জাপানের ইয়োকোহামায় দুর্গাপূজা উদ্‌যাপিত

‘বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো রে ভুবন

বাজলো তোমার আলোর বেণু

আজ প্রভাতে, সে সুরও শুনে খুলে দিনু মন।

বাজলো, বাজলো বাজলো তোমার আলোর বেণু।’

পিতৃপক্ষে তর্পণ শেষে মহালয়ার চণ্ডীপাঠের পর দেবীপক্ষের শুরু। তখন থেকেই পুজো পুজো একটা ভাব সবার মনের মধ্যে চলে আসে। তখন ঠাকুর গড়া মোটামুটি শেষের দিকে থাকে। ষষ্ঠীতে দেবীর চক্ষুদান, তারপর সপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমী এবং বিজয়া দশমীর পূজা।

বাংলাদেশে এ বছর ৯ অক্টোবর থেকে বাঙিলি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। তবে জাপানের কানাগাওয়া জেলার ইয়োকোহামাতে প্রতিবছরের মতো এবারও শান্তিসুধা হিন্দুমন্দির যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজা উদ্‌যাপন করেছে। এবারের পূজা ছিল জাপানে শান্তিসুধা হিন্দুমন্দির আয়োজিত দ্বিতীয় পূজা।

জাপানে কোনো একটি হল ভাড়া নিয়ে পূজা করা হয়। আর আক্ষরিক অর্থে এই হলই সেদিন আমাদের মন্দির হয়ে ওঠে। আর আমাদের সেই সাময়িক মন্দিরে যেন মানুষের ঢল নামে। সকাল থেকেই সবাই উপোস থেকে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য জনে জনে এসে উপস্থিত হতে থাকেন। সবাই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে পুজো খুব উপভোগ করেছেন। নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে রাখার পর ছেড়ে দিলে যেমন আপন গতিতে চলার আনন্দে আত্মহারা হয়ে বয়ে যায় নদী, তেমনই সবার মনের মধ্যেও আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যাচ্ছিল। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সবাই অংশগ্রহণ করেছেন।

সকাল নটার দিকে ইয়োকোহামার কোহোকু ওয়ার্ডের কোহোকু সিটি হলে পূজারিরা এসে উপস্থিত হতে শুরু করেন। তখন থেকেই চলে পুজোর তোড়জোড়। সবাই মিলে সাজিয়ে নেন পূজার বেদি। বেলা ১১টার দিকে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পূজায় পৌরহিত্য করেন শ্রী চিন্ময় চক্রবর্তী।

বোধন থেকে শুরু করে ষষ্ঠী পুজো, সপ্তমী পুজো, অষ্টমী পুজো, নবমী পুজো, দশমী পুজো নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। বেলা দেড়টা নাগাদ অঞ্জলি দেওয়া হয়। ভক্তদের ভিড়ে দ্বিতীয়বার অঞ্জলির আয়োজন করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ, তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছোটরা বরাবরের মতো তাদের পরিবেশনার মাধ্যমে সবার মন জয় করে নেয়। পরিবেশনার মধ্যে ছিল ছড়া, গান ও নাচ। আয়োজকেরা নিজেরাই তাদের পরিবেশনা দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাজিয়ে নেন, তাঁদের গান দিয়ে মাতিয়ে রাখেন উপস্থিত সবাইকে।

চমৎকার রোদঝলমলে দিনের আজকের অনুষ্ঠানে টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাসের পলিটিক্যাল মিনিস্টার শেখ ফরিদ সস্ত্রীক পূজায় উপস্থিত হয়ে সবাইকে উৎসাহিত করেন। মোটামুটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও এক ফাঁকে আমরা শেখ ফরিদের মূল্যবান ভাবগম্ভীর বক্তব্য শুনে নিই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে সন্ধ্যারতির পর বিবাহিত নারীরা দেবীর বিসর্জনের পর সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। আর দেবীকে আসছে বছর আবার হবে বলে সবাই প্রত্যাশায় বুক বাঁধেন।

এবারের পূজার অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সার্বিকভাবে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেছেন শান্তিসুধা হিন্দু মন্দিরের কিশোর কান্তি বিশ্বাস, অসীমানন্দ মল্লিক, প্রসেনজিৎ ঘোষ, সর্বাণূ দাস, কৃষ্ণ কমল সাহা, অমিত গুপ্ত, অনিক সাহা, শুভেন্দু বিশ্বাস, সৌমিত্র ঘোষ, ঈশ্বরীপ্রসাদ বিশ্বাস, শংকরীপ্রসাদ বিশ্বাস, কিশোর পাল, আনন্দ ঘোষ, স্মৃতি বড়ুয়া, তনুশ্রী বিশ্বাস, মিজ জিতু বিশ্বাস, মিজ সংগীতা রাজবংশী দাস, বনানী বিশ্বাস, মিতালী ঘোষ, শর্মিষ্ঠা পাল রাখি, অদিতি বিশ্বাস, মৌমিতা বিশ্বাস মৌ, মন্দিরা রায়, সংগা ঘোষ, কাকলি পাল, মৌসুমী গুপ্ত এবং আরও অনেকে।

পরিশেষে ভক্তরা ‘বলো দুর্গা মা-ই কী জয়, আসছে বছর আবার হবে’ বলে দেবী দুর্গা মাকে বিদায় জানান এবং একে অপরকে আলিঙ্গন করেন। আর এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় আমাদের এবারের পুজোর সব আয়োজন।

*লেখক: শান্তিসুধা হিন্দুমন্দির, জাপানের পক্ষে, তনুশ্রী বিশ্বাস