জওয়ান–এ কি দেখলাম

`জওয়ান’–এ এই অবতারেই হাজির হবেন শাহরুখ
ছবি: টুইটার

জীবনে প্রথমবারের মতো সিনেমা হলে আমি কোনো হিন্দি মুভি দেখলাম! জি সত্য। যাওয়ার আগে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলাম ইংরেজি সাবটাইটেল থাকার বিষয়টা, আমার হিন্দির দৌড় খুবই খারাপ। কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া হুট করেই কয়েকজন মিলে ‘জওয়ান’ দেখতে রওনা হলাম। মনে হলো জীবনে কখনো না করা কিছু কাজ টিক দেওয়ার সময় এসেছে, কবে জানি ওপরওয়ালার ডাক এসে পড়ে, কেউ তো জানি না।

সিনেমা যে আমি মাঝেমধ্যে দেখি না, তা কিন্তু না, তবে সেগুলো বাংলা নয়তো ইংরেজি, হিন্দি সিনেমা দেখা হয় না। গত ২০ বছরে সর্বসাকুল্যে দশটা হিন্দি ছবিও দেখিনি। যে কয়টা দেখেছি, অনেক আগে, তার মধ্যে চার-পাঁচটাই শাহরুখ খানের আর বাকি দু–তিনটা আমির খানের। এ দুজন ছাড়া অন্য কারও হিন্দি ছবি আমার পক্ষে দুই ঘণ্টা বা তারও অধিক সময় ধরে বসে দেখা সম্ভব না, দুঃখিত। সময় মূল্যবান, সুতরাং একথা অনস্বীকার্য যে শাহরুখ খান (SRK) নায়ক বলেই মুভিটা দেখতে যাওয়া। সেই যে DDLG দেখে মুগ্ধ তাঁর অভিনয়ে নাকি মায়াময় চাহনির জাদুতে, ঠিক জানি না। তবে সে যাই হোক, আজকালকার ভাষায় যাকে ‘ক্রাশ’ বলে, তা থেকে আমি বা আমরা (তিন দশকের নারীরা) কেউই বের হতে পারিনি। এক অদ্ভুত মায়া তাঁর চোখে আর জাদুকরী অভিনয়ের ক্ষমতা।
আচ্ছা, অনেক হয়েছে শিবের গীত, এখন ধান ভানতে হবে।

‘জওয়ান’ কেমন লাগল?

এককথায় উত্তর দিলে বলতে হবে ভালো লেগেছে, সময় নষ্ট হয়নি, তিন ঘণ্টা যেন উড়ে গেল।

ভাব সম্প্রসারণ করতে গেলে মেলা কথা লিখা লাগবে, জানি না কারও পড়ার ধৈর্য আছে কি না! অনেকবছর পর নিয়মনীতি মেনে রচনা লিখতে বসলাম।

তার আগে বলুন, সিনেমা আমরা কেন দেখি বা দেখতে যাই?

নিত্যদিনের ব্যস্ততায় ক্লান্ত মগজকে ছুটির দিনে চাঙ্গা বা বিনোদিত করতে যেন সপ্তাহ শুরুর প্রাক্কালে মন হালকা থাকে, মোদ্দা কথা বিনোদিত হতে।

সুতরাং সিনেমা দেখতে গিয়ে যাঁরা শিক্ষা খোঁজেন, তাঁরা সিনেমা হলে না গিয়ে লাইব্রেরিতে যাবেন প্লিজ, অনেক শিক্ষামূলক বই, ডকুমেন্টরি আছে সেখানে, শিক্ষা আর শিক্ষা, পুরোটাই জ্ঞানের ঘুমন্ত সাগর, আপনি গিয়ে তাঁদের জাগিয়ে তুলবেন।

এবার আসি ‘জওয়ান’–এর অনুভূতি বিস্তারে...

প্রথমেই বলি ‘জওয়ান’ শব্দের অর্থ সৈনিক, মনে মনে যা ভেবেছেন, তা নয় কিন্তু। আমার মতে বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে জওয়ান পুরোপুরি সফল কারণ জওয়ান দর্শককে পুরোপুরি বিনোদিত করতে পেরেছে। রাতে শুরু হওয়া সিনেমা যখন মধ্যরাতে শেষ হলো, মনে হলো আর একটু দেখালেও পারতো! ঠিক যেমন হাতে থাকা কোক জিরো শেষ কিন্তু পপকর্ন তখনো শেষ হয়নি, তেমন।

পুরো সিনেমা জুড়ে অ্যাকশন, সংলাপ, দেশপ্রেম, টান টান উত্তেজনা, রোমান্স, কমেডি, দুঃখ, কষ্ট, দুর্দান্ত চিত্রায়ন, দৃশ্যায়ন, সাউন্ড এফেক্ট, অভিনয়—সব কিছুই বেশ ভালো ছিল। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে অনেক উন্নতি করেছে, আগের মতো ঢিসুম ধাসুম না। তবে সবচেয়ে ভালো ছিল সিনেমার বিষয়বস্তু ও সংলাপ এবং শিল্পী নির্বাচন। দক্ষিণের বিখ্যাত পরিচালক এটলি কুমার যাঁকে যে চরিত্রে দরকার, ঠিক তাঁকেই নিয়েছেন এবং প্রত্যেককেই যাঁর যাঁর চরিত্র অনুযায়ী তাঁর সেরা কাজটাই করেছেন, এটাই একজন যোগ্য পরিচালকের মুনশিয়ানা।

শাহরুখ খান ও দীপিকা পাড়ুকোন
এএফপি

কিং খান দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন দুটো চরিত্রেই (বাবা বিক্রম এবং ছেলে আজাদ) যদিও আজাদ চরিত্রে মাঝেমধ্যে তাঁকে চোয়ালভাঙা পৌঢ় (মেঘে মেঘে বেলা তো কম হলো না) মনে হয়েছে, স্মার্ট সুন্দরী নায়িকা নয়নতারার পাশে কিন্তু তাঁর জাদুকরি অভিনয় নৈপুণ্য আর চাহনি দিয়ে সেই ঘাটতি তিনি পুষিয়ে দিয়েছেন। চরিত্রের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন গেটআপে বরং ভালো লেগেছে আজাদ তথা কিং খানকে। কিন্তু বিক্রম চরিত্রে তিনি অনবদ্য কাজ করেছেন, এখানেই শাহরুখ খান বাজিমাত করেছেন। সারা জীবন রোমান্টিক চরিত্রে মানানসই শাহরুখ অ্যাকশন নায়ক হিসেবে ভালোভাবেই উতরে গেছেন সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেক দক্ষ অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন। দীপিকা পাড়ুকোন আমার খুবই পছন্দের অভিনেত্রী, এতো সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, সুন্দর হাসি এবং সু–অভিনেত্রী খুব কমই আছে ইন্ডিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। পুরো সিনেমাকেই অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে দীপিকার অসাধারণ অভিনয়। ছোট্ট আজাদের কাছে থেকে বিদায় মুহূর্ত চোখে জল এসে গিয়েছিল, হয়তো নিজে মা বলে সেই অনুভূতিতে একাত্ম হতে পেরেছিলাম। এটাই একজন সুনিপুণ অভিনেত্রীর কারিশমা, চরিত্রে ঢুকে যাওয়া। এই যে জাওয়ান নিয়ে এত হই চই, এর পেছনে দীপিকার সু–অভিনয়, শাহরুখ-দীপিকার রসায়ন চমকপ্রদ ভূমিকা রেখেছে। অবশ্যই আজাদের নায়িকা নয়নতারাকেও খুবই মানানসই লেগেছে ‘জাওয়ান’–এ। দক্ষিণের এ সুপারষ্টার তামিল অভিনেত্রী আধুনিক গেটআপ ও অভিনয় দিয়ে নজর কেড়েছেন। দক্ষিণে ট্র্যাডিশনাল আশিটি সিনেমায় অভিনয় করা এ সুশ্রী সুপারস্টারের বলিউড ভবিষৎ খুবই উজ্জ্বল, কারণ, তাঁর সুন্দর চেহারা, কঠিন চাহনির পাশাপাশি ভালো অভিনয় দক্ষতা আছে।

এরপর বাকি থাকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করা আজাদের গ্যাংয়ের ছয়টি মেয়ে ও ভিলেন চরিত্র বিজয় সেতুপাতি, যাঁরা সবাই খুবই ভালো এবং মানানসই অভিনয় করেছেন যার যার চরিত্রে। খুবই অল্প ব্যাপ্তির চরিত্রে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও ভালো অভিনয় করেছেন, যেমন সঞ্জয় দত্ত! পাঁচ-সাত মিনিট ছিলেন পর্দায় কিন্তু তিনি অভিনয় করেছেন তার মতো করেই। আরও অনেকেই ছিলেন স্বল্প সময়ে দারুণ কিন্তু আমি সবার নাম জানি না।

একটি পূর্ণাঙ্গ সিনেমা একটা টিম ওয়ার্ক। পুরো সিনেমা তখনই মানুষের হৃদয় জয় করে যখন পুরো টিমের সবাই সঠিকভাবে কাজ করেন। ‘জাওয়ান’ সিনেমায় ঠিক সেটাই ঘটেছে। অভিনয়শিল্পীরা শুধু দেখতে ভালো ছিলেন না, অভিনয়েও দক্ষ ছিলেন, পাশাপাশি ভালো কাহিনি ও সংলাপ এবং একজন অভিজ্ঞ পরিচালক ছিলেন। বাণিজ্যিক সিনেমা জমাতে যে ধরনের জেলেটিন লাগে, জনপ্রিয় তামিল পরিচালক এটলি কুমার তার সব কিছুই নিয়ে এসেছেন জাওয়ানে। দেশপ্রেম, ঘুমন্ত জনগণকে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অভিনব উপায়, দ্বৈত চরিত্র, দুর্দান্ত অ্যাকশন, যেখানে সবাই মরে কিন্তু নায়ক নায়িকার কিছু হয় না, পারিবারিক করুন ট্র্যাজেডি, মাথায় বাড়ি খেয়ে সব ভুলে যাওয়ার বহু বছর পর আরেক বাড়ি খেয়ে মনে আসা, পরিশেষে প্রতিশোধ এবং সত্যের জয় ইত্যাদি সবই ছিলো শুধু ডাক্তার যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলা নায়িকার হাতের পালস দেখে বললেন তিনি প্রেগন্যান্ট, তখন কেন জানি অভিনেত্রী শাবানার চেহারা মনে এল! এ একটা সংলাপ সত্তরের দশকের ছিল, যেটা চাইলেই ভিন্নভাবে করা যেত।

এখন আসি সমালোচনায় বা ভুল ধরার চেষ্টায়, যেটাতে আমরা বিশেষ পারদর্শী। ব্যাক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে কাহিনি, বাজেট ও শিল্পী নিবার্চন অনুযায়ী সিনেমার গানগুলো আশানুরূপ হয়নি। একটা গানও সেভাবে মনে দাগ কাটেনি, শুধু Chaleya গানটা চলে। আজ থেকে বিশ বছর আগে যখন হিন্দি সিনেমা দেখতাম, তখন দেখেছি যে সিনেমা হিট হতো, সেই সিনেমার চার–পাঁচ বা যে কয়টা গান থাকত, সবগুলোই হিট, এমনকি এখনো সবাই সেই গানগুলো শোনে। ‘জওয়ান’ সিনেমার গানগুলো শুনে মনে হয়েছে চলে... কিন্তু মনে রবে না।

৩০০ কোটি ইন্ডিয়ান রুপি বাজেটের এই সিনেমা পৃথিবীব্যাপী ইতিমধ্যে প্রায় ৯০০ কোটি রুপি আয় করেছে, যা মূল বাজেটের ৩ গুণ এবং এই দিনই শেষ না, সামনে আরও দিন আছে। বাংলাদেশেও সিনেমাটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ভালো কথা, ভালো লেখা, ভালো গান, ভালো সিনেমা—যে ভাষারই হোক,বিশ্বব্যাপী ছড়ানো উচিত। কারণ, জীবনে সুস্থ বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমি আশাবাদী মানুষ, সবকিছুর মধ্যেই ভালো দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। ‘জওয়ান’ ছবিতে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে আজাদের গ্যাংয়ের ছয় মেয়েকে। আমি খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছি, ভাবছি এমন একটা গ্যাং গঠন করব, কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি, ছয়জন মেয়ে নেব, নাকি ছয়জন ছেলে!