বিলেতে আনন্দধারা আর্টসের রবীন্দ্র উৎসব ২০২৩

ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসারে রবীন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন প্রধান বাহন। এ ছাড়া আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের দিকেও দেখি, তাহলে দেখব, আমাদের অনেকের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ব্যথার পথ্য, শোকের সান্ত্বনা, ভাষাহারা আনন্দের অশ্রু এবং পরম নির্ভরতা। রবীন্দ্রনাথ তাই আমাদের জীবনেও হয়ে ওঠেন একান্ত বন্ধু। তাই ব্যক্তিগত জীবনপ্রবাহের রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামষ্টিক বিকাশেও অপরিহার্য হয়ে ওঠেন।

আনন্দধারা আর্টস বিগত প্রায় দুই দশক ধরে বিলেতের মাটিতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের যে আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে আসছে, তার অন্যতম অনুপ্রেরণা রবীন্দ্রনাথ।

আনন্দধারা আর্টসের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল নিয়মিত রবীন্দ্র উৎসবের আয়োজন করা। এ বছর সে প্রয়াস সফল হয়েছে। দুই দিনব্যাপী রবীন্দ্র উৎসবের যাত্রা শুরু হয়েছে ২৬ ও ২৭ মে লন্ডনের রিচমিক্স মিলনায়তনে। রবীন্দ্রনাথের নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ উপস্থাপনে সমৃদ্ধ এই উৎসবের সূচনা হয় সমবেত কণ্ঠে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ ও আনন্দধারা আর্টসের পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদের স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে। এরপর বিলেতের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘দক্ষিণায়ন’ আনন্দ গুপ্তের গ্রন্থনায় ও পরিচালনায় পরিবেশন করে নৃত্য-গীতি–আলেখ্য ‘হে অনন্ত পুণ্য’।

এরপর প্রদর্শিত হয় চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের বহুমাত্রিক চিত্রসম্ভারের ওপর সনৎ মোহান্ত নির্মিত চমৎকার একটি তথ্যচিত্র। অরোরা ফিল্মস প্রযোজিত ‘দ্য ভিশন উইদিন’ নামের তথ্যচিত্রটি ইউরোপে এই প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়েছে। প্রথম দিনের আয়োজনের সমাপ্তি টানা হয় আবৃত্তি সংগঠন ‘বর্ণন’ ও আনন্দধারা আর্টসের যৌথ প্রযোজনা ‘গীতাঞ্জলির গান’ শিরোনামে গীতি–আলেখ্য দিয়ে। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উদয় শংকর দাশের গ্রন্থনায় এ উপস্থাপন দর্শক–শ্রোতাদের মন জয় করেছে।

২৭ মে রিচমিক্সের একই মঞ্চে এই উৎসবের দ্বিতীয় দিনের পরিবেশনায় ছিল আনন্দধারা আর্টসের ছোটদের গান ও কবিতার সমন্বয়ে গ্রন্থিত পরিবেশনা ‘আমরা নতুন যৌবনের দূত’। বিদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠা শিশুদের দুর্দান্ত পরিবেশনা শুনে দর্শক–শ্রোতাদের পক্ষে ভাবা দুঃসাধ্য যে এরা বিলেতের মাটিতে বসে এমন চমৎকার গান করছে, কবিতা পড়ছে।

ছবি: সংগৃহীত

এরপর ভারত বর্ষের বাইরে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের মূল্যায়ন ও ব্যবহার বিষয়ে ‘রবীন্দ্র কবিতাশ্রিত পাশ্চাত্য সংগীত’ শীর্ষক বক্তৃতা করেন রবীন্দ্রগবেষক কল্যাণ কুণ্ডু। তাঁর এই আলোচনা উৎসবে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করেছে। এরপর আসে আবৃত্তিশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী শ্রী উদয় শংকর দাশের সুন্দর পরিবেশনা ‘কবি রবীন্দ্রনাথ’।

এরপর মঞ্চে আসেন অভিনেতা ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব শ্রী সুজয় প্রসাদ চট্টপাধ্যায়। তাঁর ‘বিদেশি ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক সুন্দর গ্রন্থনা ও পাঠের সঙ্গে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ইমতিয়াজ আহমেদের অসামান্য সংগীত পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে দর্শক–শ্রোতাকে। রবীন্দ্রসংগীত ও ওডিশি নৃত্যের সম্মিলনে এই আয়োজনের একমাত্র নৃত্যটির চমৎকার পরিবেশন করেন নন্দিত নৃত্যশিল্পী শ্রীমতি গৈরিকা মাথুর।

দুই দিনব্যাপী এই আয়োজনে বিলেতের দর্শক–শ্রোতার তৃষাতুর অপেক্ষা ছিল সেই শিল্পীর, যিনি দুই বাংলায় তো বটেই বাংলার বাইরে যত বাঙালি ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে, তাদের সবার মনে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন, তিনি অনন্য শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা কেবল ভীষণ সুন্দর গেয়েছেন, তা–ই নয়, গানের ফাঁকে ফাঁকে জুড়ে দিয়েছেন ছোট ছোট বক্তব্য, যা শ্রোতাদের ঋদ্ধ করেছে।

দুই দিনব্যাপী এই উৎসবের সংগীতায়জনে ছিলেন কি–বোর্ডে শিল্পী অমিত দে, গিটারে অমি ইসলাম ও তানজিল তাহমিদ আর তবলায় অনিরুদ্ধ মুখার্জী। উৎসবে চমৎকার সঞ্চালনা করেছেন আবৃত্তিশিল্পী সমর দাস ও নৃত্যশিল্পী কান্তা তাজরীন।

এই অসামান্য আয়োজনের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যাঁর কথা না বললে, তিনি আনন্দধারা আর্টসের পরিচালক, সুচিকিৎসক, সুগায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ। আমন্ত্রিত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শ্রী সুজয় প্রসাদ চ্যাটার্জিসহ সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, এই অসামান্য আয়োজনের উদ্যোক্তা হিসেবেই শুধু নন, শিল্পী ইমতিয়াজ আহমেদ বিলেতে রবীন্দ্রনাথের গান ও রবীন্দ্রচর্চার যে ক্ষেত্র দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করে এসেছেন, সেটি অসাধ্য সাধনের শামিল। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অকৃত্রিম দায়বদ্ধতা না থাকলে এমন কর্মযজ্ঞ চালিয়ে নেওয়া কঠিন।

ইমতিয়াজ আহমেদ উৎসবের সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘রবীন্দ্র উৎসব আয়োজন করাই আমাদের প্রধান কাজ নয়। আমরা মনে করি, রবীন্দ্রনাথসহ আমাদের অন্য মণীষীদের যদি আমরা প্রতিদিনের জীবনচর্চায় না নিতে পারি, তবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ তো বটেই, মানুষের ব্যক্তিগত বিকাশও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’ তিনি উপস্থিত দর্শকদের অনুরোধ করেন যেন আগামী দিনেও সবাই মিলে এ রকম সার্থক আয়োজন করা যায়। সার্বিকভাবে সফল ও সুন্দর একটি উৎসব শেষ করে কানায় কানায় পূর্ণ আসর ছেড়ে দর্শক বাড়িতে ফিরেছেন সুরের রেশ এবং এ রকম পরিবেশনা নিয়মিত উপভোগ করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।