সামার এল, পিকনিক হলো
ছোটবেলার পিকনিকের স্মৃতি মনে আছে সবার? শীতে বছরের শেষে কিংবা নতুন বছরের শুরুর সময়টায় ছোটরা মিলে ২০ টাকা কিংবা ৫০ টাকা চাঁদা তুলে বাজার করে আনা হতো। আর প্রতি বাসা থেকে তোলা হতো চাল, ডাল, ডিম, আলু ও পেঁয়াজের মতো উপকরণ। এরপর সবাই মিলে কোনো মাঠে গিয়ে আনাড়ি হাতে যে যার মতো পারে হইহই করে রান্না করা। হঠাৎ বড়দের মতো দায়িত্ব পেয়ে হুমকি দিয়ে কাজ করানোটাও ছিল বিরাট গর্বের। নিজেকেও কেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো! ছোটবেলায় পিকনিক নিয়ে এমন অনেক আনন্দের স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমাদের প্রায় সবার। এখন বড় হয়ে সেই আনন্দ হয়তো কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে সময় আর ব্যস্ততার ভারে, তবে এখনো হারিয়ে যায়নি।
কানাডায় এসে শীতের দিনে নয়; বরং গরমকালে তথা সামার এলে পিকনিকের আয়োজন করতে মন চায়। করতে যেহেতু হবে, তাই জায়গা খোঁজাটা দরকার। বহু খুঁজে শেডসহ একটা জায়গা পাওয়া গেল, নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ। ঝামেলা একটাই, লং উইকেন্ডে পড়েছে, কিন্তু কিছু করার নেই। বন্ধুত্বের টান যেহেতু আছে, তাই সবাই আসবে সেটাই প্রত্যাশা।
সময় পেরিয়েছে ২৭টি বছর। ঠিক ধরেছেন, ১৯৯৮ সালে আমরা এসএসসি (SSC) পাস করেছি। কিন্তু হৃদয়ের বন্ধন কখনোই পুরোনো হয় না, বিশেষ করে যখন সেই বন্ধনের শিকড় শৈশব, যৌবন আর স্বপ্নের দিনে গাঁথা থাকে। পিকনিক নামক মিলনমেলায় ছিল এমনই এক অন্তরঙ্গ, হৃদয়ছোঁয়া অভিজ্ঞতা, যেখানে স্মৃতি, ভালোবাসা আর আশা ভেসে বেড়িয়েছে আবেগের ঢেউয়ে।
আমাদের পিকনিকের দিনটা বেছে নেওয়া অবিশ্বাস্যভাবে মিলে গেছে আমাদের এসএসসিতে রেজাল্ট দেওয়া দিনের সঙ্গে। রেজাল্ট নিয়ে শঙ্কা থাকলেও পিকনিক নিয়ে কোনো শঙ্কা ছিল না। শতাধিক মানুষের উপস্থিতি পিকনিককে দিয়েছে নতুন এক মাত্রা। সবাই যার যার মতো উপভোগ করেছে। ২৭ বছর আগে পাস করা বন্ধুদের মনের বয়স সেই ১৯৯৮ সালেই আটকে আছে, তা কথায় কথায় এমনি বোঝা গেছে।
পিকনিকের আগে এর পেছনের কিছু গল্প বলা দরকার। কয়েকবার করে আমাদের মিটিং হয়েছে। বসা হয়েছে রেস্তোরাঁয় বা বাসায়। সবার সঙ্গে বারংবার কথা হয়েছে। জাহান স্পট খুঁজতে আর বুকিং দিতে সময় দিয়েছে। জাহান ও রানা মিলে সাউন্ড সিস্টেম অর্ডার করেছে। রানা ও সুরুচি ওদের বাসা ছেড়ে দিয়েছে পিকনিকের ডেকোরেশন গোছানোর জন্য। তানজির ও নীতি কয়েকবার করে ওশোয়া থেকে এসেছে আমাদের ডেকোরেশনে সাহায্য করতে। রিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে যাকে যাকে পারে পিকনিকে এনেছে। তন্দ্রা আমাদের হিট আইটেম ‘বাস ও শিক্ষা বোর্ড’ আইডিয়া দিয়েছে আর বানিয়েছে। বাসটা পেয়েছি ডিইউ ফোরামের হিরু ভাইয়ের কাছ থেকে, তাকে কৃতজ্ঞতা। নীতি ও বাকি আমরা ওকে সাহায্য করেছি। তন্ময় ফোন করে সবার সঙ্গে কথা বলে পিকনিকে এনেছে। পুলক ও রুমা শহরের বাইরে ছিল, তাই শেষ দিকে এসে যতটুকু পারে সবদিকেই সাহায্য করেছে। মার্জিয়াও অনেককে ফোন দিয়েছে আর ডেকোরেশনে সাহায্য করেছে।
তারপর এল মাহেন্দ্রক্ষণ, ২ আগস্ট। সিটন পার্কের ৪ নম্বর স্পট পিকনিকের জন্য নির্ধারিত। দুপুর ১২টা থেকে সবার আসার কথা। তাই বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে তন্দ্রা, ঈশিতা, রুমা, পুলক, বখতিয়ার ভাই, জাহান ও আরজু চলে এল গাড়িবোঝাই পিকনিকের জিনিসপত্র নিয়ে। তন্দ্রাকে নিয়ে এসেছে প্রীতি, ওর কথা আলাদা করে বলতেই হয়। বন্ধুত্বের টানে সাড়ে ৫০০ কিমি গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছে ছেলেসহ। গত টিউলিপ ফেস্টিভ্যালে আমাদের পাগলাদের সঙ্গে আড্ডা মেরে মজা পেয়ে গেছে, তাই এবারও চলে এসেছে। ব্যানার টানানো হলো আর পিকনিকের রসদ নামানো হলো। এর মধ্যে চলে এল রানা ও সুরুচি। তাদের গাড়িতেও রাখা জিনিস এল মাঠে। রিনি নিয়ে এল ট্রলি, যা দিয়ে ভারী ভারী সাউন্ডবক্স আনা হলো স্পটে। তন্ময় এল আন্টিকে নিয়ে। ওর হিমু পাঞ্জাবি আলাদাভাবে নজর কাড়ছে সবার। মার্জিয়া এসে দায়িত্ব নিল উপস্থাপনার, ওর সাবলীলতায় সবাই মুগ্ধ।
ধন্যবাদ হাসিবকে, কারণ ও ওর বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে বউ অসুস্থ থাকার পরও। তারপরই এল মাসুদ, লুতফর ও তারিতা। ওরা বেজায় খুশি পিকনিকে এসে, ছবি তোলায় নেমে গেল এসেই। সায়মা ফোন দিল বাচ্চাদের খেলা শুরু হয়েছে কি না তা জানতে, একটু পরে চলে এল। রায়হান জানাল, ওর গাড়ি নষ্ট, তাই বিপুল বিক্রমে বাসে রওনা হয়েছে বউ, বাচ্চাসহ। প্রীতি ও ঈশিতা কফি আর টিম বিটস নিয়ে এল সঙ্গে। আমাদের পিকনিকে আনা সমুচা ও জিলাপি দিয়ে সবাই হালকা পেট পূজো করে নিল। সেই সময় আমাদের সব অনুষ্ঠানের স্পনসর বড় ভাই মহি ভাই ও শারমিন এল তাদের পরিবারসহ; সঙ্গে র্যাফল ড্রয়ের প্রথম পুরস্কার টিভি। টিভি নিয়ে আমাদের ফটোসেশন চলল অনেকক্ষণ। আস্তে আস্তে পিকনিকে জনসমাগম বাড়ছে। মাশিয়াত ও রিমি ভাবি এল দুই মেয়েসহ। এরপর তুহিন ও সাইদা এল দুই বাচ্চাসহ। শান্ত ও তার পরিবার ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে হাজির। দুই বন্ধু মনোয়ার ও কামরুল হাজির প্রায় একই সময়ে। আফসানা এল তার মা ও পরিবার নিয়ে। উম্মে রুমান পরিবার নিয়ে এল আর আমাদের জন্য আনল ঠান্ডা পানীয়। দিদার ও জেসমিন দুই মেয়েকে নিয়ে চলে এল। টরন্টোর ‘ওয়ান অব দ্য হ্যাপেনিং পারসন’ হিশাম চিশতি এল, সঙ্গে সঙ্গে সেলফি তোলা শুরু চারদিক থেকে। রাজিব দুই শিফটে এল, একবার বউ–বাচ্চা নামাতে আর পরেরবার শ্যালিকা, শ্বশুর–শাশুড়ি নামাতে। অমি ও নীপা এসেছে সুদূর অটোয়া থেকে আমাদের সঙ্গে পিকনিকে একটা আনন্দময় দিন কাটাবে বলে। সুমন এল দুপুরের খাবারের শেষে আর আরিফা ও নাশিদ এল বিকেল পাঁচটার দিকে।
আমরা এখানে সবাই ব্যস্ত, তবে সেই ব্যস্ততার মধ্যেও নিজের চাকরি ও পরিবার মেইনটেইন করে সবাইকে একসঙ্গে করার জন্য যে চেষ্টা করছে অ্যাডমিন ও মডারেটররা এবং বন্ধুরা সেই ঘোষণায় যে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে, সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। মহি ভাইকে ধন্যবাদ, আমাদের লটারির প্রথম পুরস্কার স্পনসর করার জন্য। হিরু ভাইকে ধন্যবাদ, আমাদের অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ বাস ফটো স্ট্যান্ডটা শেয়ার করার জন্য। দুলাভাই ও ভাবিদের ধন্যবাদ, আমাদের এই পিকনিকে এসে আনন্দময় করার জন্য। বাচ্চারা নেচেগেয়ে ও গল্প করে সময় ভালোই পার করেছে।
এর মধ্যে দুপুরের খাবার হাজির আর শ খানেক গেস্টের আয়োজন, তথাপি সবকিছু ভালোভাবেই চলেছে। খাবারের স্বাদও ভালো ছিল। সবাই বেশ প্রশংসা করেছে। সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে নিয়েছে আর ভলান্টিয়াররা সবাইকে খাবার তুলে তুলে পরিবেশন করেছে। পোলাও, কাবাব, রোস্ট, ভুনা মাংস, বুটের ডাল, সবজি আর সালাদে এক পরিপূর্ণ আহার। খাবারের পর ছিল ফিরনি, সেকি স্বাদ।
‘দূর পরবাস’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
দুপুরের খাবারের পর শুরু হলো স্মৃতিচারণা পর্ব। মহি ভাই সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন এই আয়োজনে তাকে ডাকার জন্য। হিশাম জানাল তার ভালো লাগার কথা, বন্ধুদের দেখে। মাসুদ ও লুতফর ধন্যবাদ জানাল আয়োজকদের ও পিকনিকে আসা বন্ধুদের। মার্জিয়া তার স্কুলের বান্ধবী রুমানকে ডেকে নিয়ে স্মরণ করল ওদের স্কুলজীবন। এই পর্ব শেষে শুরু হলো বিভিন্ন বয়সী বাচ্চাদের খেলা। ৪ থেকে ৭ বছর বয়সীদের চকলেট দৌড়, ৮ থেকে ১২ বছর বয়সীদের মার্বেল দৌড় আর ১৩ থেকে অন্যদের টার্গেট প্র্যাকটিস। বাচ্চারা অনেক আনন্দ পেয়েছে অংশ নিয়ে আর ভলান্টিয়ার ঈশিতা, প্রীতি, রিনি, তন্দ্রা, সুরুচি আর রুমা রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে ছিল বাচ্চাদের নিয়ে। পুরুষদের পেনাল্টি শুটআউট ছিল রোমাঞ্চকর, একেবারে থ্রিলার মুভি। মেয়েদের ফ্রেন্ডশিপ গেমে দর্শকেরাও সমানতালে মজা পেয়েছে।
পিকনিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল দুটি, একটি হলো বাচ্চাদের যেমন খুশি তেমন সাজো আর কাপল সাজসজ্জা গেমস। এত মজা হয়েছে, সেটা নিয়ে লিখলে দুটি আলাদা গল্প হবে। আরেকটা বিষয়, এখানে তেমন কেউই কাউকে আগে থেকে চিনত না গুটিকয় মানুষ ছাড়া। কিন্তু সবার সঙ্গে আন্তরিক আলাপ করে মনে হয় না যে অচেনা। খুবই ভালো লেগেছে সবার কথা শুনে আর পরিচয় হয়ে। আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে সবাই ব্যস্ত ছিল একে অপরের স্কুল বা কলেজের নাম বা গল্প নিয়ে কিংবা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন ইত্যাদি নিয়ে। দুই দুলাভাই মাইক নিয়ে এই আন্তরিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছে। জাহানের সৌজন্যে রেজিস্ট্রেশন করা সবাই পেল একটি করে আকর্ষণীয় পোলো টি–শার্ট।
সব মিলিয়ে দিনটি আমাদের অনেক ভালো কেটেছে। অনেকে তো বলেছে, দিনটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হলো কেন। বিকেলে রুমা ও মামুন দুলাভাইয়ের বদৌলতে পেয়ে গেলাম চা, তরমুজ ও ঝালমুড়ি। ডিউটি শেষ করে তানজির তরমুজ ও চানাচুর নিয়ে এসেছিল। পিকনিকে এল সুমন ভাবিকে কাজে ড্রপ করে। আফজাল এল, আর এসেই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেল। সবার শেষে এল আরিফা, নাশিদ ও দুলাভাই। দুপুরের খাবার ছিল, তাই পরিতৃপ্তি নিয়ে আহার সারল অন্য সবাই। আগস্ট মাসে যাদের জন্মদিন, তাদের নিয়ে বিশাল কেক কাটা হলো মহাসমারোহে।
বাকি রইল আকর্ষণীয় র্যাফল ড্রয়ের। এর আগে আমরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মর্মান্তিক ঘটনার জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করি। আবার ধন্যবাদ অ্যাডমিন ও মডারেটরকে, যারা দ্বিতীয় থেকে সপ্তম পুরস্কার স্পনসর করেছে। পুরস্কার লোভনীয় ছিল। রিনি, প্রীতি ও সুচীর পরিশ্রমে টিকিট সোল্ড আউট ছিল। সবাইকে তাক লাগিয়ে প্রথম পুরস্কার ৫০ ইঞ্চি টিভি পেয়ে গেল লুতফর। সবাই মিলে পুরস্কার তুলে দেওয়া হলো। এভাবেই শেষ হলো একটা অসাধারণ দিনের। পিকনিকে আসা সবাই আস্তে আস্তে বিদায় নিতে থাকল। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে আয়োজকেরা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানে। আয়োজকেরা যখন সব গোছগাছ শেষ করে বাসায় ফিরছে, তখন প্রবল উত্তাপ দেওয়া সুয্যি মামাও অস্ত যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে।