ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা

৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকারছবি: প্রথম আলো

ঐতিহাসিকভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা হাজারো মাইল দূরে থেকেও প্রিয় মাতৃভূমির যেকোনো সংকটে সর্বস্ব দিয়ে সব সময় পাশে থেকেছেন বাংলাদেশের। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশে সাধারণ ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান হয়ে গেল, সে অভ্যুত্থানে হাজারো মাইল দূরে থেকেও অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা দেড় কোটিরও বেশি প্রবাসী নানাভাবে ভূমিকা রেখেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে। অনলাইন-অফলাইনে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁরাও জানিয়ে দিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে কোনো বৈষম্য, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপশাসন থাকতে পারে না। ছাত্রদের বুকে চালানো গুলির প্রতিবাদে তাঁরাও ফুঁসে উঠেছিলেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বসবাসরত প্রবাসীরা জেলজুলুমের পরিণাম জেনেও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের অনেককে কারাবরণ করতে হয়েছে।

প্রবাসে আন্দোলন যেভাবে শুরু

গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় প্রবাসীদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার প্রতিবাদ জানান। ওই দিন ভারী বৃষ্টি ছিল লন্ডনে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে গ্রিনউইচ ইউনিভার্সিটির ছাত্র আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে মাত্র চারজন তরুণ মোমবাতি জ্বালিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ জানান পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে। পরদিন ১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশের গুলি করার দৃশ্য দেখে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন প্রবাসীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে প্রবাসেও শুরু হয় আন্দোলন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থীরা ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ধারাবাহিক প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যান। বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ইউকে বাংলাদেশ প্রবাসী অধিকার পরিষদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে লন্ডনেও প্রতিদিন নানা কর্মসূচি পালন করে। তারা আলতাব আলী পার্ক, লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে, বিবিসি সদর দপ্তরের সামনে, ট্রাফালগার স্কয়ার ও পার্লামেন্ট স্কয়ারেও নিয়মিতভাবে কমপ্লিট শাটডাউন, মার্চ ফর জাস্টিস, রিমেম্বারিস দ্য হিরোজ কর্মসূচি পালন করেছে। এ ছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, স্পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাজ্যের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানান। ২২ জুলাই লন্ডনের বিখ্যাত ট্রাফালগার স্কয়ারে হাজারো প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। লন্ডনের বাইরে যুক্তরাজ্যের অন্য শহর বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, নিউক্যাসল, এডিনবরা, কার্ডিফেও বিক্ষোভ করেন বাংলাদেশিরা। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সামাজিক সংগঠন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে বিভিন্ন প্রচার চালায়।

১৭ জুলাই থেকে বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পর প্রবাসীরা বাংলাদেশে থাকা তাঁদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তখন বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়া গুজব প্রবাসীদের বিভ্রান্ত করতে থাকে। উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় থাকা প্রবাসীদের সংবাদ পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। কিন্তু সেটাও ছিল অপ্রতুল। ফলে প্রবাসীরা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন।

ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপিদের অবদান

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) আপসানা বেগম ও রূপা হক আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নির্বিচার গুলি করে হত্যা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ জানান। ব্রিটিশ সরকারের পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি রুশনারা আলী সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর নির্বাচনী এলাকার কোনো বাংলাদেশির পরিবার বা আত্মীয় সহিংসতার স্বীকার হলে তাঁকে এবং অন্যান্য এলাকার এমপিদের অবগত করার কথা বলেন। ২২ জুলাই আপসানা বেগম পার্লামেন্টে বাংলাদেশের বিষয়ে আলোচনার জন্য মোশন উত্থাপন করেন। সে মোশনে ২৮ জন এমপি সমর্থন করেন। পরে আপসানা বেগম ও রূপা হক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সহিংসতার ঘটনায় সঠিক তদন্ত ও বিচারের দাবিতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রশ্ন তোলেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ সৃষ্টি করার দাবি করেন।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়, যেখানে প্রকাশ্যে যেকোনো ধরনের সভা–সমাবেশ নিষিদ্ধ, সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশিরা ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাস্তায় বেরিয়ে বিক্ষোভ করার কারণে সেখানকার কর্তৃপক্ষ অনেক বাংলাদেশিকে আটক করে। ওই ঘটনায় আরব আমিরাতের আদালত বিভিন্ন মেয়াদে ৫৭ জন বাংলাদেশিকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেন। তাঁর মধ্যে ৫৩ জনকে ১০ বছর করে, ১ জনকে ১১ বছর ও ৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের আদালত। সৌদি আরবেও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার খবর পাওয়া গেছে। তা ছাড়া মালদ্বীপেও বাংলাদেশিদের বিক্ষোভ করার কারণে ধরপাকড়ের খবর শোনা গেছে।

ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশের বিভিন্ন শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে এবং শিক্ষার্থীদের হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন প্রবাসীরা।

পর্তুগালের লিসবনের মাতৃমনিজ পার্ক এবং পর্তুগাল বাংলাদেশ কনস্যুলেটের সামনে, ফ্রান্সের প্যারিসের রিপাবলিক চত্বরে, জার্মানির মিউনিখ, বার্লিন, বন ও ফ্রাঙ্কফুর্টে, গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে, ইতালির ভেনিস ও মিলানে, স্পেনের বার্সেলোনা ও মাদ্রিদ, জার্মানির মিউনিখ, নুরেমবার্গসহ নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতাকে হত্যার প্রতিবাদে ও শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেন প্রবাসীরা। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল, জাপানের টোকিওসহ মালদ্বীপ, সৌদি আরব, কাতার ও মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা ছাত্রদের আন্দোলনের পক্ষে সরব ছিলেন।

নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে শুরু থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে প্রায় প্রতিদিন সেখানে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে প্রবাসীরা ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদ ও শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবি জানান। মিশিগানসহ অন্য অঙ্গরাজ্যেও প্রতিবাদ জানান প্রবাসীরা।

এদিকে কানাডার টরন্টো, মন্ট্রিয়ল, ভ্যাঙ্কুভার এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার পাশে থেকে হত্যার প্রতিবাদ জানান।