প্রবাসে ঢাকের বাদ্য
দেশে শরতে দুর্গা দেবীর আগমনী শুরু হয় মহালয়ার মাধ্যমে। তাই বাংলার মাটিতে যেভাবে দুর্গাপূজার গুরুত্ব রয়েছে, ঠিক সেভাবেই মহালয়াও পালিত হয়। এরপর দুর্গাপূজার দিন গোনা। কারণ, মহালয়ার ছয় দিন পর মহাসপ্তমী দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক পূজা। বেলগাছের নিচে দেবী দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের পর আসে মহাসপ্তমী। বোধন মানে দেবীকে ঘুম থেকে জাগানো। শাস্ত্রমতে, আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত দেবদেবীদের ঘুমানোর সময়। ঘুম ভাঙিয়ে দেবীকে মাঝপথে তোলা হয়, তাই অকালবোধন।
‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।’ প্রবাসের জীবনে বেতারে ভোরবেলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ কণ্ঠে চন্ডী পাঠ শোনা যায় না। তবে সেই অভাব অনেকটাই পূরণ করে হালের ইউটিউব। এখনো ইউটিউব ছাড়লেই আকাশবাণীর সেই কিংবদন্তি চণ্ডীপাঠ থেকে শুরু করে মহিষাসুরমর্দ্দিনীর গান বেজে ওঠে। এভাবেই সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়েও দেবী দুর্গা তার আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হয়।
অস্ট্রেলিয়ায় পঞ্জিকা অনুযায়ী যদিও এখানে এখন শরৎকাল নয় তবুও আমাদের মনের মধ্যে বয়ে যায় শরতের আবহ। আমরা কল্পনায় দেখতে পায় শরতের বাংলার মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ। নদীর দুকূল ছেয়ে গেছে সাদা কাশফুলে। আর মন্দিরে মন্দিরে বেজে উঠেছে ঢাক আর কাঁসা। আমরা দৌড়ে চলে যায় প্রতিমা দেখতে। শুভ মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে পূজার সূচনা হয়। এরপর সপ্তাহব্যাপী চলে সেই উৎসব। এই উৎসবে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। তবে ছোটদের আনন্দটা থাকে বেশি।
অস্ট্রেলিয়াতে এখন চলছে বসন্তকাল। নতুন পাতায় এবং ফুলে সেজে উঠেছে গাছগুলো। যেন তারা দেবী দুর্গাকে স্বাগত জানাতেই নিজেদের সাজিয়েছে। বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে হাজির হয়েছেন দেবী দুর্গা তাঁর ভক্তদের আশীর্বাদ করার জন্য। পূজার স্থানগুলোর পাশ দিয়ে গেলেই কানে ভেসে আসে সূক্ষ্ম ঢাক আর কাসার বাদ্য। তখনই আমরা বুঝতে পারি দেবী দুর্গা আমাদের মধ্যে এসে পড়েছেন। অন্তর্জালের পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে দুর্গার আগমনী বার্তা।
বাংলাদেশ এবং কোলকাতায় দুর্গাপূজা এখন রীতিমতো শিল্পচর্চার রূপ নিয়েছে। কত বাহারি সাজের পূজা মণ্ডপ আর কত সুন্দর সুন্দর সাজে হাজির হয়েছেন দেবী দুর্গা সপরিবারে। গত বছর পত্রিকায় দেখলাম টাঙ্গাইলের একটা দুর্গাপূজার ছবি। সেখানকার তাঁতের শাড়িকে বিষয়বস্তু বানিয়ে এবারের দুর্গা প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছিল। পাথরাইলের সেই মণ্ডপে তাঁতের শাড়িতে দুর্গা, লক্ষ্মী কাটছেন সুতা, বুনছেন কার্তিক, বিক্রি করছিল গণেশ।
অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি ভাষাভাষী কমিউনিটিতে দুর্গাপূজার প্রতিমা স্থাপনের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে চলেছে। গতবছর ১৭ জায়গায় দুর্গা পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। এইবার পূজা হচ্ছে ১৮ জায়গায়। ফলে আমরা দেশের মতো বিদেশেও গাড়ি করে এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে প্রতিমা দর্শন করে বেড়িয়েছিলাম। আর প্রাণভরে শুনেছি লম ঢাক এবং কাঁসার বাদ্য। পাশাপাশি উপভোগ করেছিলাম মনোমুগ্ধকর সব সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
পূজা উপলক্ষে প্রায় সবকটি সংগঠনই শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রকাশ করেছিল স্মরণিকা। সেখানে প্রকাশ পেয়েছিল দেশের এবং প্রবাসের বিভিন্ন লেখকের লেখা। পাশাপাশি ছোটদের লেখা এবং আঁকাও প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে করে প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মও নিজেদেরকে পূজার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। এই স্মরণিকাগুলো যেন আমাদেরকে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যখন পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশ করা হতো বিভিন্ন পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা যেটা এখন পর্যন্ত চলে আসছে।
এই প্রবাসেও কিছু বইয়ের দোকান সেই শারদীয় সংখ্যাগুলো সরবরাহ করে থাকে। তাদের কাছ থেকে আগেভাগেই সংগ্রহ করেছিলাম ‘আনন্দমেলা’র শারদীয়সংখ্যা। প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে সকলের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের অবসর নেই বললেই চলে। শারদীয় দুর্গোৎসব যেন আমাদেরকে সেই অবসরটুকু দেয়। আমরা একে অন্যের সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান করি এবং পুনরায় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একে অপরকে বাঁধি।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাপূজা বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। আমরা বছরের পুরোটা সময় অপেক্ষা করে থাকি এই সময়টার। যখন আমরা ধর্ম বর্ণ ভুলে ভ্রাতৃত্বের অপূর্ব মেলবন্ধনে আবদ্ধ হই। শরতের মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ, অবারিত মাঠভর্তি শ্বেতশুভ্র কাশফুল সবই যেন এক পবিত্রতার বার্তা দেয়। ঠিক তখনই মা দুর্গা আসন গ্রহণ করেন। ঢাকের আর কাঁসার তালে দুর্গা মায়ের আনন্দধ্বনি ছড়িয়ে পরে লোকালয়ে। আমরা বুঝতে পারি আনন্দের বার্তা নিয়ে দেবী দুর্গা আমাদের মধ্যে আরও একবার এসেছেন।