লালমিয়ার দ্বিতীয় বিয়ে—শেষ পর্ব
শেয়ারের দাম বাড়ছে আর সব বিনিয়োগকারীদের হাসির চোয়াল প্রশস্ত হচ্ছে। এই হাসি কত দিন থাকে, সেটাই দেখার অপেক্ষায়। এই পরিবেশে লালমিয়ার খুশি দ্বিগুণ। বিয়ে আর শেয়ারের দাম। সে এখন প্রায়ই দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। প্রতিদিন হবু বধূর গল্প করে সবার কাছে। সে এক অনাবিল আনন্দ। তবে এ আনন্দ লালমিয়ার বিয়ের পর কত দিন পর্যন্ত থাকবে, তা নির্ভর করছে ছেলেসন্তান জন্মের ওপর। আমার এখন লালমিয়াকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। আজকাল লালমিয়ার সঙ্গে দেখাও হয় কম। এ সময় শেয়ারবাজারের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে সবাই ব্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে আমি খুবই চিন্তিত। শেয়ারবাজারের এমন পরিস্থিতি আগেও হয়েছিল। ঝড়ের সময় সাগরের যে উন্মাদনা, এখন বিনিয়োগকারীদের সেই উত্তেজনা। ঝড় থেমে গেলে সাগরের থাবা যেমন আশপাশের সবাইকে সর্বস্বান্ত করে নিজেও শান্ত হয়, ঠিক তেমনই শেয়ারবাজারে ধস নেমে সবাইকে সর্বস্বান্ত করবে। তারপর বাজার শান্ত। টাকার লোভে সবাই ফটকা বাজারের ওপর নির্ভরশীল। এর আগেরবার কোনো এক বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে পাগলপ্রায়। তার আরও বড় দুঃখ ছিল, সে তো সর্বস্ব হারিয়েছেই তার পরামর্শে আরও অনেক লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার মধ্যে তার বাড়িওয়ালাও আছে। দুঃখ করে বলেছিল, ‘ভাই আমি আগে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, আমার পরামর্শে সেই বাড়িওয়ালা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেছিল, এখন সে–ও ভাড়া বাড়িতে থাকে।’
শেয়ারবাজারে আবারও ধস নামল। লোকের ভিড়ে হাঁটার উপায় নেই। সাধারণ জনগণ উত্তেজিত হয়ে ভাঙচুর করছে। দেশের জনগণের একটা সমস্যা হচ্ছে ভাঙচুর। এই ভাঙচুরের আওতায় বেশি পড়ে যানবাহন। হানিফ সংকেতের কোনো এক ইত্যাদির পর্বে সে তা উল্লেখ করেছিল। দেশে কিছু হলেই সবার আক্রোশ গিয়ে পড়ে গাড়ির ওপর। গাড়ি ভাঙার উন্মাদনায় সবাই মেতে ওঠে। যেন সব গাড়িই সরকারি। কয়েক দিন পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে ফাঁকা। জনমানবের চিহ্ন নেই। এমন সুন্দর সুনসান পরিবেশ আমার খুব ভালো লাগল। অফিসে দেখলাম, সবাই বিষণ্ন মনে বসে আছে। আমি সবাইকে নিয়ে বসলাম পরিস্থিতি বোঝার জন্য। বললাম, আমি তো অনেক আগেই আপনাদের সাবধান করে দিয়েছিলাম যে এখন শেয়ার না কিনে যা আছে সব বিক্রি করে টাকা নিয়ে বসে থাকেন, তা করেননি। সে যাহোক, প্রকৃতপক্ষে কি আপনাদের লোকসান হয়েছে? আমি বলব না। আপনারা যত লাভ আশা করেছিলেন, তা পাননি। আর এ জন্য মন খারাপ না করে নতুন পরিকল্পনা করুন।
ভেবেছিলাম শেয়ারবাজারের দরপতনের কারণে লালমিয়া বিবাহের ইচ্ছা স্থগিত রেখেছে। সে একদিন বিষণ্ন মনে অফিসে এসে হাজির। আমি শেয়ারের লাভ-ক্ষতির কথা ভেবে বললাম, আপনার কী অবস্থা? সে মনে হয় বুঝল বিয়ে। লাজুক হেসে বলল, ‘আর কইয়েন না, যে মাইয়াডারে দেখছিলাম খুব পছন্দ হইছিল, মাগার হ্যার মুখ টিপা হাসি আমার পছন্দ হয় নাইক্যা। এক্কেরে আপনার ভাবির মতো ফন্দিফিকিরের হাসি। এই মাইয়া বিয়া করন যাইব না।’ লালমিয়ার এমন মনোভাব জেনে আমার ভালো লেগেছিল, কারণ লালমিয়া সব সময় খুঁজবে তার প্রথম বউয়ের সঙ্গে যাতে না মিলে।
এমন একজন মেয়ে পাওয়া বেশ কঠিন হবে, এভাবেই একসময় তার দ্বিতীয় বিয়ের ইচ্ছা চলে যাবে। আমি বললাম, পৃথিবীর সব মানুষের সঙ্গে কিছু না কিছু মিল তো থাকবেই। তার মানে, আপনার বিয়ে করার ইচ্ছা চলে গেছে? সে বলল, ‘কি যে কন বাইসাব, লালমিয়া এত সহজে হাল ছাড়ে না। আমি ঘটকরে কইয়া রাখছি, ভালা মাইয়া পাইলেই খবর দেবে।’ আমি তাকে বললাম, দেখেন ভাই বিবাহ না হওয়ার কারণে আবার দেবদাস হয়ে যাইয়েন না, অবশ্য দেবদাস হতে আপনার বাড়তি কিছু করতে হবে না।
সে অবাক হয়ে বলল, ‘ক্যান?’ আমি বললাম, আপনার তো দাড়ি আছেই আর মদ্যপান তো আপনি করবেন না, শুধু একজন চন্দ্রমুখী জোগাড় করা আর বিরহে পথে পথে ঘোরাফেরা। লালমিয়া অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘ভাইসাব তো আমার লগে কুনো সুম মশকরা করেন না, তয় আজ আপনার মুখে ইমুন কতা বালা লাগছে কইলাম। আপনার হাসিখুশি মুখ দেখলে আমার পরানডা জুড়ায় যায়গা কইলাম।’ আমি বললাম, আপনার শেয়ারের খবর কী? সে প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘আপনার কথার বাইরে তো কোনো দিন কারবার করি নাইক্যা। সময় মতই খালাস, অহন কি কিনুনের সময় হইছে?’ আমি বললাম, দাম আরও পড়বে মনে হয়, বাজারে এখনো বিক্রির চাপ বেশি।
সপ্তাহখানেক পর লালমিয়া আবার খুশি মনে অফিসে এসে হাজির। ব্যাগ থেকে একটি মেয়ের ছবি বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘ভাইসাব এই মাইয়াডারে খুবই মনে ধরছে। আমার প্রথম বউয়ের লগে যতই মিল থাকুক, এই মাইয়ারে আমি বিয়া করুমই। ছবিতে মেয়েটি কালো বোরকা পরা।’ আমি বললাম, আমার দেখার কী আছে? আপনার পছন্দ হলেই ঠিক আছে। তাহলে বিয়ে কবে করছেন? সে বলল, ‘হবায় তো ফটো দেখলাম, মাইয়ারে সামনাসামনি দেখতে অইব না! কি যে কন ভাইসাব, আজকাল এমন সাজুগুজু কইরে ফটো ওঠায় চিন্তাও করবার পারবেন না। ধোকা খাইবার চাই না। হ্যার লগে দেখা করুম, চিন পরিচয় অইব, বাত চিত অইব, তারপরে না কতা দিমু। অহনো দেরি আছে। তয় এইবার আপনের কথাই মনে রাখুম, মানুষের লগে তো মানুষের মিল থাকবারই পারে, অহন হেইড্যা কুনো ব্যাপার না। তয় একখান সমস্যা আছে বুঝলেন ভাইসাব।’ আমি বললাম, কী সমস্যা? সে বলল, ‘এই মাইয়া আমাগো গোত্রের না, হ্যারা বাড্ডায় থাকে।’ আমি বললাম, কেন বাইরের মেয়েদের কী সমস্যা আছে? সে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘হ্যারা আমাগো মন বুঝবার নাও পারে। যাউকগা আর দেরি করন যাইব না।’
যেকোনো বিপদ ধীরে ধীরে কেটে যায়। পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। শেয়ারবাজারও এর ব্যতিক্রম নয়। ধীরে ধীরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্যসূচক বাড়ছে। মানুষ নতুন আশায়, নতুন উদ্যমে শুরু করছে শেয়ার বেচাকেনা। এ সময় ব্যস্ততা আবার বেড়ে যায়। আমার এ কয়েক সপ্তাহ কেন জানি লালমিয়ার কথা মনেও পড়েনি। তাই তো! লালমিয়া বেশ কিছুদিন হয় অফিসে আসছে না। অথচ এ সময় উপস্থিত থাকা জরুরি। আমি কয়েকজনকে লালমিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কিছুই বলতে পারল না। কোনো অসুখ–বিসুখ হলো কি না! কিংবা কোনো বিপদ? ভাবলাম, আজ যাওয়ার পথে লালমিয়ার আড়তে গিয়ে খোঁজ নেব। সব শেষ করে বিকেলে লালমিয়ার আড়তে উপস্থিত হলাম। হঠাৎ আমাকে দেখে লালমিয়া দিশাহারা। সে আমাকে বসতে বলল, তারপর খাবার আনার জন্য বলল। আমি বললাম, এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনার কোনো খবর নেই, তাই ভাবলাম বাড়ি ফেরার আগে দেখা করে যাই। তা ছাড়া এখন শেয়ার কেনার আসল সময় অথচ আপনি নেই। সে বলল, ‘টেকা তো আমার অ্যাকাউন্টেই আছে আর আপনেরে তো অথরাইজ করা আছে, আপনি কিনেন ভাইসাব। তয় এইবার ব্যাংকের শেয়ার কিননের কতা কইছিলেন মনে আছে?’
আমি বললাম, হ্যাঁ মনে আছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ভাইসাব আমার শইলডা আর মনডা দুইখানি খুব খারাপ।’ আমি লক্ষ করলাম, অঘুমে চোখের কোণ কালো। অবশ্য নিয়মিত সুরমা ব্যবহারের কারণে লালমিয়ার চোখের কোণ সব সময়ই কালো। তারপরও সে যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তা বোঝা যায়। আমি বললাম, একি হাল হয়েছে আপনার? কথা বলতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠ কেঁপে উঠল। শুধু এটুকু বলল, ‘হ্যারা আমারে দৌড়ান দিছে।’ আমি বললাম, কী বলেন কিছুই বুঝলাম না। কারা আপনাকে ধাওয়া করল? লালমিয়ার মুখে কোনো কথা নেই। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
তার অবস্থা দেখে আমার মন খুব খারাপ লাগল। কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। সে বেশ কিছুক্ষণ পর আত্মস্থ হয়ে যা বলল, তাতে বুঝলাম। তার ঘটক বিশাল সমস্যা ঘটিয়েছে। সে মেয়ের পক্ষকে বলেছে, ছেলে বিরাট ব্যবসায়ী, পুরান ঢাকায় তার কয়েকটি আড়ত আছে। তা ছাড়া শেয়ারবাজারে ভালো বিনিয়োগ আছে। মেয়ের বাবা নিম্নবিত্তের। এতগুলো ছেলেমেয়ের ভার বহন করা বেশ কষ্টসাধ্য। হোক না পুরান ঢাকার। ছেলে তো প্রতিষ্ঠিত। তার মেয়ের বাকি জীবন ভালো কাটবে। সে ভেবেই তারা এ বিয়েতে মত দিয়েছিল। ঘটক লালমিয়ার বয়স আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা চেপে গিয়েছিল। লালমিয়া যেদিন মেয়ে দেখতে গেল, সেদিন মেয়ের পক্ষ জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি ছেলের কে হন মামা নাকি চাচা? লালমিয়া বেশ অপ্রস্তুত হলেও তার সঙ্গীরা বলেছিল, ‘মামা-চাচা অইব ক্যালায়, হ্যায় নিজেই তো পাত্র।’ আর যায় কোথায়, তারা রেগে গিয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে লালমিয়া বাহিনীকে তাড়া করেছে। তার পর থেকে ঘটকও লাপাত্তা। এমন অপমানে লালমিয়া কয়েক সপ্তাহ বাড়ি থেকে বের হয়নি। শুধু আমাকে বলল, ‘ভাইসাব দ্বিতীয় বিয়ার খায়েশ মিটা গ্যাছে গা। আমার অহন একখান কাম বাকি আছে, হালার ঘটকরে খুঁইজ্যা বাইর করতে অইব।’ সমাপ্ত
*লেখক: বায়াজিদ গালিব, ক্যালগারি, কানাডা
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস dp@prothomalo. com