বিদেশে কাজ করে যা শিখলাম
‘সহমর্মিতা’ একটা শক্তিশালী শব্দ। এখনকার মানুষের মধ্যে এ বিষয়ের ভীষণ অভাব আপনি দেখবেন। একটা গল্প বলি, ছোটবেলায় আমি কুকুরকে খুব ভয় পেতাম। গ্রামের পথে একবার এক পাগলা কুকুর আমাকে তাড়া করে।
আমি তো ভয়ে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। দেখি, কলসি কাঁখে মধ্যবয়স্ক এক নারী আমার সামনে এসে প্রথমে চিৎকার দিয়ে বসলেন। কলসটা নামিয়ে পাশে থাকা একটি লাঠি নিয়ে কুকুরটাকে তাড়া দিলেন।
বিষয়টা খুব সামান্য ঘটনা, কিন্তু আমার জীবনে এটির একটি ইমপ্যাক্ট আছে। এখান থেকে যেটা শিখেছি, সেটা হচ্ছে সহমর্মিতা, বিপদে নির্ভয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো কোনো প্রতিদান পাওয়ার আশা ছাড়াই।
এখনকার বিরোধপূর্ণ নেতিবাচক সমাজে কদাচিৎ এ ধরনের দু–চারজনের দেখা মিলবে, যাঁদের সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও সাহায্য করার প্রবণতা বেশ চোখে পড়ার মতো। বেশির ভাগ মানুষ নিজের স্বার্থ হাসিল করতে একটা সামাজিক বলয় তৈরি করে। কিন্তু সব সময় সেটা করা ঠিক নয়। আমরা আমাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কী পাইনি, কী হারিয়েছি আর কোথায় কম পড়েছে, সেটার হিসাব কষতে কষতে কাটিয়ে দিই।
অথচ যাদের হারানোর কিছু নেই, শুধুই বিলিয়ে দিতে জানে, আবার যাদের কিছুই পাওয়া হয়নি, শুধুই আশীর্বাদের হাতটুকু মাথায় রাখতে যানে, তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ না হয়ে একটুখানি নরম দৃষ্টিতে তাকালে ক্ষতি কী! শুধু বিনয়, সহমর্মিতা ও সহানুভূতিশীল হয়েও মন জয় করা সম্ভব, তা সে পরিবারেই হোক, চাকরি বা কাজের ক্ষেত্রে হোক কিংবা রাজনীতিতে।
আমি বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে মিশেছি, কথা বলেছি, তাদের সংস্কৃতি-ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছি। একটা বিষয় গভীরভাবে অনুভব করেছি, আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে সবকিছুতে একটা অজুহাত আর তুলনা করার প্রবণতা আছে। আমরা কিছু করতে ব্যর্থ হলে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে চাই। একটা অজুহাত খুঁজতে থাকি। কিন্তু তুলনামূলকভাবে ভারতীয় ও চীনাদের মধ্যে এ প্রবণতা অনেক কম। এ জন্য দেখবেন, ওরা অনেক কিছুতে থিতু হতে পারে খুব সহজে। কর্মঠ হয়ে লেগে থাকার প্রবৃত্তিটা মজ্জাগত নয়, এটা অনুশীলনের ব্যাপার।
আমাদের সাহস থাকলেও নিয়মিত অনুশীলন নেই বলে দলগত অর্জনের থেকে ব্যক্তিগত অর্জনটা বেশি, যার ফলে একেকজনের ব্যক্তিত্বের পার্থক্য অনেক বেশি। দলগত বা সামষ্টিক দেশাত্মবোধ, কর্মপ্রিয়তা, স্পিরিট কম। বাস্তবতা থেকে আবেগের বেশি প্রাধান্য দিই।
মিসরীয়, কানাডীয়, জাপানিজ, আমেরিকান, ইন্দোনেশিয়ান, জার্মান—এ রকম বহুজাতিক প্রকৌশলীদের সঙ্গে আমার কাজ করার বা কথা বলার সুযোগ হয়েছে। ওদের সঙ্গে আমাদের যে পার্থক্যগুলো লক্ষ করেছি, মোটাদাগে কথা বলার ধরন, বিনয়, সহমর্মিতা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষায়, পেশাদারির কথা বাদই দিলাম। এই চর্চাগুলো পরিবার কিংবা প্রতিষ্ঠানে আমরা যে করি না তা নয়, কিন্তু উল্লেখ করার মতো নয়, তা আমি বলতেই পারি।
এ জন্য নিজের অজান্তেই আমরা অনেক কিছুতে পিছিয়ে পড়তে থাকি। আমরা মিথ্যা বলা শিখি, প্রতারণা করতে শিখি, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষাটা জানি না। সাহসিকতার সঙ্গে সঙ্গে সহমর্মিতা, সহনশীলতা ও সহযোগিতা করার প্রত্যয়ই হোক এ প্রজন্মের মূল হাতিয়ার।
লেখক: টমাস রায়, সিনিয়র সফটওয়্যার প্রকৌশলী, কানাডা