মানুষের স্বার্থেই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর গুরুত্বপূর্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি
ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর উভয় দেশের সাধারণ মানুষের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। সোম থেকে বৃহস্পতিবার দিল্লিতে অবস্থানকালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হতে পারে। উভয় দেশের সম্পর্কের গভীরতা ঐতিহাসিকভাবে বহু আগেই প্রমাণিত। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি দ্রুত উন্নতি করে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর শীর্ষ বৈঠকের দিকে আন্তর্জাতিক দুনিয়াও তাই তাকিয়ে রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামরিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্রকল্পেরও উদ্বোধন করার কথা রয়েছে দুই প্রধানমন্ত্রীর।

কোভিডের কারণে সৃষ্টি হওয়া সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংকট লকডাউন–পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে দেয়নি।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও মজবুত হয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে একটি আদর্শ মডেল। গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে বহু দ্বিপক্ষীয় সমস্যার বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধানে সক্ষম হয়েছে উভয় দেশ। দুটি দেশই একটি নিরবচ্ছিন্ন ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তাই তাদের মধ্যে সম্পদ বণ্টনব্যবস্থা নিয়ে কিছু ভৌগোলিক জটিলতা স্বাভাবিক কারণেই রয়ে গেছে। তবে উভয় দেশ বহু সমস্যার সমাধান করতেও সক্ষম হয়েছে।

দুটি দেশের মধ্যে নদীর ভাগ-বাঁটোয়ারা সবচেয়ে জরুরি এবং জটিল বিষয়। দিল্লি ও ঢাকার দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে পানি ব্যবস্থাপনা এবং পানি বণ্টনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত ৫৪টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে দুই দেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পানি বণ্টন চুক্তির কাঠামো তৈরির জন্য সাতটি নদীকে চিহ্নিত করেছে।

দুই দেশের মধ্যে বহমান প্রধান নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে গঙ্গা, তিস্তা, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার, কুশিয়ারা প্রভৃতি। সম্প্রতি যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) দিল্লি ও ঢাকা কুশিয়ারা নদীর অন্তর্বর্তীকালীন পানি বণ্টন বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) চূড়ান্ত করেছে। কুশিয়ারা নদীটি ভারতের বরাক নদের একটি শাখা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে কুশিয়ারা ছাড়াও সুরমা নামে তার প্রশাখাও রয়েছে। দীর্ঘ ১২ বছর পর ৩৮তম জেআরসি বৈঠক ২৬ আগস্ট দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের পানিশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত এবং বাংলাদেশের প্রতিমন্ত্রী জাহেদ ফারুকের উপস্থিতিতে এই বৈঠকে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বন্যার তথ্য ভাগ করে নেওয়া, নদীদূষণ মোকাবিলা, পলি ব্যবস্থাপনার ওপর যৌথ গবেষণা পরিচালনা, নদীতীর রক্ষার কাজ ইত্যাদি পারস্পরিক স্বার্থের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। উভয় দেশের অভিন্ন অববাহিকা ব্যবস্থাপনা এবং ভারতীয় নদী সংযোগ প্রকল্প নিয়েও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।

কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে সহায়তা করেছিল ভারত। তবে লকডাউনের হাত ধরে পণ্য পরিষেবা সরবরাহ শৃঙ্খলে বাঁধার কারণে দেশের অর্থনীতি ধাক্কা খায়। কমে যায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার। রপ্তানিতেও বিরূপ প্রভাব পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকা আইএমএফ থেকে সহায়তা প্যাকেজের জন্য আলোচনা করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা এবং কোভিড–পূর্ববর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে ভারতের কাছে সহায়তা চাইতে পারেন বলেও মনে করা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে বাংলাদেশ ভারত ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি বা সিইপিএ নিয়েও আলোচনা হবে। দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা নিয়েও আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারতীয় অস্ত্র বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, এমন জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই গত মাসে ভারতীয় সেনাপ্রধান বাংলাদেশ সফর করেন। আর সেখান থেকেই দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি নিয়ে চর্চা শুরু হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারের ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ভারতের উত্তর-পূর্বে বহিরাগত শক্তির উসকানির কারণে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চল থেকে জঙ্গিবাদকে উৎখাত করতেও উভয় দেশের সামরিক সহযোগিতা জরুরি।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান শর্ত হিসেবে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতিকে চিরকাল গুরুত্ব দিয়ে আসছে ভারত। সেই কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। উভয় দেশের মধ্যে আরও তিনটি ট্রেন পরিষেবা পুনঃস্থাপনের একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হতে পারে বৈঠকে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে ব্যবহৃত পুরোনো রেল সংযোগুলোকে আবার চালু করার উদ্যোগও শুরু হতে পারে। সম্প্রতি নির্মিত পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশকে সংযুক্ত করেছে। এবার ট্রানজিট–সুবিধার মাধ্যমে উভয় দেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার পথ মিলতে পারে এই বৈঠকে। মোংলা সমুদ্রবন্দরও দেশের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি ভারতের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।

বহুলচর্চিত তিস্তার পানি সমস্যারও সমাধানের পথ বেরিয়ে আসতে পারে উভয় দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের আলোচনায়। এমনকি, বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল বা বিবিআইএন-এর যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করতেও এই বৈঠক বিশেষ সহায়ক হতে পারে।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ বন্ধুত্ব ও আস্থার অনবদ্য নজির সৃষ্টি করে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বকে মজবুত করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার অনন্য নজির তৈরি করেছে উভয় দেশ। নিজেদের সামগ্রিক বন্ধনকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এক নতুন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রেও দুই দেশ সংকল্পবদ্ধ। উভয় দেশের নাগরিকদের স্বার্থে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। ফলে উপকৃত হবেন উভয় দেশের সাধারণ মানুষ।

* প্রিয়জিৎ দেবসরকার, লেখক ও গবেষক, লন্ডন