ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকের বিজয় দিবস উদ্যাপন
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, এগারো দফা ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের ছাত্র গণ–অভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল অনন্য। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই প্রথম রুখে দাঁড়িয়ে বুকের রক্ত দিয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলন সংগ্রামকে স্মরণ করে ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনে ২০ ডিসেম্বর, শনিবার পূর্ব লন্ডনের স্থানীয় একটি হলে দুটি পর্বে মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা এবং বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই ইন দ্য ইউকে ৫৫তম বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছে।
সহসভাপতি রিপা সুলতানা রাকীবের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান গেয়ে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়।
সংগঠনের সভাপতি সিরাজুল বাসিত চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের আলোচনা ও স্মৃতিচারণা পর্ব সুচারুভাবে পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কামরুল হাসান। তিনি শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা চমৎকারভাবে তুলে ধরেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ৯ মাসব্যাপী চলা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে ২০ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের মৃত্যুতে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে উপস্থিত সবাই এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
মোহাম্মদ কামরুল হাসানের পরিচালনায় সাক্ষাৎকারভিত্তিক স্মৃতিচারণা ও বক্তৃতা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান গৌস সুলতান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, শাহগীর বখত ফারুক, মোহাম্মদ আবদুর রাকীব, সহুল আহমেদ মকু, নির্বাহী সদস্য প্রশান্ত লাল দত্ত পুরকায়স্থ বিইএম, মাহফুজা রহমান ও সৈয়দ আবু ইকবালের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ জাফর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহারুন আহমেদ, সহসভাপতি নিলুফা ইয়াসমীন হাসান ও সাধারণ সম্পাদক এম কিউ হাসান।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সাক্ষাৎকারে বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, মার্চ মাসের শুরুতেই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে তাঁরা লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশ গড়ার কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বলেন, যেসব শিক্ষার্থী সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করেছে, পরীক্ষা দিয়েছে, যা নিন্দনীয়। তাই মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে তাঁদের আটো প্রমোশন গ্রহণ করতে হয়েছে।
যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষাৎকারে তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের ওপর যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার বর্ণনা দেন। এতে উপস্থিত সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা হাবিব রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রবাসে বসে যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন তা তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছায়ানট ও উদীচীর ওপর আক্রমণের নিন্দা জানান।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নির্বাহী সদস্য মারুফ চৌধুরী ও সহসভাপতি মির্জা আসাব বেগ।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সাংস্কৃতিক সম্পাদক এরিনা সিদ্দিকী সুপ্রভার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শর্মিষ্ঠা পণ্ডিতের কোরিওগ্রাফিতে ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গানের সঙ্গে প্রেরণা মণ্ডলের নৃত্যের মাধ্যমে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন বিশিষ্ট শিল্পী রাশিদা বানু, তারেক সৈয়দ, সৈয়দ জুবায়ের, কেজেবি কনক, রিপা সুলতানা রাকীব, কাজী কল্পনা, নিলা নিকি খান, সাঈদা চৌধুরী ও সাঈদা তামান্না। উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে এসব উপভোগ করেন।
কবি শামসুর রাহমানের কালজয়ী কবিতা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা’ যৌথ আবৃত্তি করেন মেজবাহ উদ্দিন ইকো ও মাহমুদা চৌধুরী এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’ আবৃত্তি করেন মিজানুর রহমান।
অনুষ্ঠানে গানের শিল্পী সৈয়দ জুবায়ের ও সৈয়দ তারেককে সংগঠনের পক্ষ থেকে উত্তরীয় ও ক্রেস্ট প্রদান করেন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ ও সিনিয়র সহসভাপতি।
অনুষ্ঠান চলাকালে সংগঠনের প্রতি তাঁদের অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সংগঠনের দুজন সদস্যকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। সম্মাননাপ্রাপ্তরা ছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা দুই সংগীতশিল্পী সাঈদ জুবায়ের ও তারেক সায়েদ।
সংগঠনের সভাপতি সিরাজুল বাসিত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল হাসান এবং কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ জাফর সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করেন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী কমিটির সদস্যা খাদিজা আহমেদ বন্যা ও মাহমুদা চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে এই দুই গুণী শিল্পীকে উত্তরীয় প্রদান করেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মেজবাহ উদ্দিন ইকো।
অনুষ্ঠানের সমাপনীতে সভাপতি সিরাজুল বাসিত চৌধুরী এবং সাবেক সভাপতি ও নির্বাহী কমিটির সদস্য মারুফ চৌধুরী সদস্যদের স্কলারশিপ ট্রাস্ট ফান্ডে অবদান রাখার আহ্বান জানান।
সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল হাসান স্কলারশিপ ট্রাস্ট ফান্ড সম্পর্কিত আপডেট দেন। তিনি জানান যে গত বার্ষিক সাধারণ সভায় ১৪০টি স্কলারশিপ সদস্যদের দ্বারা অঙ্গীকার করা হয়েছিল এবং এর অধিকাংশই ফান্ডে প্রদান করা হয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ট্রাস্ট ফান্ড টিমের মাধ্যমে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভাবান ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা ১০০ জন ছাত্রছাত্রীকে স্কলারশিপ প্রদান করা যায়। এই স্কলারশিপ বিতরণের উদ্দেশ্যে স্কলারশিপ প্রদান অনুষ্ঠান জানুয়ারি ২০২৬-এর শুরুতে সিনেট ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে উপাচার্য, সহউপাচার্য, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবক উপস্থিত থাকবেন।
অনুষ্ঠানে আগত সবাইকে ‘বিজয়ফুল’ পরিয়ে দেন সৈয়দ হামিদুল হক, মাহফুজা রহমান, মাহারুন আহমেদ ও নিলুফা ইয়াসমীন।
সভাপতি সিরাজুল বাসিত চৌধুরী সমাপনী বক্তব্যে সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারী–পুরুষ আত্মত্যাগ করেছেন তাঁদের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করেন এবং বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানকে সফল করতে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানান এবং আগত অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।