স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে স্মার্ট হতে হবে

ড্রোন শব্দটির সঙ্গে আমরা এখন সবাই পরিচিত। সবাই জানেন, ড্রোন কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে। কিন্তু ড্রোন সম্পর্কে যদি কিছু নতুন তথ্য জানতে চান, তাহলে আজকের এই লেখা পড়তে পারেন। ড্রোন ট্রাফিকযুক্ত জনবহুল দেশের জন্য কাজে আসতে পারে। তার আগে লেখায় আমি ড্রোন সম্পর্কে একটু আলোচনা করি। ড্রোন হলো একধরনের উড়ন্ত রোবট, যা মানুষের দ্বারা দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ড্রোন তৈরি করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোকে সহজ করা। বর্তমান সময়ে ড্রোন অনেক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে; মূলত ছবি তোলার কাজে ড্রোন ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে শুধু ছবি তোলার কাজেই ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে না, ব্যবহার করা হচ্ছে কোনো পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছানোর কাজে, ব্যবহার করা হচ্ছে সিনেমার শুটিংয়ের কাজে, ব্যবহার হচ্ছে যুদ্ধের কাজে। মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, একটি ড্রোন কীভাবে কাজ করে? সহজ ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে কিছুটা বেতার টেকনোলোজি এবং প্রচুর পদার্থবিদ্যা।

তাহলে চলুন, ড্রোন ওড়ার কৌশল সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। সংযোগ বা কানেকটিভিটি—ড্রোন দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্মার্টফোন ও ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়। আর এই ড্রোন ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটের সঙ্গে সংযোগ থাকে। এই ওয়্যারলেস কানেকটিভিটির সাহায্যেই ড্রোনের পাইলট, পাখির চোখের মতো ড্রোন এবং এর চারপাশের এলাকার ওপর নজর রাখতে পারেন। কিছু অ্যাপের সাহায্যে ড্রোনের উড্ডয়নের পথও সেট করে দেওয়া যায়, যার ফলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্বপরিকল্পিত পথে উড়ে যায়। এ জন্য প্রয়োজন হয় জিপিএসের। ওয়্যারলেস কানেকটিভিটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, রিয়েল টাইম ব্যাটারি চার্জ ট্র্যাকিং। কারণ, ওজন কমানোর জন্য ড্রোনগুলোয় ছোট ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। কিছু ড্রোনের ইন্টারনাল ক্যামেরা আছে, যা এর পাইলটকে ড্রোনটি কোনো দিক দিয়ে উড়ছে, তা দেখার জন্য সুযোগ দেয়। সেই সঙ্গে ড্রোনের ওপর লাগানো ক্যামেরার সাহায্যে মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোয় খুব সহজেই পৌঁছানো যায়। সেই কারণে প্রতিকূল পরিবেশে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে ড্রোন বেশি ব্যবহার করা হয়। ড্রোন অনেকটাই ছোট, মজবুত ও সাধারণ যানবাহনের তুলনায় বেশি উচ্চস্তরে উড়তে সক্ষম, যা এদের সহজেই জটিল রুটে চলাচল করতে সাহায্য করে এবং কোনো রকমের কোনো ট্রাফিক জ্যামে না আটকে দ্রুত লোকেশনে পৌঁছতে পারে।

যন্ত্রটি এমন এক যন্ত্র, যেটিতে মানুষকে বাহক হিসেবে চড়তে হয় না, ড্রোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে। ড্রোনগুলো বিভিন্ন ধরনের এবং আকারের হয়ে থাকে। তবে এর সব কটি মডেলই কমবেশি হালকা, দ্রুত উড়তে সক্ষম ও সহজেই বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যেকোনো প্রয়োজনে হেলিকপ্টার বা সাধারণ বাহন যা খরচ নেবে, ড্রোন তার থেকে অনেক কম খরচের মধ্যেই আপনাকে উন্নত মানের পরিষেবা দিতে পারে।

কম্পিউটার দ্বারা সম্পূর্ণভাবে পরিচালিত হওয়ায় ড্রোনগুলো সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে কাজ করতে সক্ষম।

এখানে কোনো ধরনের ত্রুটির আশঙ্কা খুবই অল্প। এবার আপনার মনে প্রশ্ন হতে পারে, একটি ড্রোন আসলে কীভাবে ওড়ে? আসলে সহজ, তারবিহীন প্রযুক্তি আর পদার্থবিদ্যার সংযুক্ত প্রয়াসে কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়াই একটা ড্রোন আকাশে উড়তে পারে। ড্রোনকে মানবযুগের সবচেয়ে সফল উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে মনে করা হয়, যার মাধ্যমে খুব সহজে, দ্রুত গতিতে এবং কোনো ধরনের জীবনের ঝুঁকি ছাড়াই অনেক কঠিন কাজ করা যায়।

ড্রোন প্রথম কে আবিষ্কার করেছেন, এ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, ১৯১৫ সালে মহান বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা প্রথম ড্রোন আবিষ্কার করেন। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ড্রোনকে প্রথমবারের মতো কোনো মানুষকে লক্ষ্য করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ, আফগানিস্তানের পাটকিয়া প্রদেশে, ওসামা বিন লাদেনকে লক্ষ্য করার জন্য একটি ড্রোন ব্যবহার করে। যদিও ওসামা বিন লাদেন সেখানে ছিলেন না। এ সময় ইরান ও ইসরায়েলেও সামরিক ও স্পাই ড্রোন তৈরি করা হয়।

২০০৬ সালে ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটি প্রথমবারের মতো ইউএস সিভিলিয়ান এয়ারস্পেসে ড্রোন উড়ানোর জন্য অনুমতি দেয়। যার ফলে সাধারণ জনগণ ড্রোন উড়ানোর অনুমতি পায়।

২০০৯ সালে, ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে।

যেখানে অন্য মানুষের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ড্রোন উড়ানোকে বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়, যা ড্রোনের বাণিজ্যিকীকরণের ফলে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

মার্কেটপ্লেসে অন্যতম সেরা ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডিজেআই, ২০১৬ সালে স্মার্ট কম্পিউটার ভিশন এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তিসম্পন্ন ড্রোন বাজারে নিয়ে আসে। এই ড্রোন, বাধা এড়ানো এবং জিপিএস সিগন্যাল অনুসরণ করার পাশাপাশি মানুষ বা বস্তুকে ট্র্যাক করতে পারত।

সাধারণত আমাদের চোখের মধ্যে যে ড্রোনগুলো পড়ে, তা মূলত আকারে অনেকটাই ছোট এবং বাচ্চাদের খেলনা হিসেবেই প্রকাশ পায়। তবে খেলনাতেই কি এর ব্যবহার শেষ? না, মোটেও নয়। এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এটির ব্যবহারের পরিসরও বৃহৎ। বিমানের সাইজের ড্রোন মূলত দূরবর্তী জায়গা থেকে ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর এর ব্যবহার প্রকট হয় ঠিক তখনই, যখন কোনো একটা দুর্যোগপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদে নিয়ে আসতে প্রয়োজন হয়। এর মাধ্যমে কোনো পাইলটের জীবনকে আশঙ্কায় না ফেলেই মানুষকে উদ্ধার করা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি যে ক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহৃত হয় সেটি হলো সামরিক ক্ষেত্র।

আর ছোট্ট ড্রোনগুলো খেলনার পাশাপাশি শোভা পায় বিভিন্ন আলোকচিত্রীর কাছে। এর মাধ্যমে তাঁরা ওপর থেকে ছবি তুলতে পারেন। এভাবেই মানুষের নানামুখী চাহিদাকে একাই ভিন্নরূপে পূরণ করে যাচ্ছে ড্রোন, যার শত শত উদাহরণ আমাদের সামনেই। আমি যে বিষয়ে উল্লেখ করব, সেটা হবে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তার কিছু বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো যেতে পারে ড্রোন টেকনোলজির মাধ্যমে। একটি উদাহরণ দিলে হুড়হুড় করে অনেক সমস্যার সমাধান করা যে সম্ভব, সেটাও পরিষ্কার হবে। ধরুন, বাসায় কারও হঠাৎ স্ট্রোক করেছে। অ্যাম্বুলেন্সের দরকার। ঢাকা শহরে যে ট্রাফিক জ্যাম, শতচেষ্টা করেও দ্রুত সময়ে অ্যাম্বুলেন্স রোগীর কাছে আসতে পারে এবং দেরির কারণে রোগীর বড় ক্ষতি বা মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। অ্যাম্বুলেন্স আসা মানেই রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু জরুরি সেবা পেয়ে থাকে, যেমন অ্যান্টিপ্লেটলেট ওষুধ, বিটা ব্লকার, রক্তের চর্বি কমায়, এসই ইনহিবিটর্স, অস্থির এনজাইনা পেক্টোরিসের চিকিৎসা ইত্যাদি। এ ধরনের প্রাথমিক চিকিৎসা রোগীকে দিয়ে হাসপাতালে রোগী পৌঁছালে চিকিৎসক পরবর্তী ধাপগুলো নিতে পারেন, এতে মৃত্যুঝুঁকি বা পঙ্গুত্ব থেকে রোগীকে রক্ষা করা সম্ভব। তাহলে কীভাবে চিকিৎসকদের দ্রুততার সঙ্গে রোগীর কাছে পৌঁছানো সম্ভব? একটি ড্রোন এ কাজ অতি দ্রুততার সঙ্গে করে দিতে পারে। টেকনোলজির অভাব নেই বর্তমান বিশ্বে, অভাব তার ব্যবহার করা শেখা বা স্মার্ট ওয়েতে ভাবতে শেখা। ড্রোনের মতো শত শত প্রযুক্তি রয়েছে হাতের কাছে, যা আমরা নানাভাবে নানা কাজে ব্যবহার করতে পারি। আমি মনে করি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের সৎ–স্মার্ট হতে হবে, তবেই হবে সম্ভব সত্যিকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া। জাগো বাংলাদেশ জাগো।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]