প্রবাসে হৃদয়ে বাংলাদেশ
আমার নাম বাংলাদেশ। ভাষা বাংলা, দেশও বাংলা। কী চমৎকার! এ নাম আমি পেয়েছিলাম আমার পুর্বপুরুষদের থেকে। আমার তিন দিকে ভারত ভূমি, তবুও আমি গর্বের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার কোলে জন্ম নেওয়া আমার পূর্বের সন্তানেরা আমাকে খুব ভালোবাসত।
আমার ওপর পরপর কয়েকবার বড় ঝড় এসেছে।
কিন্তু আমার সন্তানেরা আমাকে বড় বিপদ থেকে রক্ষাও করেছে। একবার আমার নামও বদলে দিয়েছিল। কিন্তু বহিঃশত্রুকে তাড়িয়ে আমার সন্তানেরা আমাকে মুক্ত করেছে। আমার অনেক সন্তান আমার জন্য জীবনও দিয়েছে। তারা আমার বুকে আশ্রিত আমার ভালোবাসায়। আমাকে তারা ভালোবাসা দিয়ে মুগ্ধ করেছে।
ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা আমার সন্তানদের নিয়ে সুখে কাটাব। কারণ, আমার তো সবই আছে। আমাকে আমার সন্তানেরা স্বাধীন করেছে, তাই তাদের জন্য আমি সব উজাড় করে দিয়েছি। আমার ভূমিতে তারা যা রোপন করছে, তাতেই ফলছে প্রচুর ফসল এবং আমিই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে যে যা ইচ্ছে তাই ফলাতে পারে।
সবাই বলে আমি নাকি সোনার বাংলা। আমাকে সকল দেশের রানী বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমি অনেক আশা ভরসা নিয়ে শুরু করেছিলাম এক উন্নত সমাজ গঠনের এই যাত্রা।
আমি চেয়েছিলাম আমার সন্তানদের নিয়ে সারা বিশ্বের বুকে গর্বের সঙ্গে বসবাস করব। কিন্তু কী চেয়েছিলাম আর কী হতে চলেছে!
আজ ৫২ বছর কেটে গেল! কিন্তু কোথায় সেই উন্নত সমাজ? আমি তো আর পারছি না এই পশ্চাদপদতা সহ্য করতে! কী অন্যায় আমি করেছি যে আমার নিজের সন্তানেরা আজ আমার বুকে ঢালছে বিষাক্ত বিষ? আমার উর্বরতাকে করছে ধ্বংস? আমার কর্মক্ষমতা করছে নষ্ট?
আমার ভূমিতে বাস করা নানান জাতিসত্তার মধ্যে সৃষ্টি করছে বিভেদ? ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের করছে বিতাড়িত? অথচ সবাই আমার সন্তান। তারা নিজেদের মধ্যে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে একে অপরকে শেষ করছে।
তারা আমার নামের ওপর কলঙ্কের ছাপ ফেলছে। এগুলো নিয়ে আমাকে গোটা বিশ্বের সবাই ঠাট্টা করছে! আমাকে সবাই কলঙ্কিনী বলছে!
আমাকে অনেকে বলেছে আমার সন্তানেরা অনেকেই দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর। কিন্তু কেন? কী অন্যায় আমি করেছি যে আমার সন্তানরা আমাকে সারা বিশ্বের কাছে এত ছোট করছে? ছোটই যদি করবে, তবে কেন তারা আমাকে বহিঃশত্রু তাড়িয়ে স্বাধীন করেছিল? আমিতো আর সহ্য করতে পারছি না!
তারা দিনের পর দিন অন্ধকার আর অধঃপতনের দিকেই কি চলবে? তারা নৈতিকতা এবং সুশিক্ষা বিসর্জন দিতে চলেছে। তারা কুশিক্ষার বীজ বপন করতে শুরু করছে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক বড় বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট, উত্তম পাঠ্যপুস্তকের অভাব এবং অতি অবশ্যই ভালো শিক্ষকের অভাব খুব লক্ষণীয়। কিন্তু তারা এখনো ভালো শিক্ষক তৈরির কোন ভিত গড়ে তুলতে পারেনি এবং এটা নিয়ে কেউ ভাবতেও চায় না।
চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম না চালিয়ে শুধু লাখো সার্টিফিকেটধারী গ্রাজুয়েট বের করে তারা আমার সংকট আরও ঘনীভূত করছে যেটা কেউ মানতে নারাজ। চাহিদাভিত্তিক, জ্ঞাননির্ভর, পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন যে সত্যিকারের মানবসম্পদ তৈরির সেরা উপায় সেটাও তারা স্বীকার করছে না। তাই সারা দেশে স্কুল-কলেজে ছেয়ে গেলেও মানসম্পন্ন সুশিক্ষা ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে না।
যাদের শিক্ষার কারিগর বলে আমি গর্ব করতাম তারাও এখন উঠে–পড়ে লেগেছে আমার মুখে চুনকালি মাখাতে। তারা শুধু দায়িত্ব-কর্তব্য অবহেলাই নয়, সক্রিয়ভাবে পরীক্ষায় নকল করাকে সাহায্য করছে, যাতে করে প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে না হয় পরীক্ষার খারাপ ফলাফলের কারণে। তারা আমাকে পৃথিবীর নিম্নমানের সারিতে ফেলতে চেষ্টা করছে। আমার ১৭ কোটি সন্তানের মধ্যে কেউ কি নেই যে এর প্রতিবাদ করতে পারে? আমার এই দুর্দিনে কি কেউ নেই যে সত্যি আমাকে সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে? সকল মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারে?
কেন এত নিশ্চুপ তারা?
কেন?
আমার ভালোবাসা তো তাদের জন্য কখনো কমেনি!
আমার যা আছে তা যদি তারা মিলেমিশে দেখাশোনা করে রাখে তাদের তো কষ্টে থাকার কথা নয়।
আমাকে তারা সোনার বাংলা করার স্বপ্ন দেখিয়েছে। তারা প্রতিদিন শপথ গ্রহণ করে আমাকে ভালোবাসে বলে অথচ তার পরেও কীভাবে তারা পারে আমাকে এ ভাবে কষ্ট দিতে?
আমার গর্ব, আমার বিশ্বাস, আমার আশা, আমার ভরসা তারা কি ফিরিয়ে আনতে পারবে না আমার বুকে?
আমাকে তারা কি সুশিক্ষিত় জাতি গড়ে দিতে সক্ষম হবে না?
আমি তো কলঙ্কিনী মা হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না!
আমি ভালোবাসার সোনার বাংলা হয়ে তাদের মাঝে থাকতে চাই। আমাকে তারা সোনার বাংলা করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমি চাই, তা তারা প্রতিটি পদক্ষেপে পালন করুক।
তারা সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের মাঝে আমাকে মর্যাদাশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলুক। আমার প্রত্যেকটি সন্তান গর্বের সঙ্গে মনে-প্রাণে ও ধ্যানে বলুক—সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি।
আমি এতক্ষণ দেশটি কী প্রত্যাশা করে সেটাই মূলত তুলে ধরেছি আমার অনুভূতি থেকে।
এখন আসুন আমার নিজের কথায়।
আমি এখন বসবাস করি দূরপরবাসে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর দেশ ছেড়েছি, অনেক কিছুর পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন হয়েছে। কী বলব আর কী লিখব আজি এ মুহূর্তে! ভাবনার জগতে কত কথাই না মনে পড়ছে, মনে পড়ছে আমার ছেলেবেলার সেই দিনগুলোর কথা। আবার এসেছি ফিরে গ্রামবাংলার কোলে, যেখানে কেটেছে আমার শৈশব। পলো দিয়ে মাছ ধরেছি। মসুর, খেসারি, মুগ, কলাই তুলেছি। পাট, শর্ষে এবং ধানখেতে কিষানের খাবার নিয়ে গিয়েছি। কেটেছি সাঁতার, দিয়েছি পাড়ি, নবগঙ্গা নদীর এপার থেকে ওপারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে গোসল করেছি, চোখ রাঙা করে ফিরেছি বাড়ি, খেয়েছি মায়ের হাতে পিটুনি।
মাঝেমধ্যে নদীতে মাছ ধরেছি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কুড়িয়েছি আম। খেজুর গাছের রস খেয়েছি মাঝে মধ্যে, হোক না তা নিজের বা পরের বলে কথা নেই, খেতে ইচ্ছে হয়েছে খেয়েছি। ধরা খেয়ে বকা খেয়েছি, পিটুনি খেয়েছি, মজার সঙ্গে সব বরণ করেছি।
আজ এত বছর পরে মনে পড়ে গেল সেইসব স্মৃতি, মনে পড়ে গেল সেই নহাটা বাজার, স্কুল এবং সেখানকার মানুষের কথা। ভাবছি আমি একা বসে স্মৃতির জানালার পাশে। অতীতের স্মৃতিগুলো এসেছে ফিরে মোর হৃদয়ে, যারে আমি বেসেছি ভালো মনে প্রাণে। সে এক গভীর সম্পর্ক যা শুধু অনুভব করা যায় ভালোবাসার হৃদয় দিয়ে।
আমি গড়ে উঠেছি তিলে তিলে সেই স্মৃতি ঝলমল সবুজে ভরা গ্রামবাংলার ইছামতী বিলের পাশে। সেই পানি টলটল নবগঙ্গা নদীর ধারে। আমি পড়েছি নহাটা স্কুলে, পড়েছি গঙ্গারামপুর স্কুলে, পড়েছি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এবং কলেজে, শেষে ইউরোপ, জাপান এবং আমেরিকার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমি স্টকহোম স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করেছি। আমি গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন মানেজমেন্ট, ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যালসের ডিরেক্টর হয়েছি।
আমি বিশ্ব নাগরিক হয়েছি। আমি একজন আদর্শ স্বনামধন্য চাকরিজীবী এবং সুন্দরী রমণীর স্বামী হয়েছি। আমি দুজন উদীয়মান (rising star) টেনিস তারকার বাবা হয়েছি। আমি বাংলাদেশে আমার বাবা-মার পরিবার গঠনে অবদান রেখেছি, যেখানে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যের কাহিনি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু যে ইছামতী বিলের পাশে আমি জন্মেছি এবং গড়ে উঠেছি নবগঙ্গা নদীর তীরে, এর চেয়ে বড় পাওয়া পাইনি জীবনে এখনো। কারণ, বিশাল বিলের পাশে আর দেশখ্যাত নবগঙ্গা নদীর তীরে আমার জন্ম এবং যেখানে কেটেছে আমার ছোটবেলার দিনগুলো তার তুলনা অন্য কারো সঙ্গে করার মতো জায়গা পৃথিবীর কোথাও দেখিনি আজও। গ্রামের কাছে, গ্রামের মানুষের কাছে, গ্রামের আলো বাতাসের কাছে, আমার যে অনেক ঋণ হয়ে আছে।
মনে হচ্ছে নহাটায় জন্মগ্রহণ করেছিলাম বলে আমার মনপ্রাণ আজ এত বড় হয়েছে, জন্ম আমার ধন্য হয়েছে। তবে হ্যাঁ, বিদেশে এসে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে, মনের মতো জায়গাটি দখল করে নিতে। তাইতো আজ নতুন প্রজন্মদের সঙ্গে মনের আনন্দে ভাগাভাগি করছি আমার জীবনের মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা আর সুশিক্ষা (যে শিক্ষায় দুর্নীতি নেই, আছে মানবতা এবং মূল্যবোধ)। কারণ, আমি আশা করি বাংলার নতুন প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হবে আমাকে দেখে।
আমি প্রায় ২০-২১ বছর বাংলাদেশে কাটিয়েছি। এই সময়টাতে বাংলাদেশ আমাকে যা দিয়েছে, পুরো পৃথিবী তার অর্ধেকও দিতে পারেনি গত ৪০ বছরে। গ্রামের বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক-স্কুল, সাথিরা, খেলার মাঠ-সাথি এবং সেই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা পরিবেশ আমাকে তৈরি করেছে ভালোবাসার ছোঁয়ায়। সে ছোঁয়া আমি অনুভব করি প্রতিটি মুহূর্তে, অনুভব করি প্রতিটি নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে আর বিশ্বাসে। তাইতো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, নহাটায় জন্মগ্রহণ করে আমি যখন আমাকে মনের মতো করে গড়তে পেরেছি, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কেন পারবে না? আমি মনে-প্রাণে এবং ধ্যানে বিশ্বাস করি তারাও পারবে জীবনে বড় হতে। দরকার শুধু সাধনা, চেষ্টা, মোটিভেশন এবং আত্মবিশ্বাস।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু কর্মে সমাধান।
আমাদের সময়ে যোগাযোগব্যবস্থা এত ভালো ছিল না। নহাটা থেকে ঢাকায় যেতে পুরো একটা দিন পার হয়ে যেত। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিঠি যেতে লাগত একমাস। উত্তর পেতে লাগত আরও একমাস! কিন্তু আজ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটেছে। ইন্টারনেট আমাদের হাতে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারকে উম্মুক্ত করে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই জ্ঞান ভান্ডারকে নতুন প্রজন্ম নিজেদের মতো করে আবিষ্কার করবে। সেই জ্ঞানের আলোয় নিজেদের আলোকিত করবে। মনে রাখবে—সমসাময়িক শিক্ষাব্যবস্থা যদি তোমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য না করে, বা তোমাদের মধ্যে আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য না করে, তবে সে শিক্ষা সুশিক্ষা নয়। কারণ, সুশিক্ষা পরিপূর্ণতার এক প্রকাশ।
এ মুহূর্তে দূর-পরবাস থেকে আমি নহাটার কথা ভাবছি, আমি ৬৮ হাজার গ্রামের কথা ভাবছি। আমি মাগুরার কথা ভাবছি, ভাবছি ৬৪টি জেলার কথা। আমি নতুন প্রজন্মের কথা ভাবছি, আমি সোনার বাংলার কথা ভাবছি। আমি মানুষের কথা ভাবছি। ওই যে নবগঙ্গা নদী আর ইছামতির বিল, তার কথা ভাবছি। এর আশপাশে বসেই তোমরা কেউ হয়তো আমার এই লেখা পড়ছ! আমি তোমাদের কথা ভাবছি। হয়তো তোমাদের মাঝে অনেকেই একদিন অনেক বড় হবে আর পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আমার মতো করে এমনই আশার কথা লিখবে। আমাদের আচরণ, আমাদের প্রচেষ্টা, আমাদের নৈতিকতা, আমাদের ভালোবাসা— করিবে ধন্য, গড়িবে দেশ, নামটি হবে সোনার বাংলা, আমার প্রিয় বাংলাদেশ।