গাজায় ধ্বংসের মহামারি: চুপ কেন আরব বিশ্ব

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলছবি: রয়টার্স

গাজার আকাশজুড়ে আগুন, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর বাতাসে বারুদের গন্ধ। প্রতিদিন শত শত বোমা ঝরছে, শত শত প্রাণ নিভে যাচ্ছে। হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থীশিবির—কোথাও নিরাপত্তা নেই। যেখানে শিশুদের খেলার কথা, সেখানে আজ তাদের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে। মা তাঁর নিথর সন্তানের হাত ধরে কাঁদছেন, বাবা পরিবারকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গেছেন। কিন্তু বিশ্ব? তারা দেখেও না দেখার ভান করছে। আর মুসলিম বিশ্ব? তারা চুপ! গত কয়েক মাসে গাজায় যা ঘটেছে, তা ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যাগুলোর একটি। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরায়েলের অবিরাম বিমান হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু। আহত হয়েছে আরও কয়েক লাখ। শহর পরিণত হয়েছে এক ধ্বংসস্তূপে। খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা—কোনো কিছুরই ব্যবস্থা নেই। গাজার প্রতিটি কোণে শুধু কান্নার শব্দ, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানুষের আর্তনাদ। এক রাতেই ৩৩০ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু! হাসপাতালের বিছানাগুলো রক্তে ভিজে গেছে, কোথাও অক্সিজেন নেই, কোথাও ওষুধ নেই। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমাদের কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধু মরদেহ আর ধ্বংসস্তূপ ছাড়া।’

এই মানবিক বিপর্যয়ের সময়েও মুসলিম দেশগুলো নীরব। তাদের নীরবতা কি ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনেরই নামান্তর? আরব বিশ্ব কি শক্তিহীন, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে নীরব? আরব দেশগুলো কি আসলেই কিছু করতে পারে না, নাকি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে চুপ করে আছে? ইতিহাস বলে, মুসলিম দেশগুলো চাইলে বিশ্বরাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। অথচ গাজা যখন ধ্বংসের মুখে, তখন তারা কেবল উদ্বেগ প্রকাশ করছে, বিবৃতি দিচ্ছে, কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের বড় বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তি যেমন সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর—তারা কী করছে? মুসলিম দেশগুলোর সামরিক শক্তি এত বিশাল, অথচ ফিলিস্তিনিদের বাঁচানোর জন্য তারা কিছুই করছে না।

কূটনৈতিক ব্যর্থতা, নাকি স্বার্থের রাজনীতি? অনেক আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, কেউবা অর্থনৈতিক চুক্তি করেছে। এর ফলে গাজার বিপর্যয়ে তারা মুখ খুলতে পারছে না। কারণ, তাদের স্বার্থ জড়িত। তারা জানে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেলে পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, তাদের সরকার টলিয়ে দিতে পারে। এর ফলে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা ফিলিস্তিনিদের রক্তকে উপেক্ষা করছে। এদিকে পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরের মতো ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে। আমেরিকা সরাসরি ইসরায়েলকে অস্ত্র দিচ্ছে, বোমা দিচ্ছে, আর জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পক্ষে যেকোনো পদক্ষেপকে আটকে দিচ্ছে।

গাজা কি একাই লড়বে? প্রশ্ন হচ্ছে, ফিলিস্তিনিরা কি একাই লড়বে? শিশুরা কি একাই মরবে? প্রতিদিন শত শত নিরীহ মানুষের মৃত্যু দেখে বিশ্ব চুপ থাকতে পারে, কিন্তু মুসলিম দেশগুলো কীভাবে চুপ থাকে? ইসলামি ঐক্যের কথা বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে মুসলিম বিশ্ব যখন গাজার পাশে দাঁড়ানোর কথা, তখন তারা নীরব। অথচ ইসলামের শিক্ষা কী বলে? আমাদের নবী (সা.) কি কোনো নিরপরাধ মানুষের ওপর অন্যায় হলে চুপ থাকার শিক্ষা দিয়েছেন? সমাধান কী? এই হত্যাযজ্ঞ থামাতে হলে মুসলিম দেশগুলোকে একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে। শুধু বিবৃতি দিলে চলবে না, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

কিছু করণীয় হতে পারে—

তেল নিষেধাজ্ঞা: আরব দেশগুলো যদি ইসরায়েলের মিত্রদেশগুলোর কাছে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে বড় অর্থনৈতিক চাপে পড়বে তারা।

কূটনৈতিক চাপ: মুসলিম দেশগুলো একত্র হয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ আনতে পারে।

মানবিক সহায়তা: গাজায় জরুরি খাদ্য, পানি, ওষুধ ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

সামরিক শক্তির ব্যবহার: মুসলিম দেশগুলো যদি সামরিকভাবে ইসরায়েলকে সতর্ক করে, তবে ইসরায়েল এত সহজে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালাতে পারবে না। ইতিহাস একদিন প্রশ্ন করবে, ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে—যখন গাজা জ্বলছিল, তখন মুসলিম বিশ্ব নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। যখন একটি শিশু ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে কাঁপতে কাঁপতে বলছিল, ‘মা, আমি কি বেঁচে আছি?’ তখন মুসলিম দেশগুলোর রাজা, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টরা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিলেন।

আজ যদি গাজার জন্য কিছু না করা হয়, তবে একদিন এই নীরবতা মুসলিম বিশ্বেরই পতনের কারণ হবে। তাই এখনো সময় আছে, দাঁড়ান, প্রতিবাদ করুন, গাজার পাশে থাকুন। কারণ, গাজার ধ্বংস মানেই মানবতার পরাজয়।

লেখক: হাসিবুর রহমান, শিক্ষার্থী, ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়