১.
পেশাগত জীবনে কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততার পাশাপাশি পারিবারিক দায়িত্বও অনেক। কর্মব্যস্ততা আর দায়িত্ববোধ জীবনকে সুন্দর করে। অধিকতর সুন্দরের আশায় নিজেদের অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখতে যথোপযুক্ত পরিকল্পনা করে পরিশ্রম করতে হয়। শুধু কাজের মধ্যে ডুবে থাকাই জীবন নয়, জীবনকে আনন্দ দিতে অবকাশযাপনের পরিকল্পনা দরকার। প্রাত্যহিক কঠিন রুটিনে একটু অবকাশ পেতে এনআইএইচের বড় গবেষক ডক্টর ইতি ও ডক্টর আরিফ দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে চাইল—জনবহুল ব্যস্ত শহর ছাড়িয়ে পাহাড়-জঙ্গলে কোথাও। উল্লেখ্য, এনআইএইচ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, এটি স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বায়োকেমিস্ট্রির গবেষণায় বছরজুড়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখলেও এ দুই বিজ্ঞানী খুব প্রকৃতিপ্রেমীও। বিজ্ঞানের গবেষণার পাশাপাশি তারা ভ্রমণের পরিকল্পনায়ও খুব পারদর্শী। ব্যস্ততার মধ্যে একটু সময় বের করতে পারলেই বেরিয়ে যায় প্রকৃতির সৌন্দর্যকে অবলোকন করতে।
২.
প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে পাহাড়, পর্বত, ঝরনা ও সমুদ্র অতুলনীয়। উপরন্তু এসব এলাকায় দিনের নীলাকাশ ও অন্ধকার রাতে রুপালি চাঁদ আর তারা ভরা আকাশের অসাধারণ রূপের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না! এই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আরিফ ও ইতি দম্পতির পরিকল্পনায় ঠিক হলো, এ বছর জুন মাসে আমরা শেনানদহ ন্যাশনাল পার্কে ক্যাম্পিং করব। পাহাড় বা সমুদ্রের কাছাকাছি কোথাও ক্যাম্পিং করার প্রবল উৎসাহ থাকায় তাদের এই পরিকল্পনায় আমি ও সহধর্মিণী ইভা সানন্দে যোগ দিতে রাজি হই। ইভা ও ইতি আপন বোন, দুজনই বিজ্ঞানের গবেষক আর নিজ নিজ সংসারে তারা হোমমিনিস্টার। ঘোরাঘুরির আগ্রহ ও কোথায় যাওয়া হবে এসবের সিদ্ধান্ত, রাজি হওয়া বিষয়টা তাদের থেকে এলেই ভালো। বউ খুশি মানে সংসার সুখী। সংসারে সুখের এই তত্ত্ব স্বামীদের বিশ্বাস করা দরকার। আমি বিশ্বাস করি! তাই এই ক্যাম্পিংয়ে যাবই যাব।
৩.
সিদ্ধান্ত হয়েছে ক্যাম্পিং করব আমেরিকার ভার্জিনিয়া প্রদেশে—শেনানদহ ন্যাশনাল পার্কের চূড়ায়। সেখানে থাকব দুই দিন, এই জুন মাসে শেষাংশের সপ্তাহান্তে। বেশ কয়েক সপ্তাহ আগেই পাহাড়ের ক্যাম্প গ্রাউন্ডে স্পট বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, খুব বেশি চাহিদা থাকায় সচরাচর এসব স্পট বুকিং দিতে হয় কয়েক মাস আগেই—ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন হলে কখনো অল্প সময়ের ব্যবধানে স্পট পাওয়া যেতে পারে। আমরা ভাগ্যবানদের দলে, স্পট পেয়েছি, ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। নাবিহা, নাশিতা ও ইহান যেকোনো কিছু ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে নারাজ। ওরা পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও স্মার্ট কাজে বিশ্বাসী। আমার ধারণা, ওরা এ গুণটা তাদের বাবার কাছ থেকে পেয়েছে, মানে আমার কাছ থেকে পেয়েছে! নিজের প্রশংসা করা হয়ে গেল এখানে—অসুবিধা নেই, এই গুণ আসলেও না থাকলে নিজের মাঝে তৈরি করব।
ক্যাম্পিংয়ে যাওয়ার সুন্দর পরিকল্পনা হাতে নিয়ে আমার এই তিন জুনিয়র বাচ্চারা প্রথমে মনোযোগ দিল প্রয়োজনীয় আর কিছু অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটায়। অ্যামাজনের প্রাইম অর্ডারে টেন্ট, এয়ার–ম্যাট্রেস, পিলো, এয়ার–পাম্পার, স্নেকরিপেল্যান্ট, মশার কিট, ইলেকট্রনিক চার্জ ব্যাংক, ন্যাপথলিনসহ আরও বেশ কয়েকটি বাড়তি সামগ্রী ইচ্ছেমতো তাদের নিজেদের জন্য। কসকো সুপারমার্কেট থেকে খাবারের বিস্তর তালিকা। তাদের এসব কেনাকাটায় খরচের পরিমাণ সংখ্যাটা দেখে আমার বুকটা শুধু বড়ই চিনচিন করে, কিন্তু মুখে হাসি দিয়ে বোঝাই অসুবিধা নেই! বাচ্চাদের খালাতো ভাইবোন আয়ানা ও আয়াজ—তারাও তাদের বাবা–মাকে দিয়ে হরেক রকম কেনাকাটা করিয়েছে। বিভিন্ন শুকনা খাবার, নরম পানীয়, চিকেন, বারবিকিউয়ের সরঞ্জাম, চা তৈরির সরঞ্জাম—কোনো কিছু বাদ দেয়নি। দুই পরিবারেরই বেশ বড় গাড়ি, কিন্তু এসব জিনিস ওঠানোয় গাড়ির স্টোরেজ স্পেস প্রায় ঠাসাঠাসি হলো।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
৪.
শেনানদহ পাহাড়ে ক্যাম্পিংয়ে যাব গাড়ি চালিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের অসাধারণ সুন্দর হাইওয়ে দিয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টার এ পথ। সকালের মিষ্টি রোদের মজাদার সময় কাটিয়ে দুই পরিবারের যাত্রা শুরু হলো। পথে একটা-দুটো বিরতি নিয়ে আরও কিছু সময় পর চোখে পড়া এলাকগুলোকে স্পষ্টই জনমানবহীন আর বসবাসহীন মনে হলো। আর মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও খুব দুর্বল কিংবা নেটওয়ার্কহীন হয়ে গেল। বিশাল পাহাড়ি এলাকা, বনজঙ্গল, আর আঁকাবাঁকা রাস্তাঘাট। ভয়ংকর আঁকাবাঁকা পথে ড্রাইভিং করে ক্রমেই পাহাড় বেয়ে উঠছি, এগিয়ে চলেছি। একটু অসতর্ক হয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে চললেই মহাবিপদ, গাড়ি বিকল হয়ে গেলে চরম বিপদ। ফোনে নেটওয়ার্ক প্রায় নেই বললেই চলে, তাই সাহায্যের জন্য কেউ বা কোনো প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসাটা খুবই সময়সাপেক্ষ ও কষ্টদায়ক ব্যাপার। শেনানদহ ন্যাশনাল পার্ক বিশালাকার বেশ কয়েকটা পাহাড়জুড়ে বিস্তৃত। পার্কের প্রধান ফটকে গাড়িপ্রতি ৩০ ডলার এন্ট্রান্স ফি দিয়ে এগিয়ে গেলাম। বিশাল বিশাল পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের ট্যুরিজম ব্যবস্থাপনার তথ্য পেলাম সেখানে। আমরা যাব ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড, প্রধান ফটক থেকে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে আরও ২০ মাইল দূর! এগিয়ে চলেছি, শক্ত হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল, সঙ্গে গাড়ি চালানোর দীর্ঘ সফল অভিজ্ঞতা। সংকোচ, উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তা থাকলেও পাহাড়ের কোলে দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতির দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দীর কয়েকটা বিরতি নিয়ে কোনো রকম বিপদ ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছালাম। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের মূল ফটকে চেকইন করে সবাই বেশ উৎফুল্ল হয়েছি।
৫.
শেনানদহ ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে রয়েছে শত শত ক্যাম্পিং স্পট—এগুলো বর্ণ A থেকে Z–এর প্রতিটি সারির দুই পাশে, প্রতি সারির এই স্পটগুলোর নম্বর যেমন A101, A102, B103 ইত্যাদি। আমাদের জন্য নির্ধারিত স্পট B সারিতে। খুঁজে পাওয়া খুব সহজ। পুরো এলাকায় কিছু দূর পরপর আছে পরিষ্কার ওয়াশরুম। নিজেদের জায়গায় পোঁছে স্পটেই গাড়ি পার্কিং শেষে স্বল্প সময়ে বিশাল কাজ করতে হলো। গাড়ি ভরা ঠাসাঠাসি করে রাখা জিনিসপত্র নামানো, তাঁবু টাঙানো, গাড়ির ব্যাটারি থেকে চার্জ ব্যবহার করে পাম্পের মাধ্যমে এয়ার–পিলো ফোলানো, এয়ার–ম্যাট্রেস ফোলানো, তাঁবুর চারপাশে সাপ বা বিষাক্ত কোনো পোকামাকড় তাড়ানোর কিট দেওয়া, খাবারগুলো সেখানকার লকবক্সে রাখা—এসব বিশাল কাজ মনে হলেও খুব দ্রুতই করা হয়েছে। একটু অভিজ্ঞ যে কেউ এটা পারবেন। পাশাপাশি আমাদের দুটি তাঁবু তৈরির কাজ শেষ। অল্প দূর পরপর এ রকম তাঁবুগুলোতে আছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে আসা পর্যটকেরা। এখানে প্রায় কেউ কাউকে চেনে না, কিন্তু একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বিনয়ী আর প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। ক্যাম্পিংয়ের জায়গা থেকে বেরিয়ে এখন ঘোরাঘুরির পালা।
পাহাড়ে পথ চলতে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় চোখে পড়ে প্রচুর পর্যটক। হাজারো পর্যটকের ভিড়ে সুবিস্তীর্ণ এই নীরব পাহাড়ি অঞ্চল যেন কিছুটা প্রাণ পায়। আর কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে আমরা পর্যটকেরা এখানে এসেছি পাহাড়ের নীরবতা, বিশালতা আর এর সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করতে। প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য মনকে এতটাই আন্দোলিত করে, যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে পাখিদের মতো আমাদেরও উড়তে ইচ্ছা হয়। সারা দিন বনজঙ্গলে, পাহাড় বেয়ে ওঠানামা করলাম। ঝরনা দেখলাম। ভয়ংকর আঁকাবাঁকা অমসৃণ পাহাড়ি পথে ওঠানামায় বুক কাঁপে, অন্যদিকে আনন্দে শিহরিতও হই। প্রকৃতি, তুমি এতই সুন্দর! সূর্য ডোবার সময় হলে ফিরে আসি তাঁবুতে। তাঁবুতে সন্ধ্যায় চিকেন বারবিকিউ তৈরি করি। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করে আকাশে তারা গণনার ব্যর্থ চেষ্টা করি। তবে আকাশে মিল্কিওয়ে সঠিকভাবে দেখতে পাই। তারপর গভীর রাতে পশুপাখির ভিন্ন ভিন্ন ডাকের নানা রকম শব্দের ভয়ানক পরিবেশে তাঁবুতে আধো আধো ঘুমের চেষ্টা করি। পরদিন প্রায় একইভাবে উচ্ছ্বাসে ভরা সময়গুলোকে আনন্দে কাটিয়েছি। পাহাড়ে ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত হয়ে চূড়ার কোথাও বসি এবং আকাশ, পাহাড়, মেঘ, প্রখর সূর্য, বন আর অপরূপ প্রকৃতিকে দেখি। শখের, উচ্ছ্বাসের, মহা আনন্দের এই ক্যাম্পিং শেষে এই তো কেবলই ফিরে এলাম। শেনানদহ পাহাড় থেকে ফিরেই প্রিয় প্রথম আলোয় এই লেখা লিখছি।
৬.
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া প্রদেশের শেনানদাহ পার্ক, পাহাড়, পর্বত ও ঝরনা দেখা, পাহাড়ের চূড়ায় ক্যাম্পিং করা, তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন—এসব নিঃসন্দেহে দারুণ মজার এক অভিজ্ঞতা। এসব পাহাড়ি মধুর অভিজ্ঞতা নিতে সেখানে যেতে বেশ ভয়ংকর আঁকাবাঁকা দীর্ঘ পথে ড্রাইভিং করতে হয়। তবে পথটা ভয়ংকর হলেও ড্রাইভিং কঠিন নয়। আর গতিসীমা মেনে গাড়ি চালানোটা নিরাপত্তার জন্য আবশ্যিক। পাহাড়ের গা বেয়ে হাঁটাপথে ওঠানামায় হাতে একটা উপযুক্ত লাঠি বেশ সহায়ক। হাঁটার সময় দুই পায়ের চলাতে লাঠি আরেকটা পায়ের মতো শরীরের ওজনকে এগিয়ে নিতে ও শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে। বন্য প্রাণীর হঠাৎ কোনো অপ্রত্যাশিত আক্রমণ থেকে বাঁচতেও এই লাঠি খুব সহায়ক। সর্বোপরি এসব পাহাড়ি পথের হাঁটাচলায় গ্রুপ বা দল আকারে একসঙ্গে কয়েকজন সদস্য থাকাটা নিরাপত্তার জন্য উত্তম। আর এটা অনেক আনন্দেরও হয়। ধরাবাঁধা নিয়মের দৈনন্দিন শৃঙ্খলিত জীবনে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা ও আনন্দ বাড়াতে ক্যাম্পিং, হাইকিং ও ভ্রমণ অতুলনীয়।