দেশ মানে কী?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আসলে দেশ মানে কী? আমি বলি, দেশ মানে মায়া, দেশ মানে স্মৃতির কোলাজ, দেশ মানে ভালোবাসার বন্ধন, দেশ মানে প্রকৃতির সঙ্গে গড়ে ওঠা মিতালি, দেশ মানে মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা আদি ও অকৃত্রিম সখ্য।

প্রতিবার যখন দেশ ছাড়ি, যতক্ষণ উড়োজাহাজের জানালা থেকে দেশের মাটি, গাছ, নদীর অস্তিত্ব দেখা যায়, ততক্ষণ জানালায় চোখ রাখি। এরপর যখন প্লেন কয়েক হাজার ফুট ওপরে গিয়ে মেঘের আড়ালে চলে যায়, তখন যেন চোখের সঙ্গে দেশের এক বিচ্ছেদ ঘটে। ঠিক তখন এসে হাজির হয় মনের জানালা। সেই জানালায় ফ্ল্যাশব্যাকের মতো করে ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সব স্মৃতিগুলো এসে ভিড় করে।

আমি গ্রামের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষ। আমার কাছে দেশ মানে সেই দুরন্ত শৈশব, বাঁধনহারা কৈশোর। গ্রীষ্মের খরতাপে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে তালগাছে উঠে তালের রস খাওয়া। আম কুড়ানোর সেই অলীক জগত, জামগাছের শাখায় বসে ছোট্ট কাগজের টুকরায় লবণ নিয়ে জামের স্বাদ নেওয়া। আমার কাছে দেশ মানে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বইয়ের ব্যাগ বারান্দার খাটে ফেলে রেখে বৃষ্টির ঘোলা জলে লুকোচুরি খেলা। দেশ মানে বর্ষার কাদা উপেক্ষা করে স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া, স্যারের স্বপ্নবুননের সারথি হওয়া। দেশ মানে ভরা বর্ষায় ফুটবল খেলা, শীতের আমেজে ক্রিকেট খেলা। দেশ মানে শীতের পিঠা-পুলি খাওয়া। দেশ মানে গ্রামের কাছের মানুষের দরদভরা কণ্ঠে আমার নাম ধরে ডাকা। দেশ মানে মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়স্বজনের ভালোবাসার আখ্যান। দেশ মানে গ্রামের বাজারে গেলে বন্ধু-পরিজনের আবদারে জোর করে চা খাওয়া। দেশ মানে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তুলনাহীন আড্ডা আর দুরন্তপনার সাক্ষী হওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গাছ থেকে ডাব চুরি করে খাওয়া।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

আজ আমি সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি, উন্নত পরিবেশে কাজ করছি। তবু এখানে কেউ দরদভরা কণ্ঠে বলে না, ‘এই, এক কাপ চা খেয়ে যা।’ বন্ধুরা বলে না, ‘শিঙাড়া এনেছি, ভাগ করে খাই।’ কেউ বলে না, ‘ছুটিতে চলে আয়, তোর নিজ হাতে লাগানো গাছের আম পেকে গেছে। তোর লাগানো গাছে নতুন ফল এসেছে। কাঁঠালগাছে কাঁঠাল ধরেছে, তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়।’

দেশ আসলে এক সত্তা, অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা এক অনির্বচনীয় অনুভূতি ও আবেগের নাম। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেন, নিজের দেশের চেয়ে শাশ্বত সুন্দর দেশ আর কোথাও দেখিনি। প্রকৃতি আমাদেরকে দুহাত ভরে উজাড় করে দিয়েছে। এত ফলের সমাহার, ফসলের বৈচিত্র্য, নানা জাতের মাছের সমারোহ আর কোথাও নেই। তাই কখনো মনে হয় না, এই দেশটা ছেড়ে পৃথিবীর অন্য কোথাও গিয়ে স্থায়ী হব। হবই–বা কীভাবে? কারণ, দেশ মানে তো মায়া, ভালোলাগা আর ভালোবাসার এক পরম আশ্রয়।

*লেখক: সুব্রত মল্লিক, পিএইচডি শিক্ষার্থী (সমাজবিজ্ঞান বিভাগ) , ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার, যুক্তরাজ্য, সহকারী অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), ৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার)।

আরও পড়ুন