নানাকে নিয়ে লেখা...

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নানাবাড়িতে বেড়াতে যাওয়া সব নাতি–নাতনির কাছে সব সময়ই অতি আনন্দের। তবে আমার কাছে ব্যাপারটা বেশি আনন্দের ছিল। সব চেয়ে বড় কারণ ছিলে মা–বাবার হাতের মার খাওয়া থেকে বিরতি আর পড়াশোনা থেকে বিরতি। আমার বাড়ি থেকে নানাবাড়ি লঞ্চে যেতে দু-তিন ঘণ্টা লেগে যেত। কিন্তু ওই সময়টাকে তখন মনে হতো এ রকম যে ১০ ঘণ্টার দূরের পথও পাড়ি দেওয়া যায় যদি গন্তব্য হয় নানাবাড়ি। নানাবাড়িতে ফেলে আসা দিনগুলো এখনো মনের কোণে উঁকি দিয়ে চোখ ভিজিয়ে দেয়। আমি আমার মাকে বলি মাঝেমধ্যে নানা আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে কী হতো? হয়তো আমার মা–ও জানেন এই প্রশ্নের উত্তর শুধুই একবুক হাহাকার আর ফেলে আসা স্মৃতির কষ্ট।

নানাবাড়ির সকালটা অদ্ভুত মোহে কেটে যেত। সকালে নানার ফজরের নামাজের সূরার আওয়াজ শোনা মানেই আমি নানাবাড়ি। আর এর মানে হল নানা বাজারে যাবেন এবং পারলে সব নাতিনাতনি দল বেঁধে নিয়ে যাবেন আর আমরাও নানার সাথে যেতে একপায়ে রাজি। যদি আমাদের কারও চোখে ঘুম থাকত, তাহলে নানার কালো রঙের লম্বা লাইটের আলো সে ঘুম উড়িয়ে দিত। এর পেছনে বড় কারণ ছিল নানার সাথে বাজারে যাওয়া মানে পরোটার সাথে ডাল আর কনডেন্স মিল্কের চা দিয়ে পেটটাকে ভরে নিয়ে আসা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রচণ্ড সাহসী মানুষ ছিলেন আমার নানা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে অনেকবার ধরাশায়ী হয়েছেন কিন্তু কখনই নিজেকে সমর্পন করে দেন নি। সত্তুরের বেশি বয়সেও বৃষ্টি, বন্যা যা–ই হোক, আমার নানার বাজারে যাওয়া কেউ থামাতে পারত না। পিরোজপুর স্বরূপকাঠির মাহমুদকাঠী বাজারে নানাকে একনামে সবাই চিনত।
নানার সঙ্গে বাজারে গিয়ে ২ টাকা আর নানাবাড়ি থেকে চলে আসার সময় ১০ টাকা পাওয়া ছিল আমাদের মৌলিক অধিকার। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল না। তারপরেও নানা আমাদের পরীক্ষা শেষের তারিখ জানলে বাজারে মাঝেমধ্যে ওই তারিখগুলোতে অপেক্ষা করতেন, যদি আমরা এসে পড়ি।

নানা তাঁর নাতিনাতনিদের নিয়ে খুব গর্ব করতেন। আমি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছি শুনে নানা পুরো বাজারের সবাইকে বলেছিলেন। নানা বকা দিতেন যদি কেউ শীতে গোসল না করত। তবে নানাবাড়িতে গিয়ে গোসল না করার কাহিনি একটাই। নানাবাড়ির পুকুরের পানি থাকত অনেক ঠান্ডা আর বদ্ধ। মনে হতো বরফের দেশে আছি।

নানাকে কাঁদতে দেখতাম যখন, আমরা বিদায় নিতাম। কারণ, আমার নানা সব সময় নাতিনাতনি দিয়ে ভরা বাড়ি পছন্দ করতেন। আগে যে নানাবাড়িতে ঘুমানোর জায়গা থাকত না, আজ সেই বাড়িটা পুরো ফাঁকা। আজ অনেক বছর হলো নানা নেই, নানিও নেই। আমি গিয়েছিলাম ২০১৪ সালে। কিন্তু বাড়িটাতে কি যেন নেই মনে হতে থাকল। মনে হলো যেন চেনা ঘরের অচেনা আমি। এরপর আর যাই নি। জানি না কখনো যাওয়া হবে কি না।

এই জাপানের দূরপ্রবাসে নানাকে খুব মনে পড়ে। ঈদ এলে ১০ টাকার প্লাস্টিকের গাড়ি, নানার নামাজের পবিত্র সুর, নানার সঙ্গে বাজারে যাওয়া—এসবই এখন মন খারাপের স্মৃতি।

আমার মেয়ের জন্ম জাপানে, মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে করে নানা বেঁচে থাকলে আমার মেয়ে, সহধর্মিণীকে নানাকে দেখানোর। কী সাদা মনের মানুষ ছিলেন আমার নানা, তা পুরো আরামকাঠী জানত। আরামকাঠী ছিল আমার নানাবাড়ি।

নানা যেখানে আছেন, ভালো থাকবেন। আপনার নাতি আজকে জাপানে প্রতিষ্ঠিত আইটি ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু আপনাকে দেখাতে পারলাম না। প্রিয় পাঠক সবাই আমার নানা–নানির জন্য দোয়া করবেন।

বিকেল চারটা বাজে, অফিস শেষ হওয়ার পথে। বিকেলের লাল আভায় গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে ঘরে। হয়তো ওই দূরের আকাশে নানাও আমাকে দেখছেন।