কোরিয়ান লাঞ্চ এডুকেশন, আমরা কোথায়
ইউনিক স্কুলিং সিস্টেম নিয়ে বরাবরই আমার আগ্রহ ছিল। সে আগ্রহে উচ্ছ্বাস যোগ হলো যখন দক্ষিণ কোরিয়ায় পা রাখার পরের মাসেই একটা ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল অর্গানাইজেশনের হয়ে স্কুলশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। সংস্থার হয়ে মাস দুয়েকের প্রজেক্ট নিয়ে বিভিন্ন শহরের স্কুলে ক্লাস নিয়েছি, যা পাঁচ বছরের চাকরিজীবনে পাঁচ শতাধিক হবে।
সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশে যখন বাচ্চাদের ক্লাস নিতে গেলাম, তখন দেখলাম, প্রতিদিন আমিও তাদের অভিনব আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি নিয়ে শিখছি। তার মধ্যে অন্যতম ছিল কোরিয়ান স্কুলগুলোর লাঞ্চ সিস্টেম। ছাত্র–শিক্ষক সবার লাঞ্চের ব্যবস্থা স্কুলগুলোতেই করা হতো। স্কুলভেদে শিক্ষকদের খাবারের ব্যবস্থা কখনো বাচ্চাদের সঙ্গে ক্লাসে, কখনো ডাইনিংয়ে বা অফিস রুমে করা হতো, কিন্তু সব জায়গাতেই সবাই নিয়মে পরিপক্ব। আমার জন্য স্বচক্ষে কোরিয়ান বাচ্চাদের লাঞ্চের প্রক্রিয়া দেখা ছিল এক অবিস্মরণীয় এবং অবাক করা ব্যাপার।
কেন অবাক করা এবং অবিস্মরণীয় শব্দদ্বয় ব্যবহার করছি, এবার সে ব্যাখ্যায় যাই। আমাদের দেশ তথা পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের বাচ্চারা খাওয়ার সময় এবং নিয়ম মেনে খায় না, নিজের হাতে খাবার সামলে খেতে পারে না। এমনকি আমাদের বাবা-মায়েরা অনেকেই জানেনও না হয়তো যে বাচ্চারা নিজ হাতে খেতে সক্ষম। আমি অনেক বড় হওয়ার পরও মা-খালা এবং প্রতিবেশীদের কাছে আমার গল্প শুনেছি যে তাদের দেখা এই আমি এক বাচ্চা ছিলাম, যে নিজের খাবার নিজে খেতে পছন্দ করতাম এবং টেবিলও পরিষ্কার রেখে খেতাম। অবশ্যই এতে মায়ের ভূমিকা থাকে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর কোরিয়ায় আমি দুই বছরের বাচ্চাকেও নিজ হাতে নিয়মিত খেতে দেখেছি।
আমরা অনেকেই জাপান ও কোরিয়ার ইউনিক স্কুলিং সিস্টেম সম্পর্কে জানি, যেখানে শুধু স্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা হয় না, প্রতিটি খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে প্রত্যেক বাচ্চাকে শিক্ষা দেওয়া হয় অভিনব সব উপায় অবলম্বন করে, যাতে তারা আগ্রহের সঙ্গে সব খাবারের স্বাস্থ্যকর উপকারিতা সম্পর্কে জানে এবং মেনে চলে। এ ছাড়া স্কুলে প্রতিটি শিশু নিজের খাবার নিজে শ্রেণিশিক্ষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিজস্ব বিশেষ এক ট্রে–টাইপ পাত্রে (যে পাত্রে ভাত, সবজি, স্যুপসহ চামচ ও চপস্টিক রাখার নির্দিষ্ট জায়গা থাকে) এবং খাবার সংগ্রহের সময় কোরিয়ান ভাষায় শিক্ষককে ধন্যবাদসহ ‘মজা করে খাব’ বলে আসতে ভুল করে না কখনো। ঠিক সেভাবে খাবার শেষ হওয়ার পর নিজের খাবার জায়গা নিজেরাই পরিষ্কার করে চেয়ারটা ঠিক জায়গায় রেখে খাবার পাত্র ফেরত দেওয়ার সময় ধন্যবাদ দিয়ে ‘মজা করে খেয়েছি’ বলাটাও ওদের নিত্যদিনের আচরণ।
লাঞ্চের প্রক্রিয়ায় অনেকগুলো স্টেপ বা পদক্ষেপ থেকে থাকে, যার সব কটিই বাচ্চারা খুব আনন্দের সঙ্গে পালন করে। সব স্কুলের নিয়ম একই ধরনের হয়ে থাকলেও গির্জার স্কুলগুলো একটা স্টেপ প্রথমে যোগ করে, যেমন খাওয়ার আগে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাতজোড় করে প্রার্থনা করা।
তা ছাড়া স্কুলগুলোর আয়তন অনুযায়ী ছাত্র-শিক্ষকের হাতে করা হয় স্কুল ফার্ম বা খামার। সেসব খামারে তারা ফসলের গাছের পাশে নিজেদের নামের ছোট্ট নেমপ্লেট পুঁতে রাখে। উৎপাদিত ফল সবাই মাকে উপহার দিতে বাড়ি নিয়ে যায়। ছোট্ট ছোট্ট কৃষকের হাতে উৎপাদিত অসাধারণ ফসল উপহার পাওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল।
কোরিয়ার স্কুলগুলোয় খাবার শুধু স্বাস্থ্যকর হয় না, খেতেও অনেক সুস্বাদু হয়। তাতে থাকে ফল, প্রচুর সবজি, তফু, পরিমিত মাছ ও মাংস এবং এগুলোর মিশ্রণের হালকা তরকারি বা স্যুপ সঙ্গে থাকে, অল্প স্টিকি ভাত ও নুডলস। খাবার আমাদের সবার জীবনযাপনে যেমন অপরিহার্য গুরুত্ব বহন করে, তেমনি সে অভ্যাস বা নিয়ম ছোট বয়স থেকে আয়ত্ত করা গেলে তো কথাই নেই।
*লেখক: তাহ্ নিয়া কাদের, আটলান্টা, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র