মা, তুমি অয়োময়
বুশরা সব দুঃখ, হতাশা ঝেড়ে ফেলে পুরানো গানটা গুন গুন করে গাইল। ‘কে সেরা সেরা’ (Whatever will be, will be) তারপর নিজ মনেই আরেকটা লাইন জুড়ে দিল ‘ভাগ্য হায়রে ভাগ্য, পাল্টায় তাকে কার সাধ্য’ চমকে গেল নিজের সৃষ্টিতে। সে যে এমন কিছু করার ক্ষমতা রাখে, তা সে কখনোই জানতো না।
বুশরা দোষে–গুণে মিলেমিশে একজন অতি অসাধারণ মানুষ। কোনো বিষয়েই সে কট্টর মতবাদী নয়। তবে জোর করে কোনো কিছু তার কাঁধে চাপাতে চাইলেই মুশকিল। মাঝেমধ্যে দুঃসাহসী কাজ করতেও পিছপা হয় না। অনুরোধে ঢেঁকিও গিলতে পারে। তবে হুকুম দিয়ে তাকে তিলপরিমাণও হেলানো যাবে না। তার কথা হলো, সে যা ভাবে, যে আচরণে আজীবন অভ্যস্ত, তা থেকে অযথা তাকে জোর করে সরিয়ে আনতে চাইলে সে কেন মানবে? তার যুক্তি হলো তার বিশ্বাস, তার আচার–অভ্যাস অন্য কারও কোনো ক্ষতি তো করছে না। তাহলে কেন তা বিসর্জন দিতে হবে? কেন তাকে অন্যায় পরীক্ষায় ফেলা?
বুশরার ছেলেই তাকে পরীক্ষায় ফেলেছে। গত রাতে কী এক দাপ্তরিক বা অফিশিয়াল অনুষ্ঠান না পার্টি থেকে ফিরেই—‘কী আছে খাবার? খুব ক্ষুধা পেয়েছে, তাড়াতাড়ি খাবার দাও।’ খাবার গুছিয়ে দিতে দিতে বুশরা জিজ্ঞেস করল, কী খাবার ছিল পার্টিতে?
বিরক্তি নিয়ে ছেলে বলল, চিজ আর ওয়াইন।
চিজ খেতে পারতে একটু।
শুধু চিজ কেন, ওয়াইনও খেতে পারতাম, তবে ইচ্ছা করেনি।
ঘরোয়া পোশাক পরে হাতমুখ ধুয়ে ছেলে খেতে বসল। মায়ের তৈরি করা খাবার খেল তৃপ্তির সঙ্গে। ক্ষুধা মিটে যেতেই চেহারায় প্রশান্তি ফিরে এল। তারপর শুরু হলো কথা, ‘জানো মা, বিনা পয়সার খাবার, তা মদ হোক আর যা–ই হোক, বিদেশিরাও এমন ঝাঁপিয়ে পড়ে খায় যে বিশ্রী লাগে। দুই–একজন এত খেয়েছে যে টালমাটাল। কী করে ঘরে ফিরবে, কে জানে?’
মা-ছেলেতে অনেক গল্প হলো। করপোরেট জগৎ থেকে কিয়ক্সের পত্রিকা বিক্রেতা-সবার সব বিষয় নিয়েই অনেক তথ্য মাকে গল্পচ্ছলে বলে যায় বিশাল। বিশ্বায়নের কারণে সব জায়গায় সব সময় নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য মানুষ অনবরত চেষ্টা করছে। ওর অফিসের বস ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে, সে কিছু মামুলি শব্দ শেখার চেষ্টা করছে যাতে ওইখানে মানুষজনকে মুগ্ধ করতে পারে। বুশরার ছেলেও মান্দারিন ভাষা কিছুটা শেখার চেষ্টা করছে। ওকে অফিসের কাজে হংকং ও সাংহাইয়ে যেতে হয় প্রায়ই। সামনে আরও যেতে হবে। বুশরা শুনে অবাক হলো। ওর ছেলের অফিসের সামনে জার্নাল, ম্যাগাজিন ইত্যাদি বিক্রি হয়; কিয়ক্স ধরনের বুকস্টল রয়েছে। কিয়ক্সের মালিক/বিক্রেতা পাঁচ–ছয়টা ভাষায় ‘হ্যালো’, ‘হাউ আর ইউ’ বলতে পারে। নানান ভাষায় কিছু বুলি ঝাড়তে পারে বলে মানুষজন ভালোই কেনাকাটা করে তার কাছ থেকে। বুশরা ভাবল, বিশ্বায়ন মানুষকে শুধু বুদ্ধিমানই করেনি, চালাকচতুরও করেছে।
বুশরার ছেলে বিশাল হঠাৎ মাকে বলল ‘মা, তোমাকে একটা প্রশ্নèকরছি, চট করে উত্তর দেবে, উত্তর দিতে হবে কিন্তু।’
প্রশ্নটা শুনি।
একগ্লাস মদ দিয়ে তোমাকে বলা হলো, যদি মদ না খাও, তাহলে তোমার ছেলের মাথার খুলি গুলি চালিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে।
বুশরা ভীষণ প্রতিবাদী হলো। ‘এটা কী রকম প্রশ্ন? আমি তো এই প্রশ্নকারীকেই ধরব, কেন সে আমার ছেলেকে মারবে, কী অন্যায়! কী রকম জুলুমবাজি! মদ এমন কি মহার্ঘ অমৃত যে তা খেতেই হবে?’
মায়ের রাগান্বিত চেহারা দেখেও বিশাল শান্ত গলায় বলল, ‘মা, তুমি উত্তর দেবে “হ্যাঁ” অথবা “না”।’
বুশরা ভীষণ কঠিন গলায় বলল, ‘এ ধরনের অদ্ভুত ধাঁধায় ফেলে মানুষকে বিপর্যস্ত করা কেন?’
এবার বুশরার ছেলে আরও কঠিন কথা বলেই উঠে গেল। ‘ছেলে মরুক, তবু তুমি মদ স্পর্শ করবে না, তা–ই না?’
এরপর বুশরা একা একা আপনমনে গজগজ করল অনেকক্ষণ, ‘আরে এ তো আমেরিকার বুশের মতো বেয়াদবি, ইরাকে সাদ্দামকে খতম করতে যাচ্ছি আমি, তোমরা যদি আমার পক্ষে না থাকো, তবে ধরে নেব বিপক্ষে (If you are not with us, you are against us)! আরে বাপ, কারও কারও তো নিরপেক্ষ থাকার অধিকারও আছে, নাকি?’
আরও একবার মদের প্যাঁচে পড়েছিল বুশরা। কয়েকজন আধুনিক হতে উৎসাহী নারী বুশরাকে মদ চাখার আসরে ডাকবে বলেছিল। শিলং, জাফলং নাকি জিলং নামে কোনো এক ছোট্ট শহরে এক মহিলা বান্ধবীদের মদ খাওয়ার জন্য গোপন আসরে ডেকেছেন। মহিলা ভাবেন ও বলেন যে মদ খেতে পারা হচ্ছে আধুনিকতা আর সাহসিকতা। যারা যেতে উৎসাহী, তাদের লক্ষ্য মাতাল হয়ে মজা করা নয়, বরং দুঃসাহসী কাজ করার আনন্দ ও অভিজ্ঞতা অর্জন। যারা একটু কেমন যেন জবুথবু, যেকোনো মজলিশ-মিটিংয়ে, দাওয়াতের আসরে নিজেদের নিয়ে কেমন যেন বিপন্ন বোধ করে। তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব বড় বেশি, তবে সামান্য মদ চাখার জন্য ওই আসরে যাওয়ার আগ্রহ খুব। তারাই সাহসী হওয়ার জন্য বড় কাতর। ফ্রাঙ্ক বাউমের লেখা মজার কাহিনি ‘ওজের জাদুকর’ বইতে দেখা যায়, ভীরু সিংহকে সাহসী হওয়ার জন্য যে জাদুই দাওয়াই জাদুকর দিয়েছিল, তা ছিল মদ। আরও কজন নারীর ধারণা, বিদেশে সব অভিজ্ঞতা অর্জন না করলে জীবনটাই যেন বৃথা। বুশরা এদের কাউকে কাউকে দেখে আর ভাবে, দেশে থাকলে এমন উদ্ভট বিলাসিতা করার ক্ষমতা বা মনোবৃত্তি এদের কোনো দিনই হতো না। তা সুযোগ যখন পেয়েছে, চাখুক তারা। পরে কী কারণে কে জানে, বুশরাকে তথাকথিত আধুনিকারা এড়িয়ে গেল। বুশরার অল্প অভিমান হলো। মদ খেতে নয়, তবে মজা দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য।
নিজের সাহস প্রমাণ করার সুযোগ অবশ্য এসে গেল। অফিসের একজনের বিদায় অনুষ্ঠান বা জন্মদিনে উপহার কেনার দায়িত্ব বুশরা সাগ্রহ নিজেই নিয়ে নিল। সে এক অদ্ভুত কাণ্ড করল। সুন্দর পরিপাটি শাড়ি পরে নামীদামি শপিং সেন্টারে গিয়ে এক বোতল মদ কিনল। মদের বোতল নেওয়ার জন্য ওই আকারের দামি ব্যাগ বা প্যাকেট কিনল। প্যাকেটে মদের বোতল পুরে তার রঙিন সুতার হাতল ধরে দুলিয়ে দুলিয়ে গটগট করে কার পার্কিংয়ে এল। তার ভাবটা এমন, দেখ, লুকিয়ে–ছাপিয়ে নয়, প্রকাশ্যে মদ কেনার সাহস আমারও আছে।
এদিকে সাহসিকাদের আসর লাটে উঠেছে, কারণ আসরের মক্ষীরানি আরও বড় নেশা ধরেছে। বিত্ত আর নতুনত্বের নেশা। নেশার তাগিদে একদিন এক বিত্তশালী পুরুষের সঙ্গিনী হয়ে স্বামী-সন্তান-সংসার ফেলে ঘর ছেড়েই চলে গেছে সে।
পরে দু–একজন বুশরাকে বলল, ‘ভালো হয়েছে, আপনি ওই আসরে যাননি।’ বুশরা বলল, ‘আপনাদেরও লাভ–ক্ষতি কিছু হয়নি, অভিজ্ঞতাটাই যা হয়েছে।’ আরেকজন বলল, এমন অভিজ্ঞতায় কী–ই বা যায়–আসে।
তারপর বক্তা নিজেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, ভাগ্যিস ওই মহিলার অন্য অভিজ্ঞতাটাও অর্জনে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েনি, এ–ই যা রক্ষা!
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বুশরার মদ কেনার ঘটনাও দু–একজন জানল। কেউ কেউ নানা কথাও রটাল। তবে সবই তার পেছনে। একজন বুশরার কাছে পাত্তা পাওয়ার আশায় একদিন এসে বলেছিল,
অমুক আপনার নামে বাজে কথা বলে বেড়াচ্ছে যে আপনি নাকি মদ কেনেন প্রায়ই।
প্রায়ই কিনি না, একবারই কিনেছি, তা–ও অফিসের জন্য, তাই লুকানো–ছাপানোর প্রয়োজনই মনে করিনি।
ওমা তা–ই! এদিকে উনি আরও কী কী আজেবাজে কথা যেন বললেন।
দেখুন, আমাকে কেউ পটায়নি, উসকানি দেয়নি, জোর করে মদ কিনে আনতে বাধ্য করেনি। আমিই স্বেচ্ছায় দায়িত্বটা নিয়েছিলাম। আর অমুকের অভ্যাসটা নেড়ি কুকুরের মতো পেছনে ভুকভুক করা। সামনে এসে ঘেউ ঘেউ করার মোটেও সাহস হয় না তার। খোঁজ নিলে দেখবেন, উনি আপনার নামেও কোথাও না কোথাও, কাউকে না কাউকে কিছু মনগড়া কথা বলে বেড়াচ্ছেন।
বুশরার যুক্তির তোড়ে যে কানকথা লাগাতে এসেছিল, সে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল।
আজ অনেক বছর পর সব মনে পড়ল। বিশালের ওপর ক্ষোভ হলো। অভিমান হলো খুব। বিশাল কি ভাবছে যে বুশরা বিশালের মৃত্যুকে মেনে নেবে, তবু মদ খাবে না? বুশরার নীতি হলো, মানুষকে ভয় দেখিয়ে কোনো কাজে বাধ্য করা ভীষণ ভীষণ অমানবিকতা।
বুশরা মনে করতে চেষ্টা করল, এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো কাউকে ফেলা হয়েছিল কি? তখন সে কী করেছিল? হঠাৎ চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। দৃশ্যটা ‘লগন’ নামে একটি সিনেমার। বিদেশি সিনেমা তালিকায় অস্কার মনোনয়নও পেয়েছিল। ‘লগন’ সিনেমার কাহিনি ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে। কোনো এক অঞ্চলে খরার জন্য ফসল সব জলে গেছে। সরকারকে খাজনা দেওয়ার কোনো উপায় নেই। ইংরেজ প্রভুর কাছে খাজনা মওকুফ করার জন্য অনেক কাকুতি–মিনতি করা হচ্ছে। একদিন ওই অঞ্চলের জমিদার এলাকার ইংরেজ শাসকের ঘরে আমন্ত্রিত হয়ে গেছেন। খাবার টেবিলে পাগড়ি পরা রাজকীয় বেশধারী জমিদার খুব বিনীতভাবে খাজনা মওকুফের জন্য সাদা মনিব ইংরেজের কাছে আর্জি করলেন। ইংরেজ লোকটা তাকে নাস্তানাবুদ করার জন্য টেবিলে রাখা গরুর মাংসের তরকারি খাওয়ার অনুরোধ করল। ইংরেজ বাবু সাহেবের প্রস্তাব হলো, ওই হিন্দু জমিদার যদি গরুর মাংস গলাধঃকরণ করতে পারেন, তবেই এবারের খাজনা মাফ পাবেন। একজন মানুষের আজন্ম লালিত আচরণকে অসম্মান, অপমান! কী নিষ্ঠুর রসিকতা! কী জুলুমবাজি!
ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল বুশরা। পরদিন ছুটি। ঘুম ভাঙল দেরিতে। রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ। হাত–মুখ ধুয়ে কাপড়চোপড় পরে সতেজ লাগছিল তবে মনে একটা কষ্টের চাপ ছিল ঠিকই। রান্নাঘরের একপাশে খাবার জায়গা বা মিল এরিয়া, তাতে পাতা খাবার টেবিল। গ্যাসের চুলায় ফ্রাইপ্যানে বিশাল কিছু ভাজছে। খাবার টেবিলে তাকিয়ে বুশরা অবাক! ওর নাশতার প্লেট, কাপ সুন্দর করে গুছিয়ে প্লেসম্যাটে রাখা। তার পাশেই ছোট্ট ফুলদানিতে বাগান থেকে তোলা তিনটা গোলাপ সাজানো। বিশাল এনেছে ফুল তুলে! ওর স্বভাবের বাইরে এটা। কঠিন পরীক্ষায় ফেলার জন্য বিশালের ওপর মনটা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ছিল। একা একা সে ছেলেকে বড় করেছে, তবে মানুষ কতটা করতে পেরেছে, তা জানে না। তার একমাত্র ও একান্ত আপনজন ওই ছেলেই। ভয়ও করছিল এই ভেবে যে আপন সন্তান যেন তাকে ভুল না বোঝে। মন বলেছে বারবার Que Sera Sera (যা হবার, তা হবেই)। মায়ের শব্দ পেয়ে বিশাল ফিরল। চেহারা তার হাসিতে উজ্জল। তারপর ও যা বলল, তা শুনে বুশরার উদ্বেগ, আশঙ্কা নিমেষেই হাওয়া। প্রশান্তির পারাবত যেন ডানা ঝাপটাল চারপাশে।
‘মা, ওই ফুল তোমার জন্য। তুমি মা, অয়োময়! তোমাকে ভয় দেখিয়ে জব্দ করা যাবে না কোনোভাবেই। I do respect you...’
বুশরা গভীর শ্বাস টেনে এবার বলল, ‘মানুষকে ধ্বংস দিতে পারো, তবে পরাজিত তুমি তাকে করতে পারবে না। আমি আমার কথায় অটল ছিলাম আর আমার ভাবনায় ছিল Que Sera Sera।’
আলফ্রেড হিচককের The Man Who Knew Too much সিনেমার অস্কার পাওয়া গানের অংশ...