আবারও সিংহের মাথায় কিছুক্ষণ

ধরা যাক, সোয়া ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টার একটা যাত্রা শুরু হলো। তার আগে আবহাওয়ার দিকে সংক্ষেপে নজর দিতে হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি শহর কেপটাউন, যাকে সৌন্দর্যের রানি বলা হয়ে থাকে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিশ্বের মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবে। যেখানে আবহাওয়া ঘণ্টায় ঘণ্টায় রূপ পাল্টায়। এই গরম তো এই শীত। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। এই শান্ত পরিবেশ তো এই অশান্ত বাতাস। ভারি মজা লাগে আবহাওয়ার এই সদ্‌গুণ চরিত্র। তবে আজকের যাত্রার দিনে কেপটাউনে তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রির নিচে, নিশ্চয় কনকনে ঠান্ডা।

আমার যাত্রা হলো শুরু, যতই টিপে টিপে কুয়াশা আসুক, আর শরীর–কাঁপানো বাতাস উঠুক, তবু ইচ্ছা হলো পাহাড় আহরণ করব। লায়ন’স হেড পর্বত। কেপটাউনের জনপ্রিয় ও দর্শনীয় একটি স্থান। বহু পর্যটকদের আনাগোনা। নিজ পায়ে শৃঙ্গের চূড়ায় উঠতে হয়। এর আগে যখন উঠেছিলাম, তখন একা হলেও এবার একা নই। জাকারিয়া ছিল সঙ্গী হয়ে।

একদম সহজ কাজ। দুই পা ফেলে তো তা–ই মনে হলো। যেহেতু এটি পর্যটন বুভুক্ষিত বা ক্ষুধার্ত একটি সিংহ, সেহেতু আমার ধারণা জন্ম নিল যে আমি খুব সহজেই চূড়ায় পৌঁছাতে পারব। একটু একটু করে হাঁটছি ওপরের দিকে আর গুনগুন করে গেয়ে নিচ্ছি, যে গান পাহাড় দেখলেই মনে পড়ে—‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ।’

দেশি–বিদেশি পায়ের অত্যাচারে কর্কশ বা তীক্ষ্ণ ধারালো খরশান পাথর যেন আজ মনখোলা। আর নারী-পুরুষের চলাচলে সিংহের মাথায় উঠতে একমাত্র পথটার বাতাস হয়ে উঠেছে একধরনের মিশ্র খুশবু।

নিজের গান গাওয়া সুর ভালো লাগছিল। তাই কণ্ঠস্বরের ভলিউম আরও বাড়িয়ে দিলাম। বাঁয়ে চাহিয়া দেখি, বাইরে থেকে আসা একটি মেয়ে তার নিজের এয়ারফোনটি তার দুই কানে গুঁজে দিল। কারণ, আমার কণ্ঠস্বর তার কানে নিশ্চয় খারাপ লাগছিল। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’—গানটি গাওয়া তো দূরের কথা, বরং তখন আমি বুঝতে পারলাম আমার কণ্ঠস্বরের ওজন কত। দ্রুতলয়ে থামিয়ে দিলাম আমার অপ্রকৃষ্ট বিশ্রী অসঙ্গলমার্কা কণ্ঠ। নিজের রান্না নিজের কাছে ভালো লাগে। নিজের গান গাওয়া নিজের কাছে ভালো লাগে। আমি সেই দলের অন্তর্ভুক্ত।

ছন্দে ছন্দে এক পা দুই পা কর বেশ দূর এগিয়ে গেছি। রাস্তা পাহাড়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু চেটাল চেটাল বৈচিত্র্যহীনভাবে চূড়া পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। কখনো স্বাভাবিক নিয়মে হাঁটা, কখনো লাফিয়ে লাফিয়ে চলা, কখনো ডিঙিয়ে উল্লম্ফনে সাহস দেখানো, কখনো অগোচরে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির হাতের তত্ত্বাবধানে যাওয়া, কখনো অন্যের কাছ থেকে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যাওয়া, কখনো সিঁড়ি বা মই বেয়ে বেয়ে ওঠা, কখনো পেছন ঠেকিয়ে দিতে হয় পাথরে, এ ধরনের নানান ভিন্নতা চলন্ত চারিত্রিক পরিবর্তন করে পথ চলতে হয়েছে।

পিপাসা লেগেছে প্রচুর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এ গলায় ভোজন সংগীতে হয়তো ভালো সুর হবে। তা গাইতে গিয়ে শচীন দেববর্মনের শেষ বয়সের কণ্ঠস্বরের চেয়েও বয়স্ক মনে হচ্ছিল। তাই পকেটে রাখা পানির বোতল বের করে পান করে নিলাম।

গা ঘামতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। জবুথবু হয়ে যাওয়া শীত শরীরে আর কাজ করে না। লায়ন’স হেডের মাথায় উঠতে হবে। শুরু থেকে যে পরিমাণ পোশাক গায়ে ব্যবহার করি, এখন তা আর নেই। এমন কনকনে শীতেও যে গা ঘেমে যাবে, এর আগে এমন অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই এমন অনিচ্ছাকৃত গোলমেলে ভ্রান্তি।

কোনো ছোট্টবেলায় জাম্বুরার খোসার ভেতরে খড় ঢুকিয়ে বল খেলেছি। দৌড়ানো তো দূরের কথা, হাঁটাও হয় কি না কত বছর, তা–ও ভুলে গেছি। দাঁড়িয়ে কাজ করতে করতে পায়ে জং ফেলে দিয়েছি। এই জং পা দিয়ে সিংহের মাথায় ওঠার বাসনা। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, বাক্যটি সাদা কাগজে লেখা যতটা সহজ, জং ধরা পা দিয়ে পাথর ডিঙিয়ে এবং চলনের চরিত্র ভেঙে বা সম্মান করে সিংহের মাথায় ওঠা ততটা সহজ বা অকষ্টকল্পিত নয়।

সম্ভবত মধ্যবিন্দুতে অবস্থান করছি এখন। বাঁ পাশে কিন্তু সমুদ্র। এখান থেকে ছিটকে গেলে সমুদ্রের জলে চিতপটাং। ঝরঝরে যৌবনে খেজুরগাছের মাথায় উঠে পুকুরের পানিতে মাছরাঙা পাখির মতো মাথা উল্টিয়ে ঝপাৎ করে লাফ দিয়েছি বহু বহু বার। এখানে এসে সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেল। এ ধরনের চঞ্চলতা–বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে মায়ের হাতে চড়থাপ্পড় কম খাইনি। ইচ্ছা জেগেছিল একটা লাফ দিই সমুদ্রের শীতল পানিতে।

পুকুরের পানিতে যখন লাফ ঝাঁপ দিতাম, তখন প্যারাগ্লাইডিংয়ের নাম শুনিনি। জানলে হয়তো আমার বাবা, আমাকে মারধর করতে মানা করতেন মাকে। আমাকে প্যারাগ্লাইডিং কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার বাসনা শোনাতেন। মন্দ হতো না। পাখির মতো উড়তাম, বাতাসে ভাসতাম। সমুদ্রের ওপর দিয়ে ঘুরতাম, পাহাড়ের মাথায় থাকতাম। যাহোক, যা হতে পারিনি, তা লায়নকে শুনিয়ে কী লাভ?

পায়ের রগ টেনে ধরে, পিপাসার্ত হয়ে যাই। জল পান করি। সমুদ্র দেখি। ঢেউয়ের পেছনে ঢেউ দৌড়াচ্ছে। কালো কালো পাখি বসে আছে। লতাপাতা ভেসে যাচ্ছে। সামুদ্রিক প্রাণী মাথা জাগিয়ে চলে যায়। চোখ যত দূর যায়, শুধু পানি আর পানি। লায়নের পেটের ওপর দাঁড়িয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের আকর্ষণে মন যখন এক্সট্রা আনন্দ উপভোগ করছে, তখন আমার চোখের সামনে এক অদ্ভুত মর্মযন্ত্রণা।

জানি না, মানুষ সাধনা করতে করতে কত সময়ে তার সাধন মেলে। একে তো আমার শরীর রসকষহীন ঘিঞ্জি সম্মিলিত, আর সামনে সিংহের পেটে যাকে দেখতে পাচ্ছি, তিনি তো একজন মধ্যবয়সী নারী। তিনি যে কত কষ্টে এখানে বসে আছেন, তা বলা মুশকিল। বিস্তৃত বেধবিশিষ্ট মোটা মানুষ। জানি না তিনি কীভাবে সিংহের মাথায় উঠলেন।

কী করে পাথর, মই ও শিকল ডিঙিয়ে ২ হাজার ২০০ ফুট ওপরে উঠলেন? কত সময়ে পরে তার সাধন মেলে? তার সঙ্গী হিসেবে আরও তিনজন মেয়ে আছে। তাকে রেখে ওরাও যেতে পারছে না। নামতে কত কষ্ট! পারছেন না। নামার গতি স্থির হয়ে আছে। কেঁদে কেঁদে অঝর ধারায় চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন এক কদম নিচেই আসার জন্য। এমনই একটা জায়গা, কোলে করে তো দূরের কথা, হাত ধরে কেউ সাহায্য করবে সে সুযোগ কারোই হচ্ছে না।

পা চলার গতি ধীর হয়ে এসেছে আমার। সামনে তাকিয়ে দেখি, মই বেয়ে উঠতে হবে। পাথরের ভেতরে রড গুঁজে গুঁজে মই তৈরি করা হয়েছে। খাড়া পাহাড়। মইয়ের বিকল্প কিছু নেই। ঠিক আমার সামনেই কিছু প্রাইমারি বাচ্চা, সঙ্গে একজন শিক্ষিকা। শিক্ষিকার বয়স ১৯ হতে পারে।

তিনি বেশ চটপটে, কথা হলো কিছুক্ষণ, প্রতি মাসের দ্বিতীয় শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টয় তাঁর দল নিয়ে সিংহের মাথায় ওঠেন। এলে দেখা হবে আবার—এমন আশার কথা জানিয়ে ধাপে ধাপে পা ফেলে উঠে যাচ্ছে টকাটক। আর তাঁর পেছনে বাচ্চাগুলো পাথর ডিঙিয়ে যেভাবে সরল ভঙ্গিতে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমি বোধ করলাম, শিশুগুলো সব সময় কোনো কিছু জয়ের জন্য উদ্বেলিত থাকে।

এরই মধ্যে লাল জুতা পায়ে একটা ষোড়শী মেয়ে আমাকে ‘সরি’ বলে পেছন থেকে দ্রুত গতিতে পা ফেলে সামনে চলে গেল এবং মই বেয়ে এক ধাপ ওপরে উঠে গেল লোডশেডিংহীন বিদ্যুৎ–গতিতে। তার স্পিড দেখে আমার স্পিড থমকে গেল। দাঁড়িয়ে রইলাম দুপায়ে। কিছুক্ষণ মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকলাম। রসবোধপূর্ণ ছিমছাম ফিগার। পিঠের ওপরে ব্যাগ ঝোলানো। হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে আমার চর্চিতযুক্ত চিন্তিত মনকে ডাক দিল।

ইংরেজিতে চিকন গলায় হাত ইশারায় বলে, ‘তুমি চলে এসো, ভয় পেয়ো না, ইজি।’ আমি তাকে সাড়া দিলাম এবং ধন্যবাদ দিয়ে মই বাইতে শুরু করলাম।

মেয়েটি বুঝতে পেরেছিল, যেহেতু আমি নাদুসনুদুস, মোটা বুড়ো মানুষ সেহেতু ভয়ে নিচের দিকে পিঠটান দেব। অবশেষে মই অতিক্রম করলাম। পাথরের ওপর পা রেখে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। ওপরের দিকে উঠছি। চূড়ার নিকটবর্তী এসে গিয়েছি মনে হচ্ছে।

দূরে পাহাড়ের ওপর দিয়ে সড়ক। শত শত গাড়ি ছুটে চলছে। এতটুকু দেখা যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি চললে মনে হয় মোবাইলে গেমস খেলছি।

সিংহের দেহ ডানাওয়ালা এক দানব। দর্শনার্থীদের জন্য দর্শনীয় একটি জায়গা। অভিযান শেষে শরীরে তৈরি হয় একটি আলাদা ফিলিংস। যখন শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম, তখন মনে হচ্ছিল, এ জগতের রাজা আমি। এর আগেও একবার রাজা হয়েছিলাম। আবারও হতে ইচ্ছা জাগবে।

টেবিল মাউন্টেনের কোল ঘেঁষে এ পাহাড়। রাজকীয় দৃশ্য পরিদর্শনের প্রস্তাব দেয় এই লায়ন’স হেড। পূর্ণিমায় এর যে দৃশ্য তৈরি হয়, তা অকল্পনীয়। এর চূড়া হলো প্যারাগ্লাইডিংয়ের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান।

এখন ফিরতে হবে। বেশিক্ষণ থাকা হয়নি সিংহের মাথায়, তবে কিছুক্ষণ ছিলাম। বাই বাই, আবার দেখা হবে।