রাত পোহালেই ঈদ: যুদ্ধের মধ্যে ঈদ উদ্যাপন ও মানবিক সহায়তার অনন্য গল্প
ঈদ শুধু একটি উৎসব নয়, এটি এক অনুভূতি—আনন্দ, ভালোবাসা এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতির প্রতীক। তবে যখন পুরো বিশ্বে যুদ্ধ চলছে, মানুষের জীবন কঠিন সংগ্রামে কাটছে, তখন ঈদের আনন্দ কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে? এমন এক সময়ে, যখন অনেকেই একমুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম করছে, তখন কীভাবে ঈদ উদ্যাপিত হবে? কিন্তু যদি আমরা আমাদের মানবিকতা দেখাই, যদি আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়াই, তবে ঈদ শুধু খাবার আর পোশাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং তা মানবতার জয় এবং আমাদের ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠবে।
আমার ছোটবেলার ঈদ ছিল খুবই সাদাসিধে। বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে ঈদের দিনটি ছিল আনন্দের একটি নিরবচ্ছিন্ন উৎসব। প্রবাসে থেকেও ঈদের দিনটি ছিল একান্তভাবে পরিবারের সঙ্গে কাটানো একটি আবেগঘন মুহূর্ত। তবে এবারের রমজান মাসটি ছিল একটু ভিন্ন—বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ চলছে, মানুষের জীবনে অস্থিরতা ও দুঃখের ছাপ পড়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে, আমাদের কি ঈদ উদ্যাপন করা উচিত? আমাদের চারপাশে অসংখ্য মানুষের কষ্টের গল্প, সংগ্রামের মধ্যে ঈদের আনন্দ কীভাবে সম্ভব?
ঈদ হবে সেই সময়, যখন আমরা একে অপরকে সাহায্য করব, ভালোবাসা দেখাব এবং মানবতার পথে চলব। আসুন, ঈদের এই মুহূর্তে আমরা সবাই মিলে নিজেদের কর্তব্য পালন করি
রমজানের শুরুতেই ফেসবুকে একটি পোস্ট চোখে পড়ল, যা আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলল। সেখানে লেখা ছিল, ‘অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকছে হার্ট ছিদ্র মেহজাবিন!’ মেহজাবিনের জীবন ছিল এক অন্ধকার পথে হেঁটে চলা। জন্ম থেকেই তার হার্টে দুটি ছিদ্র ছিল, যা ভেন্ট্রিকুলার সেপটাল ডিফেক্ট নামে পরিচিত। ছোট্ট মেহজাবিনের জীবনের শুরুতেই ঘটে যায় এক অদম্য যুদ্ধ। তার বাবা-মা, যারা একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন, তাঁদের একমাত্র আয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তবে মেহজাবিনের চিকিৎসার জন্য যে বিশাল অর্থের প্রয়োজন ছিল, তা তাঁদের জন্য ছিল এক অসীম দূরত্ব।
মেহজাবিনের বাবা-মা প্রায় তিন বছর ধরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন, কিন্তু অর্থের অভাবে তার হার্টের অপারেশন করা সম্ভব হয়নি। অনেক দিন ধরে চিকিৎসার পর একটি ছিদ্র সেরে গেলেও, আরেকটি ছিদ্র বন্ধ করা সম্ভব হয়নি এবং তা জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না—তাঁরা পুরো পৃথিবীকে একে অপরের সহায়তার জন্য ডাকছিলেন। এরই মধ্যে আমার এলাকার এক ছোট ভাই, শাহজাহান মিয়া, সে সব সময় আমার নানা ধরনের মানবিক কাজে সহযোগিতা করে থাকে। সে একজন মানবিক কর্মী, ফেসবুকে পোস্টটি শেয়ার করেছিল, যা আমার মনকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিল।
তখনই আমি অনুভব করলাম, প্রতিবছরের মতো এ ঈদেও যদি আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু করতে পারি, তবে এই অসহায় পরিবারকে সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য হবে। আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমি দ্রুত ফোন করলাম আমার বন্ধু—ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুলকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আরেক বন্ধু, মানবিক চিকিৎসক অধ্যাপক আবদুল্লাহ শাহরিয়ার (জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকার পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট) আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর সহায়তায় মূলত মেহজাবিনের চিকিৎসা শুরু হলো।
এভাবেই আমরা তিন বন্ধু—শাহরিয়ার, নাজমুল এবং আমি—আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের সহযোগিতার মাধ্যমে মেহজাবিনের অপারেশন সফল করতে সক্ষম হলাম। সে এখন সুস্থ। ঈদের ঠিক আগেই আমাদের হৃদয়ে এক অদ্ভুত আনন্দ সৃষ্টি হলো, যা আসল ঈদ উদ্যাপনের অনুপম এক উদাহরণ হয়ে উঠল। এ অনুভূতি ছিল কেবল আনন্দের নয়, বরং এটি মানবতার জয় ছিল। ঈদের প্রকৃত আনন্দ তখনই আসে, যখন আমরা একে অপরকে সহায়তা করি এবং মানবিকতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে সমাজের কল্যাণে অংশ নিই।
আমার পরিবার, শাহীন, মান্নান ভাই, আমার সহধর্মিণী এবং জুলফিকারসহ যাঁরা নানা উপায়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, তাঁদের প্রতি আমি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। ঈদের এই শুভ সময় আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের রমজান এবং ঈদ উদ্যাপন করার সুযোগ পেয়েছি এবং এটাই ছিল ঈদের প্রকৃত মানে। যে ঈদ শুধু রোজা, খাবার ও পোশাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং রমজান একে অপরকে সাহায্য করার, ভালোবাসা দেখানোর এবং মানবতার পথে চলার সঠিক শিক্ষা দেয়।
এই রমজান মাস আমাদের জন্য নতুন এক শিক্ষা নিয়ে এসেছে—যখন আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পেরেছি, আমাদের মধ্যে কেবল ঈদের আনন্দই সৃষ্টি হয়নি; বরং একত্রভাবে আমরা পৃথিবীটিকে একটু সুন্দর এবং মানবিক করতে কিছু কাজ করতে পেরেছি। মানবতা কখনো হারিয়ে যায় না, এটা আমাদের সবার জন্য একটি অমূল্য শিক্ষা, যা এবারের ঈদও আমাদের শিখিয়েছে।
যত দিন পৃথিবীতে মানুষ থাকবে, ঈদের প্রকৃত অর্থ কখনো বদলে যাবে না। ঈদ হবে সেই সময়, যখন আমরা একে অপরকে সাহায্য করব, ভালোবাসা দেখাব এবং মানবতার পথে চলব। আসুন, ঈদের এই মুহূর্তে আমরা সবাই মিলে নিজেদের কর্তব্য পালন করি, যাতে প্রকৃত ঈদের আনন্দ আসে এবং এটি শুধু আমাদের পরিবার, বন্ধুদের জন্য নয়; বরং সেই সব অসহায় মানুষের জন্য, যারা আমাদের সহায়তা চেয়েছে। আল্লাহ আমাদের সহায় হন।
*লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]