প্রিয় বাবা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বাড়িতে যত চিঠি লিখেছি, কোনো দিন আপনাকে সম্বোধন করে কিছু লেখা হয়নি। কিন্তু আপনি সব চিঠিই আনা-নেওয়া করতেন।

আপনি মানি অর্ডার পাঠালে দু–একটি লাইন লিখতেন, কিন্তু কখনো আপনাকে আমার চিঠি লেখা হয়নি। মোবাইলেও কখনো আপনার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা হয়নি।

ডাকঘরে লেখা থাকে— ‘চিঠি লিখুন, ইহা স্থায়ী’। এখন মনে হয়, যদি লিখতাম, অন্তত কিছু স্মৃতি থাকত। আপনি জানেন না, আমি সব সময়ই চিঠি লিখতে পছন্দ করি।

আমার বন্ধুদের কাছে অনেক চিঠি লিখেছি। বাবা, আপনি কি জানেন, এখন আর কেউ চিঠি লেখে না। সবাই টেক্সট করে মোবাইলে অথবা ই–মেইল করে। আমরা একটা টেক্সট দিয়েই জীবনের সব সম্পর্ক শেষ করার চেষ্টা করি। কাউকে চিঠি লিখতে আবেগ-অনুভূতি দরকার হয়। লেখার সময় জীবন নিয়ে ভাবতে হয় কিছুক্ষণ। এখন আমাদের সময় কোথায়! আগে মানুষ কোনো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিতেও একটু সময় পেত। যাতে সমস্যাও কম হতো। এগুলো এখন আর মানুষের মধ্যে দেখা যায় না।

হাতের লেখা যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি মানুষ মানুষকে নিয়ে চিন্তা করা বা সময় দেওয়া সবই কমে যাচ্ছে। আমরা অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছি।

আমরা শুধু ছুটছি, কিন্তু জানি না গন্তব্য কোথায়? আপনার সঙ্গে যখন বাগেরহাট রামকৃষ্ণ আশ্রম যেতাম, লেখা ছিল ‘ঈশ্বর লাভই জীবনের উদ্দেশ্য’। আসলে আমরা নিজেরা কখনো চিন্তাও করি না জীবনের উদ্দেশ্য কী! কেন আমরা অনন্তহীন গন্তব্যে ছুটছি। এখন উদ্দেশ্যহীন চলাফেরা শুরু হয়েছে আরও বেশি। মানুষ কোথাও শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না। সব সময় আমরা শুধু নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করছি। আমরা কী করছি, কেন করছি কোনো লক্ষ্য নেই। একটাই উদ্দেশ্য, আমাদের শুধু টাকা রোজগার করা। কিন্তু এর শেষ কোথায়, আমরা ভাবছি না। একটা সময় সবারই মৃত্যু হবে।

আমাদের কিছুই থাকবে না, এটা আর ভাবি না। আপনার ব্যবসায় যখন সমস্যা চলছিল, দেখেছি, আপনি নির্লিপ্তভাবে সব ছেড়ে চলে এলেন। আপনাকে কোনো দিনও দেখিনি কোনো আর্থিক সমস্যা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে। সব সমস্যা নিজের মধ্যে রাখতেন। কিন্তু অর্থকষ্ট কোনো দিন আমাদের বুঝতে দেননি। আপনি সব সময় সাধারণভাবে জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনি।

আমার খুব ইচ্ছা ছিল, একদিন সবাইকে উড়োজাহাজে চড়াব। উড়োজাহাজে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পারলাম না। যখন সময় ছিল, তখন সাধ্য ছিল না। সাধ্য যখন হলো, তখন অনেক দেরি। আপনি এখন সব যোগাযোগের ঊর্ধ্বে।

বাবা, এখন পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। আর কিছুদিন আগে হলে আপনাকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করাতে পারতাম। বৈরী আবহাওয়ার ভয় পেতে হতো না। কী হতো জানি না, কিন্তু মনে সান্ত্বনা থাকত, চেষ্টা তো করতে পারতাম। পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনে অনেক বড় পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তি ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মারাত্মকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে মানবিকভাবে। এ পরিবর্তন আমাদের চোখেও পড়ছে না এবং বোঝার চেষ্টাও করছি না।

প্রযুক্তি এ মারাত্মক ক্ষতি থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। আর আমরা এমনভাবে চলছি যে আমরা চাইও না রক্ষা পেতে। একটি মানবিক প্রজন্ম পৃথিবীর জন্য এ মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন। অর্থ- সম্পদ- প্রযুক্তি-বিনোদন এসবকে উপভোগ করতে যে হৃদয় প্রয়োজন, আমরা সে হৃদয় আর পাচ্ছি না। হৃদয়হীন হয়ে যাচ্ছে মানবসভ্যতা। জীবনকে উপভোগের জন্য যে হৃদয় বা ভালোবাসার দরকার, সে হৃদয় আমরা হারিয়ে ফেলছি।

ভার্চ্যুয়াল সমাজে চলতে গিয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে বাস্তব সমাজব্যবস্থাকে। জন্মের পর আমরা শুধু জানি একমাত্র সত্য ও নিশ্চিত হলো মৃত্যু। কিন্তু আমরা সীমাহীন লোভ আর অপরিসীম ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বাস্তবতাকে ভুলে যাচ্ছি। লাগামহীনভাবে ছুটছি।

হতাশা, দ্বন্দ্ব আর চরম অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে চলছি। মানুষের জগৎ ও জীবনের তৃষ্ণা কোনো দিনও মেটে না। আমরা শুধু চাই। আপনার কোনো ইচ্ছাই আমি পূরণ করতে পারিনি, বাবা। কোনো দিন মায়ের সঙ্গেও আপনাকে জোরে কথা বলতে দেখিনি। তাঁকে একা করে আপনি চলে গেলেন! শুধু একদিন আমাদের দুই ভাইকে শাসন করেছিলেন। শেষে আর একবার আপনার বকা খেতে চাই। ‘তুমি’ করে যদি একদিন আপনাকে ডাকতে পারতাম! একবার শুধু বলতে চাই, বাবা, তোমাকে খুবই মিস করছি।

আমার বন্ধু, যার প্রতি কৃতজ্ঞতা জীবন দিয়েও শোধ হবে না। আমার যুক্তরাষ্ট্র আসার সব বন্দোবস্ত বন্ধুই করল, কিন্তু তাকেও হারালাম। মানুষ জীবনে শুধু পরিকল্পনা করতে পারে, কিন্তু বাস্তবায়নকারী একজনই। আমরা ভুলে যাই তাঁকে। আসলে মানুষের হাতে কিছু নেই। সারা জীবন শুধু আমরা মানুষকে সন্তুষ্ট করতে চাই, ভালোবাসতে চাই, কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারি না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মানুষের পক্ষে কাউকেই সন্তুষ্ট করা বা ভালোবাসা সম্ভব নয়। এটাই চরম বাস্তবতা। আমরা ভুলতে বসেছি যে মানুষের পক্ষে শর্তহীন ভালোবাসা প্রায় অসম্ভব। আর প্রেম বা ভালোবাসা কোনো শর্ত দিয়ে হয় না। যখন শর্ত থাকে, তখন সেটা ব্যবসা হয় ভালোবাসা নয়।

আজ আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আপনাকে লিখছি। এ চিঠি পেলে আপনার থেকে কেউ বেশি খুশি হতো না। যখন আমার কোনো লেখা ছাপা হতো, কোনো অনুষ্ঠানের কার্ডে বক্তৃতায় নাম থাকত, আপনি সবাইকে দেখাতেন। আমি এখন পিএইচডি করতে  যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি, মাঝেমধ্যেই আমাকে বক্তৃতা দিতে হয়। এসব দেখলে বা শুনলে আপনি আর আমার প্রাণের বন্ধু, এ দুজন মানুষই সব থেকে বেশি খুশি হতেন। কিন্তু এটাই জীবনের পরিহাস! দুজনের কেউই আজ আমার সঙ্গে নেই। কিন্তু আমি সব সময়ই আপনাদের অনুভব করি। জীবন দিয়েও আপনাদের ঋণ শোধ করতে পারব না। জীবনে বন্ধু যে কত প্রয়োজন, যার সঙ্গে স্বপ্ন ও ভালোবাসার কথা বলা যায়, এখন বুঝি। জীবনের বাস্তবতা কেমন এখন অনুভব করি! আমার মতো এমন হীন, নিঃসঙ্গ জীবন যেন কারও না হয়।

আপনার ছোট ছেলে
মোহিত প্রধান
*লেখক: পিএইচডি গবেষক, স্টিফেন এফ অস্টিন এস্টেট ইউনির্ভাসিটি, টেক্সস, যুক্তরাষ্ট্র