তরুণ প্রজন্মের সংকট: ডিপ্রেশন, মোবাইল, ক্যাসিনো ও বেকারত্বের করাল ছায়া
বিশ্ব আজ এক জটিল সংকটের সম্মুখীন, যেখানে তরুণ প্রজন্ম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জের কবলে পড়ে দিশাহীন হয়ে পড়ছে। যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি, মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তির অপব্যবহার তরুণদের হতাশা, অবসাদ ও আত্মহননের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তরুণদের সংকটের কারণ বিশ্লেষণ ও কার্যকর সমাধানের পথ খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবি।
যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ
তরুণদের ভবিষ্যৎ সংকটে বিশ্বজুড়ে চলমান যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের ঘটনা তরুণদের মানসিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ সংকট তরুণদের বেকারত্ব, অর্থনৈতিক চাপ ও হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের অস্থিতিশীলতা তরুণদের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে। ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত, মধ্যপ্রাচ্যের গৃহযুদ্ধ ও বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের উত্থান কেবল বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নয়, তরুণদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতাতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
যুদ্ধের প্রভাব: ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত ও মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত ও মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে তুলছে। এর ফলে খাদ্য ও জ্বালানির সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের মজুত কমে যায়, যার প্রভাব পড়ে বিশেষত দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর। তরুণদের অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় জর্জরিত।
এ ছাড়া যুদ্ধের কারণে সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিক্ষা ও মানব উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে। এতে তরুণদের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাঁদের মধ্যে হতাশা ও সহিংসতার প্রবণতা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ও ভারতের মতো দেশগুলো সামরিক খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে পিছিয়ে রয়েছে।
অন্যদিকে নরওয়ে ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো সামরিক খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এই মডেল অনুসরণ করে অন্য দেশগুলোকেও মানব উন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। তরুণদের সঠিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক সহায়তা দেওয়া হলে তাঁরা আরও আত্মবিশ্বাসী ও উদ্ভাবনী হয়ে উঠতে পারবেন।
অতএব রাষ্ট্রগুলোর উচিত সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে মানব উন্নয়ন ও সামাজিক কল্যাণের জন্য আরও বেশি বরাদ্দ নিশ্চিত করা। এতে তরুণ সমাজের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের মতো সংকট মোকাবিলায় দৃঢ় অবস্থানে দাঁড় করাবে।
অন্যদিকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের হুমকি তরুণদের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তরুণদের আদর্শিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামিক স্টেট (আইএস) প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে তরুণদের নেতিবাচক চিন্তা ও সহিংসতার পথে পরিচালিত করে।
এই সংকট মোকাবিলায় প্রতিটি রাষ্ট্রের উচিত তরুণদের মধ্যে শান্তি ও সহনশীলতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, যেমন সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে ধর্মীয় সহনশীলতা বাড়াতে সরকার ও সমাজ মিলিতভাবে কাজ করেছে। এটি একটি কার্যকর দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ অবস্থায় প্রতিটি রাষ্ট্রের উচিত তরুণদের জন্য নিরাপদ ও সৃজনশীল পরিবেশ নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সন্ত্রাসবাদ: প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর একটি বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে তরুণদের সহজেই প্রভাবিত করা সম্ভব। তাই এ সমস্যার সমাধানে প্রতিটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি ও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানে শিক্ষামূলক ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে ভুয়া খবরের বিস্তার সমাজে বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তরুণদের মধ্যে অনেকেই একপক্ষীয় বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশার হার বাড়িয়ে তুলছে। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে অন্যদের জীবনের সেরা মুহূর্ত দেখে অনেকেই নিজের জীবনের সঙ্গে তুলনা করে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
রাষ্ট্রের ভূমিকা: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও তথ্য নিয়ন্ত্রণ
ডিজিটাল মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন দেশ নানা নীতিমালা তৈরি করছে। তবে এসব নীতিমালার কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো এমন নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার রোধ করবে, তবে একই সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা বজায় রাখবে।
ডিজিটাল স্পেসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহের অধিকার মৌলিক মানবাধিকার। এই দিক নিশ্চিত করেই রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স ও জার্মানি ফেক নিউজ ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছে। এসব আইনের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়ানোর বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে কখনো কখনো এই পদক্ষেপগুলো ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে মনে হতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা তৈরি করা জরুরি, যা সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে এবং নেতিবাচক প্রভাব রোধ করবে।
মাদকাসক্তি ও ক্যাসিনো–কালচার একটি সামাজিক বিপর্যয়
মাদকাসক্তি ও ক্যাসিনো–কালচার আধুনিক সমাজে তরুণ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু ব্যক্তির জীবনকে ধ্বংস করছে না; বরং পুরো সমাজকেই অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সমস্যাগুলো তরুণদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে এবং তাদের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
মাদকাসক্তির প্রবণতা তরুণ সমাজে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন ও অন্যান্য ড্রাগস সহজলভ্য হওয়ায় তরুণদের মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। বাংলাদেশে মাদক ব্যবসা বৈধ ও অবৈধভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
মাদকাসক্তির কারণে পরিবারে অশান্তি, সামাজিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষত নিম্ন আয়ের পরিবারে মাদকাসক্তি বেশি দেখা যায়, যেখানে আর্থিক চাপ তরুণদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। মাদকাসক্ত সদস্যদের কারণে পরিবারগুলোর আর্থিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, যেসব দেশে মাদক সহজলভ্য, সেসব স্থানে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, শারীরিক বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাদকাসক্তির ফলে তরুণদের সৃজনশীলতা ও উদ্যম হ্রাস পায়, তারা জীবনের উদ্দেশ্য হারায় এবং শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই প্রবণতা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
ক্যাসিনো–কালচার এখন সামাজিক ব্যাধির এক চূড়ান্ত রূপ
ক্যাসিনো–কালচার বর্তমানে সমাজের অন্যতম বড় সমস্যাগুলোর একটি। এটি ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক ক্ষতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ সমাজ বড়লোক হওয়ার অবাস্তব স্বপ্নে মত্ত হয়ে ক্যাসিনো ও গেমিং অ্যাপসের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে মজার জন্য শুরু হলেও এটি দ্রুত আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে, যা তাঁদের আর্থিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তরুণেরা ক্যাসিনো খেলার মাধ্যমে সহজে লাভের আশায় সঞ্চিত অর্থ নষ্ট করছেন এবং ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। এর ফলে তাঁদের পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ছে এবং পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। বাংলাদেশের মতো দেশে তরুণদের মধ্যে এই অসুস্থ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাসিনো ও গেমিং অ্যাপসের প্রতি আসক্তি তরুণদের মানসিক ও সামাজিক জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যাঁরা এই আসক্তিতে পড়েন, তাঁরা সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং মানসিক চাপ, হতাশা ও উদ্বেগের শিকার হন। তাঁদের জীবনের মানও দ্রুত কমে যায়, যার ফলে তাঁরা ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সফল হতে ব্যর্থ হন।
বিশ্বের অনেক দেশ মাদকাসক্তি ও ক্যাসিনো–কালচার নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। তবে বাংলাদেশে কার্যকর আইন ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের অভাব লক্ষ করা যায়। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে এই চক্রগুলো সক্রিয় থেকে যাচ্ছে।
সিঙ্গাপুর ও নরওয়ের মতো দেশগুলো মাদক ও জুয়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ করেছে। এসব দেশে শুধু শাস্তি নয়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজে তাঁদের পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্যও এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, মাদক ও ক্যাসিনোর সহজলভ্যতা বন্ধ করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত তরুণদের পুনর্বাসনে গুরুত্ব দিতে হবে।
তরুণদের বেকারত্ব ও হতাশা: বর্তমান সংকটের মূল কারণ ও ফলাফল
তরুণদের বেকারত্ব ও হতাশা বিশ্বজুড়ে একটি বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে চাকরির ধরন বদলে যাচ্ছে। অনেক তরুণ প্রচলিত শিক্ষা ও দক্ষতা নিয়ে বর্তমান চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না। প্রযুক্তিগত বিপ্লব, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস ও অটোমেশনের প্রসার নতুন ধরনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে একই সঙ্গে এটি অনেক প্রচলিত চাকরির ক্ষেত্র সংকুচিত করেছে। স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালনা, রোবোটিক উৎপাদন ও অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকসেবার মতো ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার হাজার হাজার শ্রমিকের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে।
বেকার তরুণেরা হতাশায় ভুগছেন, যা মানসিক চাপ, অবসাদ ও অপরাধের প্রবণতা বাড়িয়ে তুলছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্বের কারণে অনেক তরুণ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চ্যালেঞ্জ
প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণে অনেক তরুণ বেকার হয়ে পড়ছেন। তাঁরা এখনো প্রচলিত চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন, অথচ সেসব কাজ আগের মতো সহজলভ্য নয়। প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে বাজারে এমন চাকরির চাহিদা তৈরি হয়েছে, যা প্রচলিত শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি তরুণদের মধ্যে ‘তৃতীয় শ্রেণির শ্রমিক’ হয়ে পড়ার অনুভূতি তৈরি করছে। এর ফলে তাঁরা ভবিষ্যৎ নিয়ে একধরনের হতাশা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
সমস্যার শিকড়: শিক্ষাব্যবস্থা ও দক্ষতা উন্নয়নের ঘাটতি
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে সংযোগের অভাব তরুণদের এই সমস্যার মূল কারণ। শিক্ষাব্যবস্থা বাজারের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে খাপ খায় না। প্রচলিত শিক্ষার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হলেও ডিজিটাল দক্ষতা, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতার উন্নয়ন অবহেলিত।
এ ছাড়া দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের সীমাবদ্ধতা তরুণদের কর্মসংস্থানের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তাঁরা শিক্ষাজীবন শেষ করেও কর্মক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হন। এই পরিস্থিতি তরুণদের মধ্যে হতাশা তৈরি করছে, যা তাঁদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বেকারত্ব ও হতাশা থেকে অনেক তরুণ বিপথে চলে যাচ্ছেন—মাদকাসক্তি, অবৈধ কার্যক্রম অথবা স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জনের দিকে ঝুঁকছেন। এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতের প্রতি অনাস্থা তরুণদের মধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি বিদ্বেষ তৈরি করছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে বড় ধরনের সামাজিক বিভাজনের কারণ হতে পারে। সমস্যার শিকড় নিরসনে একটি সমন্বিত, কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যেমন—
১. মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দক্ষতা উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণদের দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করলে তাঁরা বৈশ্বিক কর্মবাজারে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হবে।
২. প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে গিয়ে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ও পেশাদার প্রশিক্ষণ চালু করা প্রয়োজন। জার্মানির মতো দেশগুলো দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় সাফল্য অর্জন করেছে, যা বাংলাদেশেও অনুসরণ করা যেতে পারে। তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাব বাড়াতে সহজ ঋণ প্রদান ও স্টার্টআপ ফান্ডিংয়ের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের স্টার্টআপ ইন্ডিয়া প্রকল্প একটি সফল উদাহরণ হতে পারে, যা তরুণ উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন ও নতুন উদ্যোগ শুরু করতে প্রণোদনা দিয়েছে।
৩. তরুণদের বেকারত্ব ও হতাশা মোকাবিলায় একটি কার্যকর কৌশল প্রয়োজন, যা শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্ভব। তরুণদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে তাঁরা সৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে পারে।
৪. দুর্নীতি রাষ্ট্রের অগ্রগতির প্রধান প্রতিবন্ধক। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর প্রয়োগ, সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশন ও স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক সংস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি দমন প্রয়োজন।
৫. সমাজে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্বশীল করতে সামাজিক আন্দোলন, স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রোগ্রাম প্রয়োজন। পরিবারগুলোর সক্রিয় ভূমিকা তরুণদের নৈতিক শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
৬. যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ তরুণদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। সংঘাতমুক্ত সমাজ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উগ্রপন্থা রোধে শিক্ষামূলক প্রচারণা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি জরুরি।
পরিশেষে
বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে তরুণদের বেকারত্ব, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা ও হতাশা মোকাবিলায় রাষ্ট্রের নীতি ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা কমাতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করা উচিত। পরিবারকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করতে ও সরকারি উদ্যোগে বিনা মূল্যে সেবা প্রদান করা প্রয়োজন।
উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা তরুণদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। সহজ ঋণ–সুবিধা, প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম ও স্টার্টআপ ফান্ড গঠন, যেমন ভারতের স্টার্টআপ ইন্ডিয়া ও জার্মানির ভোকেশনাল শিক্ষা মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। তরুণদের সৃজনশীল কার্যক্রম, খেলাধুলা ও সামাজিক উদ্যোগে সম্পৃক্ত করে তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো জরুরি। পাঠ্যক্রম সংস্কার ও অভিভাবকদের সহায়তার মাধ্যমে তাঁদের উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
বেকারত্ব, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা ও উদ্যোক্তা সংস্কৃতি বিকাশের মাধ্যমে তরুণদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে একটি শক্তিশালী, দক্ষ ও সহানুভূতিশীল ব্যবস্থার ওপর। বাংলাদেশে এসব উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে তরুণেরা তাঁদের প্রতিভা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে একটি শক্তিশালী, সৃজনশীল ও আত্মনির্ভরশীল সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারবেন।
*লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক, সুইডেন