আমার শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

১৯৯৪ সালে ইংরেজি বিভাগের বার্ষিক বনভোজনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে লেখকসহ অন্য শিক্ষার্থীরা
ছবি: আসিফ রহমানের সৌজন্য

খবরটা পেয়েই থমকে গেলাম—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আমাদের এসএমআই স্যার আর নেই। সংবাদের সঙ্গে চিরচেনা তাঁর একটা ছবি। ওই  ছবির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম; ছবিটা বড্ড জীবন্ত, মনে হয় এই বুঝি নড়ে উঠবেন স্যার। এই অবস্থায় কী করে মানি যে তিনি আর নেই! মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল; স্যারের সঙ্গে কত স্মৃতি, এদিক-সেদিক ঘুরপাক খেতে থাকল। ভাবলাম, স্যারকে নিয়ে কিছু একটা লিখি; পরক্ষণেই দেখি কত গুণীজন তাঁকে নিয়ে লিখছেন, কত স্মৃতিচারণা, কত শ্রদ্ধাঞ্জলি। ভাবলাম, আমি আর কীই–বা লিখব, কিন্তু দিন দিন মনটাকে আর দমাতে পারলাম না।

ঢাকা ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে আমরা তাঁর ছাত্র; তিনি ক্লাসে কেবল পাঠ্যবই পড়াতেন না, আমাদের মনটাও পড়তেন। ভাবা যায়, এত বড় মাপের একজন মানুষ, কী অবলীলায় আমাদের মতো সাধারণ ছাত্রদের কাছে টেনে নিতেন; আপন করে নিতেন। তাঁর ক্লাসের জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম; জানতাম, তিনি শুধু সিলেবাসে আটকে থাকবেন না, জীবনকে দেখার নতুন একটা চোখ খুলে দেবেন।

আমার টিউটোরিয়াল শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার। একদিন স্যারের রুমের বাইরে দেখি মনজুর স্যার দাঁড়িয়ে, একেবারে বিনয়ের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন; ঠিক যেমন একজন ছাত্র তার শিক্ষকের জন্য অপেক্ষা করে। পরে জেনেছিলাম, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার ছিলেন তাঁরও শিক্ষক। ওই দৃশ্যটা ভুলি না, দেশবরেণ্য পণ্ডিত অথচ নিজের শিক্ষকের সামনে কী ভীষণ নত, কী শ্রদ্ধাশীল! সেদিনই বুঝেছিলাম তিনি আসলে আজীবন একজন ছাত্রই থেকে গেছেন; আর সে কারণেই হয়তো আমাদের মতো হাজারো ছাত্রের সত্যিকারের শিক্ষক হতে পেরেছিলেন। পরে আমিও স্যারের টিউটোরিয়াল গ্রুপে ছিলাম, তখনই তাঁকে আরেকটু কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়।

ক্লাসের বাইরে এসএমআই স্যার ছিলেন আরও বড় বিস্ময়, একাধারে কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, শিল্প সমালোচক কিন্তু তাঁর মূল পরিচয় তিনি একজন হৃদয়বান শিক্ষক।

স্যারের কথা মনে হলেই আমার ছোট্ট শহর, জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের কথা মনে পড়ে। আমার মতো এক সাধারণ ছাত্রের অনুরোধে তিনি একবার নয়, তিন-তিনবার আমাদের ওই ছোট শহরে গিয়েছিলেন। তাঁর মতো একজন কিংবদন্তি মানুষ যখন কুলিয়ারচরের স্কুল-কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে যান, তখন গর্বে আমাদের বুকটা ভরে উঠত। তিনি শুধু আমাদের শিক্ষক ছিলেন না, আমাদের শিকড়টাকেও ভালোবেসেছিলেন। মাস্টার্সে নীরদ সি চৌধুরীর ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অব অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’ পড়তাম; তাঁর পৈতৃক ভিটা ছিল আমাদের কুলিয়ারচরের পাশের উপজেলা কটিয়াদীর বনগ্রামে। একবার স্যারকে নিয়ে সেখানেও গেলাম। স্যারের সেই অনুসন্ধিৎসু চোখ আমি ভুলব না। সেখান থেকে ফিরে ‘জনকণ্ঠ’-এর এক বিশেষ সংখ্যায় স্যারের লেখা পড়ে বুঝেছিলাম আমরা কী দেখি আর স্যার কী দেখেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারকে লেখকের বইয়ের উৎসর্গকৃত পাতার ছবি
ছবি: লেখকের পাঠানো

স্যার যে দেশ-বিদেশ কত কিছু নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত, এটা তো মোটামুটি সবারই জানা। তারপরও আমাদের এই ছোট ছোট অনুরোধগুলো কী ভীষণ গুরুত্ব দিয়েই না রাখতেন। সানী জুবায়ের, আমরা ওকে সৌরভ ডাকি। ওর গজল-গান স্যারের খুব পছন্দের। আমি একবার ঢাকায় আমার মামার বাসায় সৌরভের ঘরোয়া গানের একটা আয়োজন করলাম আর স্যারকে করলাম আমন্ত্রণ। স্যার তো এককথায় রাজি, শুধু তা–ই না, সঙ্গে তাঁর বন্ধু—তখনকার বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক মেনুকা আন্টি, তাঁকেও দাওয়াত দেওয়ালেন।

কিন্তু এরপরই লাগল প্যাঁচ। যত দূর মনে পড়ে, ঠিক ওই তারিখেই ভারতের অভিনেত্রী শাবানা আজমি বাংলাদেশে এসেছেন একটা চ্যারিটি অনুষ্ঠানে, আর সেখানে স্যারের উপস্থিতিও খুব জরুরি। আমি তো ধরেই নিয়েছি স্যার আর আসবেন না। কিন্তু না, স্যার এলেন; সেই অসম্ভব টাইট শিডিউলের মধ্যেও ঠিকই এসে হাজির, থাকলেনও অনেকক্ষণ।

স্যার এত ব্যস্ততার মাঝেও ব্যক্তিগত বিষয়ও খবর রাখতেন। পড়াশোনা শেষ করে যখন দিশাহারা, স্যার একদিন একুশে টেলিভিশনের তখনকার বার্তাপ্রধান আবেদ খানের কাছে একটা চিরকুট দিয়ে বনানীর অফিসে পাঠালেন আমাকে। তাতে লেখা, ‘আবেদ ভাই, আমার ছাত্র কাউসারকে পাঠালাম। ওকে একটা কাজের সুযোগ করে দেবেন এবং আশা করি একদিন আপনি আমাকে ধন্যবাদও দেবেন।’ কাজের সুযোগও দিয়েছিলেন, যদিও তারপর অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসার কারণে কাজ করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু স্যারের ওই একটা বাক্যই ছিল আমার সবচেয়ে বড় সুপারিশ, আমার আত্মবিশ্বাস।

১৯৯৫ সাল। ছোট শহর কুলিয়ারচর ভ্রমণের সময়ের ছবি। ছবিতে ডান থেকে ইংরেজি বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শিক্ষার্থী তমাল, কাউসার খান, আজাদ, রকিব চৌধুরী, শিল্পী লাকী আখান্দ্, শিল্পী সানী জুবায়ের, অধ্যাপক ফকরুল আলম, শিক্ষার্থী আসিফ রহমান ও সায়মা ইসলাম
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এর কিছুদিন পর আমার কাঁচা হাতে লেখা একটা উপন্যাস বেরোচ্ছে; উৎসর্গ করলাম প্রিয় শিক্ষকদের, স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত। স্যারের নামও ছিল; কিন্তু বইটা দেখানোর সাহস পাইনি বহু বছর। স্যার কীভাবে যেন জেনে গিয়েছিলেন, এখন আর মনে নেই। একদিন হঠাৎ ভয় পাইয়ে দিলেন, ‘অ্যাই, অনুমতি ছাড়া বই উৎসর্গ করেছো কেন!’ তারপরই বললেন, ‘বইটা দিয়ো তো, শুনেছি ভালো লিখেছো।’ কিন্তু ওই কাঁচা লেখা স্যারকে দেখানোর সাহস আমার কোনো দিনই হয়নি। যদিও স্যার এরপরও অনেকবার বলেছেন।

স্যারের সঙ্গে শেষ দেখাটা হয় মেঘের রাজ্যে মাঝআকাশে। স্যার যাচ্ছিলেন সিঙ্গাপুর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য; আমি ফিরছি সিডনিতে। একই ফ্লাইটে দেখা। কত কথার ভিড়েও স্যার ঠিকই জানতে চাইলেন, ‘তোমার কুলিয়ারচর কেমন আছে?’ তখন কি আর জানতাম, মেঘের রাজ্যে স্যারের সঙ্গে ওই কথাগুলোই হবে শেষ স্মৃতি, শেষ কথা!

ওপারে ভালো থাকবেন, আমাদের প্রিয় এসএমআই স্যার।

লেখক: কাউসার খান, প্রথম আলোর সিডনি প্রতিনিধি ও অভিবাসন আইনজীবী

ই–মেইল: [email protected]