সোনালি রোদের মেয়ে

অলংকরণ: আরাফাত করিম

কয়েক দিন ধরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে এ শহরে। আমি কাজ করি একটা হাসপাতালে। এ শহরে শীতকালে এমন ঝুম বৃষ্টি হয় বছরের কয়েকটা দিন। তাই সাধারণ মানুষ তেমন অভ্যস্ত নয় বৃষ্টিতে। ঝুম বৃষ্টি হলেই সবাই ফ্রি ওয়েতে এত ধীরে গাড়ি চালায়, ট্রাফিক জ্যাম করে ফেলে। ৪৫ মিনিটের পথ যেতে দুই–তিন ঘণ্টা লাগে। এমনই এক দিনে ঠিক সূর্যাস্তের সময়ে কাজ শেষ হয়ে গেল। গ্লাসে ঘেরা একটা ওয়েটিংরুমে দর্শনার্থীদের ভিড় নেই আজ, দেখে বসে পড়লাম। ঝুম বৃষ্টিতে শেষ বিকেলের রং পাহাড়ের চূড়ায়। কী অপূর্ব একটা দিনের শেষ প্রায়।

এমন সময়ে সু এসে ঢুকল রুমটাতে। সে ফার্মাসিস্ট। একসঙ্গে অনেক বছর কাজ করি আমরা। ওর হাবি আমাদের হসপিটাল মেডিসিনের বস। স্টিভ। সু বলল, কী ব্যাপার বসে আছ যে এখানে? বললাম এই তো ট্রাফিক অ্যাপ ফলো করছি, লাল থেকে হলুদ হলেই বেরিয়ে যাব। তুমি? সু হাসল, বলল আজ অনেক দিন পর একসঙ্গে এসেছি কাজে। স্টিভের কাজ শেষ হলেই আমিও চলে যাব। আমি নড়েচড়ে বসলাম। ভীষণ স্মার্ট, মানবিক, অসম্ভব কর্মঠ বসের সঙ্গে মিষ্টি সুর কেমন করে বিয়ে হয়েছে?

আমাদের বাচ্চারাও কাছাকাছি বয়সের মানে আমারগুলো কলেজ শেষ করলে ওরগুলো শুরু করছে। বাচ্চা নিয়ে প্রায়ই কথা হয় স্টিভের সঙ্গে। আর এটা তো ভালোবাসার মাস। বলবে নাকি সু ওদের ভালোবাসার কিছু কথা আমাকে?

বললাম আচ্ছা স্টিভ তো ভীষণ মানবিক যেকোনো বিষয়ে, অসম্ভব হেল্পফুল সবার জন্য আর ভীষণ পপুলার। তোমাদের বিয়ে কীভাবে হয়েছে বলবে? আর বাসায় কেমন সে? সু হাসল। বলল ও আমার ঝলমলে দিন আর আমি ওর সোনালি রোদের মেয়ে। শোন তাহলে, প্রায় ২২ বছর আগে গ্র্যাজুয়েশন শেষে তখন মাত্র জয়েন করেছি হাসপাতালে। একদিন পেশেন্ট কোড করল (পালস, ব্লাড প্রেশার কিছু নেই)। ক্র্যাশ কার্ট ( প্রয়োজনীয় ওষুধসহ কার্ট, মরণাপন্ন রোগীর জন্য ব্যবহার করা হয়) মাত্র রেডি করেছি, সব ফ্লোরে দেওয়া হয়েছে। খোলা হলো ক্র্যাশ কার্ট রোগীর জন্য। কোড রান করছিল স্টিভ। তরুণ ভীষণ স্টার্ট একটা ছেলে, একমাথা ঘন চুলের ফাঁকে ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ঝলমল করছে। ওর সঙ্গে পেশেন্টের কারণে কথা হয়েছে ফোনে। সামনাসামনি সেই প্রথম দেখেছিলাম। কোর্ড সফল ছিল, রোগীকে স্টেবল করে ৩০ মিনিটের মাথায় ইনটেনসিভ কেয়ারে পাঠানো হয়েছিল। স্টিভ প্রয়োজনীয় সব ওষুধ পাওয়ায় ভীষণ মুগ্ধ।

তারপর ডিব্রিফিংয়ে সবাইকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া থেকে শুরু করে ওর বুদ্ধিদীপ্ত অভিমত মুগ্ধ করেছিল আমাকে। মনে হচ্ছিল মানুষকে মানুষ হিসেবে, সহকর্মীকে সহকর্মী হিসেবে মূল্যায়ন করার মতো ডাক্তার খুব বেশি নেই। তবে ভালোবাসার মতো সাহস আমার হয়নি। মাস কয়েক পরের কথা, একদিন হুট করে আমার গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমার বসকে ফোন করে বলেছিলাম সাহায্য নিয়ে মেকানিকের কাছে গাড়ি পৌঁছে কাজে আসতে দেরি হবে। স্টিভ ওর পাশে বসে শুনেছিল। সেদিন বিকেলে আমাকে দেখে বলেছিল সু বদলে ফেল না গাড়ি। আমার বাবা একজন মেকানিক ছিলেন। কতবার যে রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হয়ে যেত, একটু টানাটানি ছিল আমাদের আটজনের সংসারে। তুমি তো চাকরি করো, রাতে ঘরে ফিরতে হয়, যদি কোনো সমস্যা হয় তোমার? ওর কেয়ারিং ভাব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বলেছিলাম তুমি কি তোমার বউয়ের জন্য ও এত কেয়ারিং?

স্টিভ হেসেছিল, বলেছিল কারও দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা না হলে নিজের কাছে এনে কষ্ট দিই না বলে নিজেরে যোগ্য করেছি সু। বউ নেই, তবে আমি রেডি এখন। দেখি কী হয়। সু চিন্তা করেছিল এমন একজনের জন্য যোগ্য কাউকে ও খুঁজে বের করবে। কিন্তু কাউকে স্টিভের জন্য ওর পচ্ছন্দ হচ্ছিল না।

তারপর সু পরিপূর্ণ চোখ মেলে চাইল আমার দিকে। বলল এ রকম ঝুম বৃষ্টির কোনো একদিন ফারহানা আমি বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু কিছুতেই বৃষ্টি থামছিল না। ছাতা ভুলে আমি গাড়িতে ফেলে এসেছি। ঘণ্টাখানেক পর দেখি স্টিভ যাচ্ছে। বলল কী ব্যাপার, দাঁড়িয়ে আছ যে? বললাম ছাতা নেই, ও বলল চলো একসঙ্গে যাই। অল্প একটু পথ কিন্তু সিঁড়ি থেকে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম। স্টিভ যত্ন করে ধরল, তারপর হাত ধরে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। তারপর বলল মেয়ে একটু সাবধানী হও, সব সময় কি সাথে আমি থাকব? কেমন ঘোরলাগা গলায় আমি না, যেন অন্য কেউ বলেছিল চেষ্টা করবে?

লেখক

সেই থেকে বছর দুই ডেট করেছিলাম আমরা। দিনে দিনে মুগ্ধতা বেড়েছে আমার আর স্টিভ আকাশ ছুড়েছে সবকিছুতে কিন্তু সেদিনের ধরে রাখা হাত কক্ষনো ছাড়েনি। ভালোবাসার দায়িত্ব নিয়ে যে হাত ধরে থাকে সেই তো পুরুষ। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে এতটুকু দেরি হয়নি এরপর।

সুর কথা শুনে চুপ করে থাকলাম মাথা নিচু করে। কী অসম্ভব সত্য কথা। কত প্রতারক দেখেছি কিন্তু এ রকম অসম্ভব ভালো মানুষ বসের মতো মানুষ কত কম দেখেছি। নিজের বউয়ের এত প্রশংসা করে সে সত্যিই ভালো। তাই তো আমাদের যে কোনো প্রয়োজনের আমরা স্টিভের কথাই চিন্তা করি। সে ভেবেচিন্তে সমস্যার একটা সমাধান দেবেই। মুখ তুলে দেখি স্টিভ এসে গেছে সুকে নিতে। আমাকে দেখে বলল কাজ শেষ ফারহানা? যাও, বাসায় যাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের অ্যানিভার্সারি কবে সু?
স্টিভ হেসে বলল ১৪ ফেব্রুয়ারি, ঝলমলে সোনালি রোদের এক দিনে আমার সোনালি রোদের মেয়ে বলেছিল আই ডু ফারহানা। কেন গল্প লিখবে নাকি?

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]