পায়ের নিচের মাটি যখন দুলে ওঠে
সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা। সামার ভ্যাকেশন ফুরাতে আর তিন দিন মাত্র বাকি। এরই মধ্যে সামার-স্কুলে কাজ করেছি, তারপর পরিবারের সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছি নিউইয়র্কে। বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন করার সুযোগ পেয়েছি বেশ কয়েকবার, সামারজুড়ে।
তবে সামনের সপ্তাহ থেকে আবার সেই ভোরবেলা ওঠা। নতুন ছাত্র-ছাত্রী, নতুন লেসন প্ল্যান, নতুন প্যারেন্টস... সব মিলিয়ে মনে চলছে এক অম্ল-মধুর অনুভূতি! আপনি যত ঘাগু টিচারই হননা কেন, নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনগুলো সব টিচারকেই কাটাতে হয় সীমাহীন ব্যস্ততা আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে। আমি তো তাদের কাছে নস্যি! গত কদিন থেকে ভোর হওয়ার আগেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। মনে শঙ্কা জাগছে, পারব তো ঠিকঠাক মতো ক্লাস সামাল দিতে? কোভিডের পর থেকে ক্লাসরুম মেইনটেইনের কাজটা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে!
বাইরের কাজ সামাল দেওয়ার আগে ভাবতে হয় ঘর ঠিক রাখার ব্যাপারটা! তাই পরবর্তী সপ্তাহের জন্য কাজ গুছিয়ে রাখার জোগাড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছি। স্বামীকে মাত্র পাঠালাম গ্রোসারি সারতে। ক্লোজেটের কাপড় গুছিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে পা বাড়াব, তখনই দুলে উঠল মাথাটা, তাল সামলাতে না পেরে চেস্ট-অব-ড্রয়ারের ওপর হাত ঠেকিয়ে ভর দিলাম। ভাবলাম, নিশ্চয় গত কদিনের অনিদ্রা আর টেনশনে মাথাটা ঘুরে উঠেছে। মুহূর্তেই ভুলটা বুঝতে পারলাম। না আমার মাথা ঘুরছে না, দুলছে সারা ঘরটাই! ভূমিকম্প! মৃদু ভূমিকম্পকে প্রথমে অনেক সময় মাথা ঘোরা বলেই মনে হয়। কিন্তু এ ঘোরপাক, আর দোলন তো আর থামছে না! আমার পড়ার টেবিল আর চেয়ার দুলছে, দুলছে চেস্ট-অব-ড্রয়ারটিও। মনে হলো, অগুনিত প্রহর পেরিয়ে যাচ্ছে... সম্বতি ফিরে পেতেই স্বামীকে কল দিলাম। ফোন ধরলেন না।
হতচকিত, দুর্বল মন, ইচ্ছে হচ্ছে কারও সঙ্গে অনুভূতি ভাগাভাগি করতে! আচ্ছন্নের মতো সদর দরজা গলিয়ে বাইরে এলাম। এ ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের এই নীরবপাড়া সরব করার কারও ইচ্ছে আছে বলে মনে হলো না। চারপাশ সুনসান।
এ যে ক্যালিফোর্নিয়া! ক্যালিফোর্নিয়ার নীল আকাশ, নৈসর্গিক দৃশ্য, প্রায় নিখুঁত আবহাওয়া আর উজ্জ্বল সূর্যালোক উপভোগ করবেন আর মাঝেমধ্যে ভূমিকম্পের ধাক্কাটা সইবেন না, তা কী করে হয়?
ঘরে এসে মেয়েদের এবং বোনকে গ্রুপ টেক্সট পাঠালাম। ‘তোমরা কি ঠিক আছো? ভূমিকম্প টের পেয়েছো?’ এরা তিনজনই ভিন্ন শহরে বাস করে। কেবল বোন জানাল, সে টের পেয়েছে।
ভাবছেন, ভূমিকম্পের দিন তারিখ জানালাম না কেন? আসলে এত বাংলাদেশের ‘মেঘ-বৃষ্টি’ খেলার মতো। গুরুতর না হলে পাত্তা দেওয়ার সময় কই? আমি ঘরে একা ছিলাম, কিছুটা আলুথালু মানুষ, এত বছর ক্যালিফোর্নিয়া থেকেও দেশের অভ্যাস পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। তাইতো ৪.৪ মাত্রার এ ভূমিকম্প নিয়ে কথা বাড়িয়েই যাচ্ছি।
তবে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগকে যত অবজ্ঞাই করা হোক না কেন, এখানকার বাড়িঘর তৈরি হয় ‘আর্থকোয়াক-প্রুফ’ করে। একতলা, কাঠের ফ্রেমের বাড়ির ছড়াছড়ি সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায়। আর সাধারণেরা আসবাবপত্রও কেনেন ‘আর্থকোয়াক-প্রুফ’। বুঝলেন তো? আসবাবপত্র ডিজাইন করা হয় ভূমিকম্পের কম্পন প্রতিরোধক করে। সঠিক সামগ্রী ব্যবহার ছাড়াও ভারী আসবাপত্র যাতে কম্পনের ফলে আপনার গায়ে না এসে পড়ে সেটা নিশ্চিত করা হয় স্ট্র্যাপ বা হুক দিয়ে দেয়ালের সঙ্গে তা সুরক্ষিত করে দিয়ে। দেয়ালে ছবি ঝোলাবেন? আছে আর্থকোয়াক-প্রতিরোধক ব্র্যাকেট! বিছানার ওপর দেয়ালে ভারী ছবি ঝোলানো নৈব নৈব চ। কাচের জানালা লাগানোর ব্যাপারেও নেওয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রতিটি গৃহেই মজুদ থাকে আর্থকোয়াক-কিট (খাবার পানি, শুষ্ক-খাবার, ফার্স্ট-এইড বাক্স ইত্যাদিসহ ব্যাগ)। অন্য কথায়, ‘Be Prepared, Not Scared’.
অতএব বুঝতেই পারছেন, আমার মতো দুর্বল চিত্তের মানুষেরাই এখানকার সাধারণত ঘটনাকে, অসাধারণে রূপ দিতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বসে ‘এইমাত্র ভূমিকম্প হলো, তোমরা কি টের পেয়েছিলে?’
সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় বেশ কয়েকটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ‘ফল্ট-জোন’ সচল অবস্থায় রয়েছে। তাই ভূমিকম্পের আশঙ্কা এখানে সব সময় আছে। উন্নত দেশ বলেই রয়েছে নানা কার্যকরী পদক্ষেপের ব্যবস্থা। তবে প্রলয়ঙ্কারী কিছু ঘটে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তেই অথবা না–ও ঘটতে পারে এক যুগেরও মধ্যে। আমাদের মতো সাধারণেরা কেবল আশা করতে পারি, পৃথিবী পৃষ্ঠের এ কম্পন যেন পৃথিবী স্বল্পের মধ্যেই সীমিত রাখে। দয়া হোক, বেঁচে থাক সব প্রাণ পৃথিবী আলো করে!
*লেখক: শবনম চৌধুরী, এলিমেন্টারি স্কুল টিচার, ক্যালিফোর্নিয়া
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]