাড়ি কইলাম এক্কেরে দোজখের লেহান দাউ দাউ কইরা হগল সময় জলবার লৈছে। এমনিতেই গরম তারপর হ্যার গরমে তো ঘরে টেকাই মুশকিল হৈয়া গ্যাছেগা। এইডাই আসল এর বাইরে কিছু নাইক্যা।’ বলার পরও তার মুখে বিচিত্র হাসি দেখে আমার মনে হলো সে কিছু লুকাচ্ছে। আমি তাঁর দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলতেই সে যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারল। বললো, আরেকখান অবশ্য ক্ষুদ্র মনোবাসনা আছে, তয় হেইডা আসল না। আমি খুব অবাক হয়ে এবং অধিক আগ্রহ নিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। আমি ইশারা করে আমার ড্রাইভারকে দেখিয়ে বললাম, আপনি বলেছিলেন আমার সঙ্গে আপনার একান্তই গোপন কথা কিন্তু তা তো আর গোপন থাকছে না। সে তো সব শুনছে। সে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, সমস্যা নাই ক্যা। হ্যারা আগেত্থন হগল ব্যাপার জানে। এইডা তো আর গোপন থাকনের উপায় নাই।
বললাম, ঠিক আছে বলেন আরেকটি কী কারণ যে আপনাকে দ্বিতীয় বিবাহ করতে হবে। সে বলল, দেহেন ভাইসাব, আমার পাঁচ বইনের পর আমার জন্ম অইছিল। আমার জন্ম কইলাম এক মায়ের প্যাটে না। আমার বাবা ২ নম্বর বিয়া করণের পর আমি তার বংশ রক্ষার একমাত্র চ্যারাগ। ব্যবসাবাণিজ্য দেহনেরও তো একখান পোলা দরকার, কি কন? তা ছাড়া মনে করেন আমার এই ঘরে চাইরখান মাইয়া জন্ম লৈছে অহন আর চেষ্টা করন ঠিক অইবো না। এইবার বুঝলাম তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের আসল রহস্য। আমি বললাম, আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে যদি আবার মেয়ে সন্তান শুরু হয় তখন কি আপনি তৃতীয় বিয়ে করবেন। সে হাত কচলিয়ে লাজুক কণ্ঠে বললো, বুঝলেন না ভাইসাব সবই আল্লাহর ইচ্ছা।
বাঙালি মানেই কৌতূহল, আমি কি তার বাইরে যেতে পারি? আমিও অনেক আগ্রহ নিয়ে লালমিয়ার দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আজকাল সে অফিসে আসে কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা হয় না। আমি অফিসে পৌঁছাবার আগেই বের হয়ে যায়। বাংলাদেশে বস হলে একটু গাম্ভীর্য নিয়ে চলতে হয়। সব বসদের মধ্যে আমিত্ব ভাব প্রবল। সব সময় একটি ভাব ‘আমাকে চিনিস? জানিস আমি কে?’ আমিও মনে হয় তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। তবে কানাডা আসার পর সে ধারণা বা সে ভুল ভেঙে গেল। এখানে বস খুবই হাসিখুশি, বন্ধুবাৎসল। বসের চেয়ারে বসে যে প্রয়োজনীয় কাজ সারা যায় তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। সে যাই হোক আমার অফিসের কেউ আমাকে আগ বাড়িয়ে লালমিয়ার কথা বলে না। আমি জিজ্ঞেস করলে বলবে, তা জানি।
লালমিয়ার মতো, শেয়ার ব্যবসায়ীর মধ্যে কিছু লোক আছে তাঁরা আমার খুবই ঘনিষ্ঠ। তাদের সঙ্গে লালমিয়ার ব্যাপারে কথা হয়। সবাই তাকে পছন্দ করে। একদিন অফিসে পৌঁছে দেখি খুব আনন্দ ফুর্তি হচ্ছে। লালমিয়া হাজির তেহারি নিয়ে আসছে। হাজির তেহারি অবশ্য সে প্রায়ই আনে। আমি ঢুকতেই তাদের আনন্দ কিছুটা ম্লান হয়ে গেল। আমি লালমিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম। কী ব্যাপার এতো আনন্দ কেন? লালমিয়া লজ্জ্বায় মাথা মাথা নিচু করল। পরে শুনলাম তাঁর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। মেয়ে দেখতে খুবই সুন্দরী। মেয়ের বয়স আঠারো। আমি এখানে হোঁচট খেলাম বললাম, আপনার বয়স প্রায় ৫০, বিয়ে করছেন প্রায় মেয়ের বয়সী একজনকে। সে মেয়ে আপনাকে মেনে নিয়েছে? এবার মনে হয় সে একটু আহত হলো, বললো, ভাইসাব কি যে কন না। পুরুষ মাইনসের আবার বয়স কিয়ের। আর মাইয়া তো আমাগো পাড়ার। ইন্টার পাস কইরা বইয়া আছে। আমার লগে বিয়া অইলে তো পায়ের উপর পা তুইল্যা জিন্দেগি কাটায়া দিব। বুঝলেন না ট্যাকাই সব। ট্যাকা আছে প্রেম-ভালোবাসাও ভি আছে। আমি এ ব্যাপারে আর কথা না বাড়িয়ে সবাই মিলে অতি আনন্দের সঙ্গে লালমিয়ার বিয়ের সংবাদের খাবার খেলাম।
পরের সপ্তাহে লালমিয়ার মন খারাপ দেখে অবাক হলাম বললাম, কি ব্যাপার, শরীর ঠিক আছে তো? সে বললো, শৈলডা বালাই আছে, তয় মনে চোট লাগছে ভাইসাব। আমি বললাম, ভাবির সঙ্গে আবার ঝগড়া? সে বললো, না। বেশি প্রশ্ন করলে লালমিয়া কিছুই বলবে না, এটাই তার স্বভাব। তাই কিছু না বলে অফিসের কাজ শুরু করলাম। চা এলো, চা পান করলাম, লালমিয়ার মুখে কোনো কথা নাই। যে এক মুহূর্ত কথা না বলে থাকতে পারে না, সে হঠাৎ বোবা হয়ে গেল কেন? মনে কৌতূহল। লালমিয়ার এতক্ষণ চলে যাওয়ার কথা কিন্তু সে বসেই আছে। তার মানে সে আমাকে ঘটনা না বলে উঠতে পারছেন না। কথা বেশিক্ষণ আটকে থাকায় হঠাৎ বিস্ফোরণ হলো। লালমিয়ার মুখে কথার খৈ ফুটছে। বললো, বুঝলেন ভাইসাব, আমার কপালডাই খারাপ। এই বিয়ে অইবো না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেনো? মেয়ে কি বেঁকে বসেছে? আমি জানতাম এমনটি ঘটাই স্বাভাবিক। সে বললো, কি কন? মাইয়া বাকবো ক্যান? হ্যায় তো এক পায়ে খাড়া, আমিই বাইক্যা বইছি। আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম বললাম, ‘এত সুন্দরী মেয়ে, এতো প্রশংসা করলেন হঠাৎ আপনার মনে কি এমন পরিবর্তন হলো যে বিয়েই বাতিল করে দিলেন। আপনার প্রথম বউ কি বাধা দিচ্ছে।’ না ভাইসাব হ্যায় তো আমার নিকার একিন আগেই দিছে। এক্কেরে লেইখ্যা দিছে। আমি বললাম, বলেন কি? যে সবসময় আগুনের গোলা হয়ে থাকে সে আপনার দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিলো? সে বললো, ‘আমাগো তো দুই তিনডা বিয়া করনের চল আছে। হ্যার বাপ, হ্যার দাদা আমার বাপ, আমার দাদা হগ্গলেই দুই-তিন বিয়া করছে। তাইলে আমার বিয়া করতে দোষের কি? তাই কুনো সমস্যা হয় নাইক্যা।’ আমি বললাম তাহলে কি সমস্যা। সে বললো, ‘কাইলকা নতুন মাইয়ার লগে ফোনে কতা কইবার লৈছিলাম। বুঝলেন হ্যার বাতচিত এক্কেরে আমার বড় বৌয়ের লগে মিল্যা যায়। আইচ্যা কন, আমি যার কারণে আমার বড় বৌয়ের উপ্রে গোস্যা, এইরহম আরেকখান বিবি আইলে আমার ঘর তো ডাবল দোজখ হইয়া যাইব। না এই মাইয়ারে বিয়া করণ আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি নির্বাক।’
লালমিয়ার কথায় মনে হলো ওদের সমাজে দুই-চারখান বিয়ে কোনো ব্যাপারই না। বিয়েটা যেন কোরবানির হাটে গিয়ে জোড়া বকনা গরু কিনে আনা। আমার মনে হয় না তাঁর প্রথম স্ত্রী সম্পর্কে যা বলেছে, তা ঠিক। আসলে সে ছেলের আশায় দ্বিতীয় বিয়ে করবে, ছেলে তাঁর একটি চাই। মেয়েরা তো আর মানুষ না। তাই ছেলে মানুষ চাই। লালমিয়ার অসহায় প্রথম বউয়ের চেহারা আমি যেন দেখতে পেলাম। তাঁর এখন তিনকূলে কেউ নেই বললেই চলে। এক ভাই আছে সেও নাকি অস্ট্রেলিয়া থাকে। তাকে বললে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। খুবই স্বার্থপর একজন মানুষ। বিয়ের পরই অসহায় বাবা মা কে ফেলে চলে গিয়েছিলো। তাঁদের মৃত্যুর সময়ও আসে নাই। শুধু তাঁদের ভরণপোষণের জন্য কিছু টাকা পাঠাতো মাঝেমধ্যে। এখন স্বামী তালাক দিলে যাবে কোথায়? তাই হয়তো বাধ্য হয়েই অনুমতি দিচ্ছে। কিন্তু তার মেয়েরা তো বড় হয়েছে একজন কলেজেও পড়ে। তারা কেন তার বাবাকে বাধা দিচ্ছে না! আমার এতগুলো প্রশ্ন আমার মনেই রয়ে গেলো। এদিকে শেয়ারের দাম বাড়ছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লোকের সমাগম বাড়তে শুরু করেছে। এই লক্ষণ খুব খারাপ। আমি এই পরিস্থিতি আগেও দেখেছি। আমাদের সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে অটোমেশন ছিল না। অকশন হতো ডাকের মাধ্যমে। মুখে বলতে হতো কোন শেয়ার কত কিনব আর কত বেচব।
আমি ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের বিক্রয় প্রতিনিধির কাছে শেয়ার কেনা বেচার কিছু কৌশল শিখেছিলাম। সে আমাকে বেশ পছন্দ করতো। নাম তার পরিমল। আমাকে একদিন বলল, আপনারে শেয়ার বেচাকেনার সময় সম্পর্কে একটি গোপন তথ্য দিই। আমি আনন্দিত হয়ে বললাম, কী তথ্য? সে বলল, লক্ষ করছেন? আমি আমি যখন করেপোরেশনের শেয়ার বিক্রি করি সবাই পাগলের মতো কেনে? আমি বললাম, হ্যাঁ আমিও তো কিনি। সে বললো, না তা করবেন না আমি যখন বিক্রি করব, আপনিও সেই শেয়ারগুলো বিক্রি করবেন আর আমি যখন কিনি আপনিও তখন কিনবেন। এতে আপনার লাভ কম হলেও ক্ষতি হবে না। তাঁর সে উপদেশ বেশ কাজে দিয়েছিল। লালমিয়াও আমাকে শেয়ারের ব্যাপারে অনুসরণ করত। এখন শেয়ার বাড়ছে মানে এক মাসের মধ্যেই শেয়ার বাজার ক্র্যাশ করার সম্ভাবনা। এ সময় অন্য কিছুতে আর মনোযোগ দিই না। লামিয়ার বিয়ের ব্যাপারে আমার কৌতূহল অনেক কমে গেল। তারপরও কিছু আগ্রহ তো থেকেই যায়। লালমিয়া একদিন আবার খুশি মনে অফিসে এসে জানাল, এইবার তাঁর বিয়ের সব ঠিক করেছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। অফিসে শেয়ার বাজারের দাম বেড়ে যাওয়ার আনন্দ, সেই সঙ্গে লালমিয়ার দ্বিতীয় বিয়ের আনন্দে সবাই মেতে উঠেছে। লালমিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী এই মেয়ে অনেক ভালো, দেখতে আরও সুন্দরী, গায়ের রঙ দুধে আলতা। আমাদের দেশের ছেলেরা বিয়ের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে দুধে-আলতা মেশানো গায়ের রঙের মেয়ে খোঁজে। কোরবানির পশুর মতো তাঁদের দাঁত দেখে, চুল দেখে, হাঁটা চলা দেখে, হাসি দেখে। কিন্তু কখনোই সুন্দর মনের মেয়ে খোঁজে না। অপর দিকে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় ঘর দেখে, যোগ্য বর দেখে, মনও দেখে না, চেহারাও দেখে না। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাঁরা সংসার শুরু করলেও সুখের ঘর বাঁধতে পারে না, একই ছাদের নিচে শুধুই মানিয়ে চলা। লালমিয়াও এর ব্যতিক্রম না। সেও মন বুঝে না, গায়ের রং বোঝে, সুন্দরী বুঝে, আর বুঝে একটি ছেলে সন্তানের প্রয়োজন। তাই লালমিয়া সবার কাছে সুন্দরী হবু বউয়ের সৌন্দর্য বর্ণনায় পঞ্চমুখ। খুশির চোটে সব সময় দাঁত কেলিয়েই থাকে। চলবে....
*লেখক: বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, ক্যানাডা।
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]