আমার বাবা ভালো মানুষ, ভালো পিতা কি

তখন সবে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছি। হঠাৎ দেখি বাবা জাপান যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষার্থে। এই এক বছরের বেশি সময় বেশ দুরন্তপনায় কাটল দাদাবাড়ি–নানাবাড়ি মিলিয়ে। ডাংগুলি খেলা, বিলে মাছ ধরতে যাওয়া, পাখি শিকার, অন্যের গাছের পাকা আম ঢিল দিয়ে পাড়া, লিচু চুরি—কী না করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। তখন দেশে এরশাদের সামরিক শাসন কেবল শুরু হয়েছে। বাবাও জাপান থেকে ফিরেই সামরিক শাসন জারি করলেন পরিবারে! বাবা যেন জেনারেল, আর আমি ও আমার ছোট ভাই সোলজার। বাবার স্পষ্ট কথা, ‘আমি না থাকাতে তুমি পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি মিস করেছ। অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি তোমাকে পেতেই হবে।’ দ্রুতই স্বাধীন জীবনটা পরাধীন হয়ে গেল। স্কুল আর বাসার ভেতরেই জগৎ সীমিত হয়ে গেল। বাবা সর্বশক্তি দিয়ে নিজেই আমাকে সব বিষয় পড়াতেন। একদিন স্কুল থেকে খবর এল বৃত্তি পেয়েছি। বাবার চোখে–মুখে পরিপূর্ণ তৃপ্তির হাসি এবং অশ্রু। এই প্রথম বাবা আমাকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে শুরু করলেন।

উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক, রচনা প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি—সবকিছুরই হাতেখড়ি বাবার কাছে। উপজেলা পর্যায় থেকে জেলা, বিভাগ, এমনকি জাতীয় পর্যায়েও বিজয়ী হলাম উপস্থিত বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আন্তবিশ্ববিদ্যালয় করে একদিন অস্ট্রেলেশিয়া-এশিয়ান ডিবেটও করে ফেললাম দেশের বাইরে। তত দিনে এসএসসি, এইচএসসি, বিশ্ববিদ্যালয় করে সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। মনে পড়ে, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই বাবা ছোট্ট ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় বিতর্কের বাচনভঙ্গি শিখিয়ে দিতেন, কবিতায় কণ্ঠের ওঠানামা ধরিয়ে দিতেন।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করে কর্মজীবন শুরু করি সরকারি একটি সাধারণ এবং পরে একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে। বাবার চাওয়াও ছিল তা–ই। বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘তোমার যা (ঠোঁটকাটা) স্বভাব, তাতে অন্য কোনো চাকরি করতে পারবা না। বেসরকারি চাকরি হলে প্রতিদিন নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। সরকারি চাকরি হলে প্রতি মাসেই হয়তো ট্রান্সফার অর্ডার পাবে।’ আসলে বাবা যেন আমার ভেতরে নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখছিলেন। বাবা প্রতিনিয়ত বদলির শিকার হতেন ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে। আজকের কৌশলী কর্মকর্তাদের মতো পেশাদারির দোহাই দিয়ে বাবা কখনোই ঊর্ধ্বতনের অন্যায্য সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। কখনো কখনো বাবার এই একরোখা অভ্যাসের জন্য ঘন ঘন বদলি আমাদের পীড়া দিত। আমরা বাবার প্রতি রাগান্বিত হতাম। কারণ, বাবার বদলি মানে আমাদেরও নতুন স্থানে নতুন বন্ধু খোঁজা। মাঝেমধ্যে রাগ হতো বাবার সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সন্তানদের শান–শওকতের কাছে আমাদের মলিন অবস্থার জন্য। সময়ের সঙ্গে আমাদের এই মলিন অবস্থা যেন শেষ হওয়ার নয়।

ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়া অবস্থায় আমার বাবা তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। অর্থাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হয়নি। প্রথম জীবনে হয়েছিলেন সরকারি পলিটেকনিক্যালের শিক্ষক। বাবা তাঁর অপূর্ণতাকে ঢেকে দিতে চাইতেন আমার আর আমার ছোট ভাইয়ের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন বিদেশ থেকে এমএসসি, পিএইচডি করি। কিন্তু তাঁর আর্থিক সংগতি ছিল না। তবে উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রায়ই বলতেন, ‘তোমার দাদারা আরবে গেছেন (হজ করতে), আমি গেছি জাপান, তোমাদের কত দূর যাওয়া উচিত?’ বাবা তাঁর ৫২তম জন্মদিনে হঠাৎ মারা গেলেন। অবাক করা ব্যাপার হলো, ঠিক এক মাস পরেই জার্মান সরকারের পূর্ণ বৃত্তির অফার পেলাম এমএসসি করার জন্য। একদিন বিমানে চেপে বসলাম জার্মানির উদ্দেশে। একদিকে আনন্দ আর অন্যদিকে বিষাদ—বাবা এ মুহূর্ত দেখে যেতে পারলেন না অল্প কিছুদিনের জন্য। আরও কয়েক বছর পর বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিও হলো।

বাবার শূন্যতা আজও, প্রায় ২৫ বছর পরও তীব্রভাবে অনুভব করি। বাবা আবদুল জব্বার ছিলেন কঠিন-কোমলে মেশানো প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। রোজার একদিনের কথা মনে পড়ে, আমার মা কলা কিনতে পাঠিয়েছিলেন বয়স্ক পিয়ন সোবাহানকে। সোবাহানকে আমরা চাচা বলে ডাকতাম। সোবাহান চাচা কলা কিনে ফিরে এলেন। মা কলার ছোট সাইজ দেখে সোবাহানকে আচ্ছা ঝাড়ি দিলেন।

সোবাহান চাচা চলে যাওয়ার পর বাবা মাকে ডেকে বললেন, ‘ও যে বেতন পায়, তাতে ওই (ছোট) কলা কিনতেই সে অভ্যস্ত; তোমার বড় কলার প্রয়োজনের বিষয়টি তাকে আগেই পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল; আর তোমার ওকে বকা দেওয়াটা ঠিক হয়নি।’

আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। বক্তৃতা-বিতর্কের চর্চার জন্য বাবার ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরি থেকে প্রায়ই বই ধার করে এনে দিতেন। পড়া শেষে ফেরত দিয়ে আসতাম। কিন্তু ‘বাণী চিরন্তনী’ ও ‘শত মনীষীর কথা’ বই দুটি বারবার প্রয়োজন হয় বিধায় ঠিক সময়ে ফেরত দিইনি। পরে যখন ফেরত দেব, তখন আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরিয়ান বাবাকে বললেন, নষ্ট হয়ে যাওয়া বইয়ের তালিকায় দেখিয়ে দিই। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, বাবা শুধু বললেন ‘না’। বাবা বই দুটি ঢাকায় অনেক খোঁজাখুঁজি করে কিনে পরে জমা দিয়েছিলেন। এরপর আর আমি কখনোই কোনো বই হারাইনি। আরেক দিনের কথা বলি। বাবা তখন ময়মনসিংহের গৌরীপুরে ভিটিআইয়ের (সরকারি টেকনিক্যাল কলেজ) অধ্যক্ষ। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রার্থীর (যিনি পরে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন) সাঙ্গোপাঙ্গরা কেন্দ্র দখল করে নিলে বাবা ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেন। প্রশাসনের বিলম্বিত হস্তক্ষেপে উদ্ধার হওয়ার আগপর্যন্ত দীর্ঘ সময় অনিশ্চিত ঘেরাওয়ের মধ্যে থাকলেও ভীত হয়ে নত হননি বা শক্তির কাছে মাথা বিকিয়েও দেননি। পরে অবশ্য সন্তানদের (আমাদের তিন ভাই-বোনের) জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনবরত হুমকির মুখে কর্মস্থল পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।

এই অর্ধশতাব্দীর জীবন পেরিয়ে আজও আমি ভাবি, বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু ভালো পিতা কি ছিলেন? বাবার সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবের অনেকেই ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে যেকোনোভাবেই হোক অনেক টাকা ও সম্পদ রেখে গেছেন তাঁদের সন্তানদের জন্য। তাঁদের সন্তানেরা সেটা দিয়ে দিব্যি আয়েশি জীবন যাপন করছে। সেই সন্তানদের কাছে তাদের পিতা যদি ভালো পিতা হয়, তবে আমার পিতাকে ভালো মানুষ হিসেবে মানলেও ভালো পিতা বলি কী করে? ভয় হয়, আমি নিজেও কি অজান্তেই আমার পিতার মতোই হয়ে যাচ্ছি? আমার সন্তানেরাও হয়তো কোনো এক দিন বলবে,‘বাবা, তুমি ভালো মানুষ ছিলে, ভালো পিতা নও।’ তারপরও আমি বলব, বাবা, তোমার শিক্ষাতেই আমি মাথা উঁচু করে চলি সব সময়। বাবা, তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।

অধ্যাপক মোস্তফা সারোয়ার, নিউ জার্সি, যুক্তরাষ্ট্র

* দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]