ইসরায়েল-ইরান সংঘাত: অদূরদর্শী পথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
বিশ্ব আবারও দাঁড়িয়ে আছে এক অস্থির ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির কিনারায়। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা, বিশেষ করে ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের পটভূমি এখন নতুন মোড় নিচ্ছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত ধরে। সম্প্রতি তিনি এক বিস্ফোরক বিবৃতিতে ইরানের “নির্বিচারে আত্মসমর্পণ” দাবি করেছেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনায় সম্ভাব্য মার্কিন হামলার। এই পরিস্থিতি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্ব ব্যবস্থাকেই জর্জরিত করে দিতে পারে। এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিকটি হলো—
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে কোনো গণতান্ত্রিক সংলাপ, কংগ্রেসীয় অনুমোদন বা জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।মাত্র ক’সপ্তাহ আগেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলের একতরফা বিমান হামলা সম্পর্কে সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। এমনকি ১৩ জুন ইরানের ওপর ইসরায়েলের ভয়াবহ সামরিক আক্রমণের সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বাসের মাঝেও তিনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি। কিন্তু ইরানের তীব্র ব্যালিস্টিক হামলায় ইসরায়েলের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় তার এই অবস্থান দ্রুত বদলে কূটনীতি থেকে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন হোয়াইট হাউস থেকে শোনা যাচ্ছে আক্রমণাত্মক কূটনীতি, সামরিক হুমকি এবং এমনকি আংশিক গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস—যেমন আয়াতুল্লাহ খামেনেই-এর অবস্থান জানার দাবি। এসব শুধু কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘনই নয়, এটি কার্যত যুদ্ধের সিঁড়িতে পা রাখার সামিল। এই অবস্থানের পেছনে একদিকে রয়েছে ইসরায়েলি বিজয়ের আন্তর্জাতিক প্রচার, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চিরচেনা জনমোহনকারী জাতীয়তাবাদ—যা ঘরোয়া রাজনৈতিক চাপের বিপরীতে সাময়িক শক্তি প্রদর্শনের হাতিয়ার। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রেসিডেন্টকে সেনাপ্রধানের ক্ষমতা দিলেও যুদ্ধ ঘোষণার একক অধিকার দেয়নি। সেটি রয়েছে কংগ্রেসের হাতে। অথচ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কার্যত একক সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি নতুন যুদ্ধের পথে ঠেলে দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেটের উভয় দলের আইনপ্রণেতারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন—এই পথে অগ্রসর হওয়া হলে তা হবে সংবিধানবিরোধী। তাঁরা যুদ্ধ-ক্ষমতা সংক্রান্ত আইন (War Powers Resolution) অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের উপর আইনগত বাধ্যবাধকতা আরোপের দাবি তুলেছেন।প্রশ্ন হলো—কংগ্রেস এই সংকটময় সময়ে আদৌ কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে? অতীতে, ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময়ও দেখা গেছে কংগ্রেসের নীরবতা ও দুর্বলতা। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করে, তার প্রধান ভিত্তি ছিল তিনটি অভিযোগ:
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য দাবি করেছিল যে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক সরকার গোপনে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (WMD)—যেমন রাসায়নিক, জৈবিক ও পারমাণবিক অস্ত্র—তৈরি করছে। দ্বিতীয়ত, বলা হয়েছিল সাদ্দাম হোসেন ও আল কায়েদার মধ্যে গোপন সন্ত্রাসী সম্পর্ক রয়েছে এবং ইরাক সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। তৃতীয়ত, অভিযোগ ছিল ইরাক জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শকদের সহযোগিতা করছে না এবং নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব লঙ্ঘন করছে।কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা যায়—কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি, সাদ্দাম ও আল কায়েদার মধ্যে কোনো কার্যকর সম্পর্ক ছিল না, এবং জাতিসংঘের পরিদর্শকরাও বলেছিলেন ইরাকের পক্ষ থেকে তারা যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছেন। ফলে প্রমাণহীন এই অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধ লাখো মানুষের প্রাণহানি, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর চরম আঘাত হানে। প্রশ্ন থেকে যায়—কংগ্রেস কি এবার সেই ভুল এড়িয়ে যেতে পারবে?ট্রাম্প প্রশাসন যেটি লক্ষ্য করার কথা বলছে, সেটি হলো ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনা—ইরানের একটি পাহাড়ের নিচে সুগভীরভাবে নির্মিত একটি কেন্দ্র, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চলছে। সেখানে হামলা চালালে হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের পরমাণু অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতে পারে। কিন্তু তারপর কী? ইরান প্রতিশোধে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, তেল ট্যাঙ্কার, উপসাগরীয় মিত্র রাষ্ট্র এমনকি সরাসরি ইসরায়েলেও পাল্টা হামলা চালাতে পারে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হবে যদি ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়—যেখান দিয়ে বিশ্বের প্রায় ২০% জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়। এর ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে আমেরিকার নাগরিকদের ওপর।আর যদি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেইকে হত্যার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী শিয়া মুসলিমদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে ইসরায়েলি ও মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের কথা ভুলে গিয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র এবারও মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে তার ফলাফল হবে কয়েক হাজার মার্কিন সেনার মৃত্যু, লাখ লাখ ইরানির প্রাণহানি, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে চরমপন্থার উত্থান, এবং বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি।
আজকের ইরান যুদ্ধের আশঙ্কায় যেন সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। হ্যাঁ, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, কিন্তু ঝুঁকি স্পষ্ট। একটি রাষ্ট্রের যুদ্ধের সিদ্ধান্ত কখনোই একজন ব্যক্তির একক ইচ্ছা হতে পারে না। এটি হওয়া উচিত জাতীয় ঐকমত্যের ফল। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ সিদ্ধান্ত আসা উচিত কংগ্রেসের অনুমোদনের ভিত্তিতে; এবং সেখানে প্রয়োজন সুস্পষ্ট কূটনৈতিক ব্যাখ্যা। এই মুহূর্তে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তাকিয়ে আছে কংগ্রেসের দিকে।আমরা কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি—তারা যেন তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেন, প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করেন, এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় ও আত্মবিধ্বংসী যুদ্ধে জড়ানোর পথ রুদ্ধ করেন।একইসাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য বিশ্বশক্তির উচিত এখনই কার্যকর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা—যাতে সংঘর্ষ এড়ানো যায় এবং শান্তির পথে ফেরা সম্ভব হয়।বিশ্ব ইতিমধ্যেই বহু যুদ্ধ, ধ্বংস ও মৃত্যু দেখেছে। এখনো আলোচনার সুযোগ রয়েছে—তাই যুদ্ধ নয়, শান্তি, সংবিধান ও সম্মিলিত মানবিক বোধের পথেই আমাদের যাত্রা হোক। এই মুহূর্তে আমরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াচ্ছি।